নালন্দা: জ্ঞানের প্রাচীন আলোকে আধুনিক শিক্ষার নবজাগরণ


ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের অন্যতম গর্ব, বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আজও বিশ্বের কাছে শিক্ষার এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এই প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি আমাদের সভ্যতার ইতিহাসের এমন এক অধ্যায়কে ধারন করে রেখেছে যেখানে জ্ঞানচর্চা, গবেষণা, এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের এক অপূর্ব ধারা প্রবাহিত হয়েছিল। প্রায় ৫ম শতকে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠটি শুধু ভারত নয়, বরং সমগ্র এশিয়ার শিক্ষানুরাগী, বৌদ্ধ মুনি, এবং জ্ঞানপিপাসুদের কাছে একটি অতুলনীয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। নালন্দা শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, বৌদ্ধ ধর্ম এবং এশীয় দর্শনের বিকাশেও বিশেষ অবদান রেখেছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সময়ে ভারতের বৌদ্ধ ঐতিহ্য, চিন্তা ও দর্শনের সমৃদ্ধ ধারাকে সমৃদ্ধ করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক বিন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ধারণ করে, নালন্দা বিশ্বের এক প্রাচীনতম শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত।

নালন্দার খ্যাতি শুধু ভারতবর্ষেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং চীন, কোরিয়া, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, তুরস্ক, জাপান, শ্রীলঙ্কা, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু পণ্ডিত এবং বুদ্ধিজীবী নালন্দার শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এখানকার সম্মানিত শিক্ষক এবং বিদ্যাপীঠের অসংখ্য গ্রন্থ ও জ্ঞান সম্ভারের টানে বিদেশি পণ্ডিতরা এখানে আসতেন। চীনা তীর্থযাত্রী জুয়ান-জাং ছিলেন নালন্দার একজন বিখ্যাত ছাত্র, যিনি ৭ম শতকে এখানে এক দশকেরও বেশি সময় অতিবাহিত করেন। তাঁর লেখাগুলি এবং বর্ণনাগুলি নালন্দার সেই স্বর্ণযুগের প্রেক্ষাপটে আমাদের অবগত করে। শিক্ষার প্রতি তাঁর অনুরাগ এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক দিকগুলি আমাদের কাছে বৌদ্ধিক উদারতা এবং বিনিময়ের এক সুন্দর চিত্র তুলে ধরে। শুধু জুয়ান-জাংই নন, আরও অনেক চীনা তীর্থযাত্রী নালন্দায় শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং তাঁদের বর্ণনা থেকে আমরা নালন্দার পাঠদান পদ্ধতি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্তরিক সম্পর্ক এবং শিক্ষার পরিবেশ সম্পর্কে অমূল্য তথ্য পাই।

 

নালন্দার স্থাপত্যে এক বিশেষ ধারা প্রদর্শীত হয় যা সেই সময়ের আধুনিক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে এক অনন্য পরিচিতি লাভ করে। প্রাচীন স্থাপত্যকলায় গড়া লাল ইটের গঠন এবং বিশাল গ্রন্থাগার, মঠ, মন্দির ও প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্রগুলি নালন্দার অসাধারণ প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতার পরিচয় বহন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এর গ্রন্থাগার ‘ধর্মঞ্জ’। তিনতলাবিশিষ্ট এই গ্রন্থাগারটি অসংখ্য পাণ্ডুলিপি, ধর্মগ্রন্থ এবং দর্শনের উপর ভিত্তি করে লেখা গবেষণাপত্রের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার ছিল। এমনকি এখানে এমন অনেক লেখনী সংরক্ষিত ছিল যা পরবর্তী সময়ে লুপ্ত হয়ে যায়। এই গ্রন্থাগার এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যে বলা হয়, একবার আক্রমণকারী বাহিনী এতে আগুন লাগিয়ে দিলে কয়েক মাস ধরে সেই অগ্নিকাণ্ড চলতে থাকে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের সময় এখানে রাখা অসংখ্য মূল্যবান জ্ঞান এবং গবেষণাপত্র ধ্বংস হয়ে যায়, যা ইতিহাসে এক অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

 

নালন্দার শিক্ষার পদ্ধতি ছিল ব্যাপক এবং উদার। এখানকার শিক্ষাদর্শন এমন এক শৈলীতে গড়ে উঠেছিল যেখানে ধর্ম, দর্শন, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত প্রভৃতি বিষয়ের বৈচিত্র্য ছিল। এর এই বৈচিত্র্যময় পাঠ্যক্রম ছাত্রদের এক সু-বৃত্ত শিক্ষা প্রদান করত, যা কেবলমাত্র একদিকে নয় বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি গভীর জ্ঞান এবং সংবেদনশীলতা তৈরি করতে সহায়ক হতো। নালন্দার শিক্ষাদানের মূল দিক ছিল শাস্ত্রের মূল বিষয়গুলি এবং এশিয়ার বহুমুখী সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাথে একীভূত এক দার্শনিক শিক্ষা প্রদান করা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল এর আন্তঃবিভাগীয় শিক্ষা পদ্ধতি। নালন্দায় বিভিন্ন বিষয়ে একযোগে পাঠদান করা হতো। এখানে ছাত্রদের একাধিক বিষয় নিয়ে গবেষণা এবং শিক্ষাদানের সুযোগ ছিল। বৌদ্ধ দর্শন এবং ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং যুক্তিবিদ্যার মতো জটিল বিষয়গুলিরও অধ্যয়ন করা হতো। এই আন্তঃবিভাগীয় পদ্ধতির জন্য নালন্দা শিক্ষা গ্রহণ এবং শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা তৈরি করেছিল, যা পরবর্তী সময়ে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি আদর্শ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এখানে ছাত্রদের মধ্যে নিজেদের ধারণা এবং মতামত বিনিময় করার জন্য বিতর্কের সেশন থাকত, যেখানে সমালোচনামূলক চিন্তার গুরুত্ব দেওয়া হতো। এই বিতর্কের পরিবেশ ছাত্রদের বিশ্লেষণমূলক চিন্তাভাবনা এবং মেধাকে আরও বিকশিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। নালন্দার আবাসিক শিক্ষা ব্যবস্থাও ছিল বিশেষ এক আকর্ষণের কেন্দ্র। শিক্ষক এবং ছাত্ররা একসঙ্গে একটি ঘনিষ্ঠ শিক্ষামূলক পরিবেশে একসঙ্গে বসবাস করতেন। এই আবাসিক শিক্ষার কারণে শিক্ষক এবং ছাত্রদের মধ্যে গভীর সংযোগ এবং অনন্য বন্ধন গড়ে উঠত। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে একসঙ্গে থাকতেন এবং এটি একটি পারিবারিক পরিবেশ তৈরি করেছিল, যা শিক্ষার পরিবেশকে আরও অন্তরঙ্গ এবং সহযোগিতামূলক করে তুলেছিল। এই আবাসিক পদ্ধতি শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেই নয় বরং তাদের চারিত্রিক এবং সামাজিক গুণাবলী গড়ে তুলতেও সহায়ক ছিল।

 

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংস ছিল এক ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক সংঘাতের পরিণতি, যা উপমহাদেশের এক সমৃদ্ধ জ্ঞানকেন্দ্রকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়। এর ধ্বংস এক গভীর বিষাদময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির ১২০০ খ্রিস্টাব্দের আক্রমণের ফলে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। খিলজির প্রধান লক্ষ্য ছিল বৌদ্ধধর্মের মতো ভারতীয় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করা এবং তার সাম্রাজ্যের জন্য কৌশলগত স্থল তৈরি করা। এই আক্রমণের সময় খিলজির বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল গ্রন্থাগারে আগুন লাগায়, যাতে হাজার বছরের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি এবং জ্ঞান ধ্বংস হয়ে যায়। এই ধ্বংস এক বিশাল বৌদ্ধিক শূন্যতার সৃষ্টি করে, যা ভারতীয় উপমহাদেশের জ্ঞানচর্চার ধারাবাহিকতাকে চিরতরে বিপর্যস্ত করে। খিলজির আক্রমণের পর নালন্দার অধিকাংশ ছাত্র এবং পণ্ডিতেরা সেখান থেকে পলায়ন করতে বাধ্য হন এবং এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ধারাবাহিকতায় এক চরম বিপর্যয় আসে। এই আক্রমণের পর ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধ শিক্ষার প্রভাব এবং উপস্থিতি অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং একটি সমৃদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র চিরতরে হারিয়ে যায়।

 

খিলজির সামরিক আক্রমণ কেবল রাজনৈতিক ছিল না, এটি ছিল মূলত ধর্মীয় সংঘাতের প্রতিফলন। নালন্দা শুধুমাত্র এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, এটি ছিল বৌদ্ধধর্মের জ্ঞানচর্চা ও ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং পণ্ডিতরা এখানে শিক্ষা নিতে আসতেন। ফলে, বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে নালন্দার এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এটিকে আক্রমণকারীদের কাছে একটি প্রাথমিক টার্গেট করে তোলে। খিলজি এবং তার বাহিনী ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল যাতে তাদের সামরিক এবং ধর্মীয় ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা আরও শক্তিশালী হয়। ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, আক্রমণকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত পণ্ডিত, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীকে হত্যা করে, যার ফলে বৌদ্ধধর্ম এবং বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চার উপর এক স্থায়ী আঘাত আসে। তদ্ব্যতীত, নালন্দার পতনের জন্য তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতাও ছিল দায়ী। ১২শ শতাব্দীতে উত্তর ভারতের রাজন্যবর্গের মধ্যে প্রায়শই ক্ষমতার লড়াই চলত এবং এতে রাজ্যগুলির মধ্যে ঐক্যের অভাব ছিল। পালের শাসনাধীনে নালন্দা বিকাশ লাভ করলেও, পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুরক্ষা এবং পৃষ্ঠপোষকতা কমে যায়। স্থানীয় রাজারা খিলজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ঐক্যের অভাবের ফলে নালন্দার মতো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি দুর্বল প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পড়ে, যা আক্রমণকারীদের সহজ শিকার বানায়।

 

ধ্বংসের এই ঘটনার প্রভাব কেবলমাত্র ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি বিশ্ব জ্ঞানচর্চার ধারাবাহিকতাতেও বিরাট প্রভাব ফেলে। নালন্দা ছিল তখনকার বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি। এখানে জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত, দর্শন এবং ধর্মতত্ত্বের মতো নানা বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা ও চর্চা চলত। চীনা ভিক্ষু জুয়ান-জাং এর মতো বিখ্যাত পর্যটকের বর্ণনা থেকে জানা যায়, নালন্দার জ্ঞানচর্চা এবং শিক্ষাদানের পরিবেশ ছিল গভীরভাবে উদার ও মুক্তমনা।  গত এক হাজার বছরে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদর্শন এবং মডেল বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জাতি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। নালন্দার উদার, বহুমুখী এবং আন্তঃবিভাগীয় শিক্ষার মডেল প্রাচীনকালে যেমন এশিয়ার বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্রে বিস্তার লাভ করেছিল, তেমনি মধ্যযুগে ইসলামী জ্ঞানকেন্দ্র এবং পরবর্তীকালে ইউরোপের নবজাগরণকালীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশেষত, মধ্যযুগীয় ইসলামী জ্ঞানকেন্দ্র যেমন বাগদাদের বাইতুল হিকমা (জ্ঞানাগার) এবং কর্ডোবার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ নালন্দার মতোই জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার এক উদার পরিসর তৈরি করেছিল। এসব প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত, এবং দর্শনের মতো বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার সুযোগ ছিল, যা নালন্দার শিক্ষাপদ্ধতির সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই মধ্যযুগের ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রগুলো বহুসংস্কৃতির এবং বহু ভাষার পণ্ডিতদের একত্রিত করেছিল। পারস্য, আরব এবং ভারতীয় উপমহাদেশের পণ্ডিতরা একত্রে জ্ঞানচর্চায় অংশগ্রহণ করতেন এবং এর ফলে নালন্দার আদর্শ অনুযায়ী এক বৃহৎ জ্ঞানসম্ভার গড়ে ওঠে। নালন্দার মতোই এখানে গবেষণার স্বাধীনতা এবং বহুভাষিক শিক্ষার পরিবেশ ছিল, যা পরবর্তীকালে ইউরোপের নবজাগরণ এবং প্রাচীন গ্রিক ও রোমান জ্ঞানচর্চার পুনর্জাগরণের পথে একটি সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছিল। এই প্রভাবের কারণেই পরবর্তী সময়ে অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ এবং প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গবেষণা ও চিন্তার স্বাধীনতার ধারণা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

 

এছাড়া, প্রাচীন নালন্দার মতো আবাসিক শিক্ষা পদ্ধতিও পরবর্তীকালে ইউরোপ এবং এশিয়ার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুসৃত হয়েছে। নালন্দার আবাসিক মডেল যেখানে ছাত্র এবং শিক্ষক একসঙ্গে বাস করতেন, এটি পরবর্তীকালে তিব্বতের মনাস্টিক বিদ্যালয়, চীনের বিভিন্ন বৌদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং জাপানের শিক্ষাব্যবস্থায় গৃহীত হয়। এই আবাসিক শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা, অধ্যবসায় এবং নিজস্ব চিন্তাধারার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। নালন্দার প্রভাব মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও প্রসার লাভ করেছিল, যা আজকের মডার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছে। ১২শ-১৩শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন বোলোনিয়া, অক্সফোর্ড এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা নালন্দার গবেষণাধর্মী, উদার এবং সমন্বিত শিক্ষার ধারা দেখতে পাই। নালন্দার মতই এই প্রতিষ্ঠানগুলোও জ্ঞানের বহুমুখী শাখাকে একত্রিত করে শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তুলেছিল। নালন্দার শিক্ষামডেল এশিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়। কিয়োটো, তিব্বতের পোটালা, এবং চিনের কিছু শিক্ষাকেন্দ্র নালন্দার শিক্ষাদর্শন এবং গবেষণার পদ্ধতিকে অনুসরণ করে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। ১৯শ শতাব্দী থেকে শুরু করে ২০শ এবং ২১শ শতাব্দীতেও এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন পেকিং বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়, নালন্দার মডেলের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি অন্তর্ভুক্ত করে। নালন্দার শিক্ষা ও দার্শনিক চিন্তার ধারা আজও বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাসঙ্গিক। বর্তমান যুগে নালন্দার শিক্ষামডেলকে কেন্দ্র করে ভারত, চীন, জাপান, এবং ইউরোপের বহু বিশ্ববিদ্যালয় বৈচিত্র্যময় এবং আন্তঃসংস্কৃতি শিক্ষা পরিবেশ গড়ে তুলছে। শিক্ষার প্রতি নালন্দার দৃষ্টিভঙ্গি নতুন প্রজন্মকে শুধু একাডেমিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার ক্ষেত্রেও সমৃদ্ধ করেছে।

 

নালন্দার ঐতিহ্য ইতিহাসের পাতায় থেকে গেছে এবং আধুনিককালে এটি পুনর্জাগরণের চেষ্টায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ভারতের সংসদ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ পাস করে এবং সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে, প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের নথিভুক্ত করা হয়।এটি প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্রের ধাঁচে গড়ে তোলা হয়েছে। তবে আধুনিক নালন্দা বিশ্বব্যাপী শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে তার লক্ষ্য স্থির করেছে যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও শিক্ষার আদান-প্রদান অব্যাহত থাকবে। বর্তমান নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র ঐতিহাসিক স্মৃতির ধারক নয়, বরং এর শিক্ষাদর্শন আজকের দিনে আরও অর্থবহ হয়ে উঠেছে। বর্তমান নালন্দা টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশবাদী শিক্ষা এবং আন্তঃসংস্কৃতি বোঝাপড়ার মতো বিষয়ে পাঠদান করে থাকে। এর লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের এমন একটি শিক্ষা প্রদান করা যা তাদের বর্তমান বিশ্বে সুষ্ঠুভাবে মানিয়ে নিতে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম করে।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরাধিকার শুধুমাত্র ভারতীয় ইতিহাসেরই নয়, বরং বিশ্ব শিক্ষার ইতিহাসের এক মূল্যবান ধারা। এটি শুধুমাত্র একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নয়, বরং সমগ্র এশিয়ার সাংস্কৃতিক এবং জ্ঞানমূলক যোগাযোগের জন্যও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিককালে এর পুনরুজ্জীবন সেই প্রাচীন বৌদ্ধিক সাধনাকে এক নতুন রূপে পুনর্জীবিত করেছে যা শুধু ভারতের জন্যই নয় বরং সমগ্র বিশ্বের শিক্ষার ক্ষেত্রেও এক অনন্য অবদান হিসেবে বিবেচিত। নালন্দার শিক্ষা এবং ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বর্তমান প্রজন্মও আগামী পৃথিবীর জন্য নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে এবং নালন্দা।

 

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস শুধুমাত্র অতীতের এক মহিমাময় অধ্যায় নয়, এটি শিক্ষার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্যের স্থায়ী আদর্শও বটে। নালন্দা ছিল এমন এক সৃজনশীল উদ্ভাবন ও শিক্ষার কেন্দ্র যা জ্ঞান, সংস্কৃতি, এবং মানবিকতার মুক্ত প্রবাহকে উদযাপন করেছিল। এর ধ্বংসযজ্ঞ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সহিষ্ণুতা এবং একে অপরের প্রতি সম্মান শিক্ষার এক চিরন্তন ভিত্তি। কিন্তু একসঙ্গে, নালন্দার পুনর্জাগরণ আমাদের প্রেরণা দেয় বর্তমান বিশ্বে জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের জন্য। আধুনিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সেই একই মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের আলোকে শিক্ষার আলোকে আজও পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। নালন্দা কেবল ভারতের জন্য নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি মহৎ শিক্ষার প্রতীক। এর শিক্ষামূলক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজও পৃথিবীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আলোড়ন তোলে। এই উত্তরাধিকার থেকেই আধুনিক বিশ্বের প্রয়োজনীয় সংযোগ, বোঝাপড়া এবং জ্ঞানের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হব। নালন্দার ঐতিহ্য আজও আমাদের শেখায় যে জ্ঞান কোনো সীমানায় সীমাবদ্ধ নয় বরং বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত। এটি আমাদের প্রাচীন জ্ঞানচর্চার উত্তরাধিকারের স্মারক, যা বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে বিশ্বজনীন শিক্ষা ও মানসিকতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চিরদিন অনুপ্রাণিত করে চলবে।

 

Leave your review