ব্রিকস (BRICS) নামক অর্থনৈতিক জোটটি বর্তমান বিশ্বে একটি শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠী হিসেবে ধীরে ধীরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে। এর শুরুটা হয় ২০০৬ সালে, যখন উদীয়মান পাঁচটি বৃহৎ অর্থনীতি—ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, এবং দক্ষিণ আফ্রিকা—একসঙ্গে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাথমিকভাবে এই জোটের মূল উদ্দেশ্য ছিল পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। তবে, সময়ের সাথে সাথে এর কৌশলগত প্রভাব ও কার্যক্রম অনেক বেড়েছে। বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধের পর, যখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, তখন ব্রিকসের গুরুত্ব এবং ভূমিকাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাশিয়ার কাজান শহরে তিন দিন ব্যাপী ২২-২৪ শে অক্টোবর ১৬তম বার্ষিক ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ত্রিশটির অধিক রাষ্ট্রপ্রধানরা অংশ নেয় এবারের সম্মেলনে। বর্তমান বিশ্বের এক নতুন প্রেক্ষাপটে এই সম্মেলনটি যেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক মঞ্চে পরিণত হয়। এই সম্মেলনে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পাশাপাশি নতুন সদস্য দেশগুলি যেমন মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে। বৈঠকে মূলত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং বিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থায় ডলারের আধিপত্য কমানোর উদ্যোগগুলো গুরুত্ব পায়। রাশিয়া ও চীনের যৌথ নেতৃত্বে এই জোট নতুন অর্থনৈতিক মডেল ও অংশীদারিত্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে।
ব্রিকস গঠনের পেছনের একটি বড় কারণ ছিল উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলিকে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামোর বাইরে একটি বিকল্প মঞ্চ প্রদান করা। ব্রিকসের সদস্য দেশগুলির বিশাল জনগোষ্ঠী এবং বৈচিত্র্যময় অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্বব্যাপী একটি নতুন ধরনের শক্তির সূচনা করেছে। এর মাধ্যমে তারা বিশ্বব্যাপী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে, যেখানে পশ্চিমা দেশগুলির প্রভাব দিন দিন অনেকটা কমে আসছে। এই পরিবর্তন বৈশ্বিক অর্থনীতির শক্তির ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাতে চলেছে। ২০২২ সালে শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক বড় ধরনের বিভাজন তৈরি হয়। পশ্চিমা দেশগুলি, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে একঘরে করার চেষ্টা করে। কিন্তু, ব্রিকসের অন্য সদস্যরা এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে রাশিয়ার সাথে তাদের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে। চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো পশ্চিমা জোটের নিষেধাজ্ঞার নীতি না মেনে, বরং রাশিয়ার সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত সম্পর্ক আরও গভীর করেছে। এর ফলে ব্রিকসের সদস্যরা আরো সংহত হয়েছে এবং তারা একটি বহুমুখী বিশ্ব-ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে এগোতে শুরু করেছে। এই বিশ্ব-ব্যবস্থা হবে পশ্চিমা আধিপত্য থেকে মুক্ত, যেখানে নতুন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নীতি তৈরি করা হবে, যা বর্তমান গ্লোবাল অর্থনীতির কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করবে নিঃসন্দেহে।
ব্রিকস আজ বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর জন্য একটি শক্তিশালী বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু উন্নয়নশীল দেশ, যারা বহু বছর ধরে পশ্চিমা অর্থনৈতিক নীতি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আই এম এফ) মতো প্রতিষ্ঠানের শর্তযুক্ত অর্থায়নের সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল, তারা এখন ব্রিকসের দিকে তাকাচ্ছে নতুন বিনিয়োগ এবং আর্থিক সুযোগের জন্য। পশ্চিমা বিশ্বের চাপানো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং বাণিজ্য নীতির পরিবর্তে, ব্রিকস সদস্য দেশগুলি একটি বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে ডলারের পরিবর্তে তাদের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের প্রচলন বাড়ানো হচ্ছে। যেমন, চীন ও রাশিয়া তাদের নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করতে শুরু করেছে এবং ব্রিকসের সদস্য দেশগুলির মধ্যে ডলারের উপর নির্ভরতা কমানোর প্রক্রিয়া চলছে। এর মাধ্যমে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কমবে এবং ব্রিকসের প্রভাব আরও বাড়বে। ব্রিকস-এর উত্থান পশ্চিমা বিশ্বের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তাদের মিত্ররা এখন ধীরে ধীরে ব্রিকসের মতো উদীয়মান জোটের কাছে পিছিয়ে পড়ছে। ব্রিকসের সদস্য দেশগুলির বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ তাদের একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে চীন এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলো তাদের কৌশলগত অবস্থান ব্যবহার করে ব্রিকসকে আরও শক্তিশালী করছে। পশ্চিমা দেশগুলি যেখানে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে লড়াই করছে, সেখানে ব্রিকস নতুন অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং বিনিয়োগের পথ খুলছে, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন-পিং এই জোটের উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। পুতিন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার জন্য নতুন অর্থনৈতিক মিত্র খুঁজছেন এবং ব্রিকস সেই মিত্রদের একটি প্রধান প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার তেল ও গ্যাস শিল্পের উপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ার পর, রাশিয়া তার প্রাকৃতিক সম্পদের নতুন ক্রেতা খুঁজে পেয়েছে চীন এবং ভারতসহ ব্রিকসের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে। পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া এখন ব্রিকসের মধ্য দিয়ে একটি বিকল্প আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যা মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা কমাবে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন দিকনির্দেশনা আনবে। অন্যদিকে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন-পিং চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্যকে বিস্তৃত করার জন্য ব্রিকসকে একটি শক্তিশালী মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করছেন। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (BRI) মাধ্যমে চীন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে কৌশলগত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়িয়েছে। চীন এবং ব্রিকসের অন্যান্য দেশগুলি বিশ্বব্যাপী একটি বিকল্প অর্থনৈতিক ও কৌশলগত মডেল গড়ে তুলছে, যা পশ্চিমা অর্থনীতির তুলনায় অনেক বেশি সহযোগিতামূলক এবং উদার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ব্রিকসের সাথে যুক্ত হতে চাইছে, যা এই গোষ্ঠীর শক্তি ও প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। ভবিষ্যতে ব্রিকস বৈশ্বিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যা একসময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের যুগের সমাপ্তি ঘটাবে।
আগামী ৪০-৫০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে, এবং এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যা তাদের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতিতে বড় ধরনের ত্রুটি তুলে ধরে। এই পতনের মূল কারণগুলির মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত গণতন্ত্রের প্রভাব, রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতার অভাব, এবং ভুল আন্তর্জাতিক নীতি গ্রহণ। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের যে অভূতপূর্ব বিস্তার ঘটেছে, তা এক সময় তাদের শক্তির প্রধান উপাদান ছিল। কিন্তু এই অতিমাত্রায় গণতান্ত্রিক সমাজ ক্রমেই অস্থিরতা তৈরি করছে। অত্যধিক গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত অধিকারকে কেন্দ্র করে সমাজের বিভিন্ন অংশে মতপার্থক্য এতটাই তীব্র হচ্ছে যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। মতের ভিন্নতা এবং আদর্শিক সংঘাত একদিকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে, অন্যদিকে এটি সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই প্রবণতা সমাজের ভেতর অসহিষ্ণুতা তৈরি করছে, যেখানে ভিন্নমত গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে এবং রাজনৈতিক পারস্পরিক সহযোগিতার জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। এতে করে দীর্ঘমেয়াদী সরকারের কার্যকারিতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যা সমাজের সামগ্রিক উন্নতির পথে বড় বাধা। দ্বিতীয়ত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ পশ্চিমা রাজনীতিবিদদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব স্পষ্ট। পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা সাধারণত ছোট মেয়াদের জনপ্রিয়তা ও ভোট ব্যাংকের কৌশলেই বেশি মনোযোগ দেন, এবং এ কারণে তারা দীর্ঘমেয়াদে দেশের উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, বা কৌশলগত সমস্যাগুলির সমাধানে যথেষ্ট কার্যকর নীতি নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বে এই দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ভবিষ্যতের প্রজন্মকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে, যেখানে উদীয়মান দেশগুলো, বিশেষত ব্রিকস-এর মতো জোট, নিজেদের কৌশলগত পরিকল্পনা এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে পিছিয়ে পড়তে শুরু করবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আন্তর্জাতিক নীতির ব্যর্থতা। পশ্চিমা বিশ্ব গত কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একধরনের আধিপত্যবাদী নীতি গ্রহণ করেছে, যা অন্যান্য অনেক দেশকে ক্ষুব্ধ করেছে এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোকে বিকল্প পথ খুঁজতে উৎসাহিত করেছে। এই নীতিগুলি, যেমন একতরফা সামরিক হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির ওপর প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা, প্রায়শই ভুল প্রমাণিত হয়েছে এবং বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা দেশগুলির আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এর একটি উদাহরণ, যা রাশিয়া এবং চীনের মতো দেশগুলির প্রতি আরও সহযোগিতা বাড়িয়ে তুলেছে। পশ্চিমা বিশ্বের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো অভ্যন্তরীণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনেক দেশই অর্থনৈতিক বৈষম্য, অভিবাসন সংকট, এবং জন সংখ্যাগত পরিবর্তনের মতো সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদী ও অভিবাসন-বিরোধী রাজনীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সামাজিক অস্থিরতা ও বিভাজন সৃষ্টি করছে। এছাড়া, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা কমছে, যা দীর্ঘমেয়াদে এই দেশগুলির অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ঘাটতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে, এবং এর ফলে ব্রিকস-এর মতো উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিগুলি তাদের চেয়ে এগিয়ে যাবে। পশ্চিমা বিশ্বে রাজনৈতিক বিভক্তি এবং সামাজিক সংঘাতও একটি বড় সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অনেক দেশেই রাজনৈতিক মেরুকরণ তীব্র আকার ধারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে মতাদর্শগত বিভক্তি এখন এতটাই গভীর যে দেশ পরিচালনার প্রক্রিয়া প্রায়ই থমকে যায়। এই ধরনের বিভক্তি দেশের ভেতরে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপেও একই ধরনের বিভাজন দেখা যাচ্ছে। ব্রেক্সিটের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা পশ্চিমা দেশগুলির ভবিষ্যৎ শক্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বর্তমানে ব্রিকস-এর সদস্য দেশগুলো মিলে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ উৎপাদন করে। এর বিপরীতে, জি সেভেন (যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, এবং ইতালি) বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ এবং বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ৩১-৩২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু প্রবৃদ্ধির হারের দিক থেকে ব্রিকস জোটের দেশগুলো অনেক বেশি এগিয়ে আছে। উদাহরণস্বরূপ, চীন এবং ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৫ শতাংশ, ভারতের ছিল ৭ শতাংশের উপরে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। এই প্রবৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকলে আগামী ২০-৩০ বছরে ব্রিকস দেশগুলো জি সেভেন (G7)-এর অর্থনৈতিক আকারকে ছাড়িয়ে যাবে। চীনের বৈশ্বিক প্রভাব বাড়তে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হলো তার ব্যাপক রপ্তানি ক্ষমতা এবং বিনিয়োগ নীতি। ২০২৩ সালে, চীনের রপ্তানি প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে চীনকে প্রতিষ্ঠিত করে। এর পাশাপাশি, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশে বিশাল অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে, যা চীনের বৈশ্বিক প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করছে। এই উদ্যোগটি ১৪০ টিরও বেশি দেশে চীনের অর্থনৈতিক উপস্থিতি ও প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করেছে।
রাশিয়া, আরেকটি ব্রিকস সদস্য, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরেও নিজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। ২০২২ সালের ইউক্রেন যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তারা আশা করেছিল যে এই নিষেধাজ্ঞাগুলি রাশিয়ার অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেবে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং, রাশিয়া তেলের রপ্তানি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে অর্থনৈতিক শক্তি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ২০২৩ সালে রাশিয়ার তেল রপ্তানি ছিল প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার, যা নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়াকে তার আর্থিক সামর্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। বিশেষ করে চীন এবং ভারতের মতো ব্রিকস সদস্যরা রাশিয়ার তেল ক্রয় অব্যাহত রেখেছে, যা রাশিয়ার অর্থনীতিকে আরও স্থিতিশীল করেছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলি প্রায়শই ব্রিকসের মতো শক্তিশালী জোটগুলোর জন্য কার্যকর নয়। রাশিয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর, পশ্চিমা দেশগুলি ভেবেছিল রাশিয়ার অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং বিশ্ব মঞ্চে তার প্রভাব কমবে। তবে বাস্তবে, রাশিয়া বিকল্প বাজার এবং মিত্র খুঁজে পাওয়া সহ তার অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত শক্তি বজায় রেখেছে। ব্রিকস সদস্যরা একে অপরের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়িয়েছে, যা পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে প্রায় অর্থহীন করে তুলেছে। ভারতের অর্থনীতিও দ্রুত বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে এটি একটি প্রধান বৈশ্বিক শক্তি হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে, ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম, এবং এর প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের উপরে। ভারত তার আইটি শিল্প, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, এবং বিপুল জনসংখ্যার কারণে বৈশ্বিক বাজারে দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে। এটি শুধু যে অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হচ্ছে তা নয়, বরং এর সামরিক এবং কৌশলগত প্রভাবও বাড়ছে। ভারতের এই দ্রুত উত্থান ব্রিকস-এর শক্তিকে আরও বাড়াবে এবং G7-এর প্রভাবকে পেছনে ফেলতে সহায়তা করবে। ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রিকস-এর অন্য দুই সদস্য, তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৌশলগত অবস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ব্রাজিল, বিশ্বের বৃহত্তম কৃষি উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি এবং তার বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, আফ্রিকার অর্থনৈতিক কেন্দ্রে অবস্থিত, যেখানে বহু দেশ বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যের জন্য নির্ভরশীল। এই দেশগুলো ব্রিকস জোটের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তি বাড়াচ্ছে এবং ভবিষ্যতে পশ্চিমা অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় নামবে।
ব্রিকস জোট ধীরে ধীরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা মিলে এই জোট পশ্চিমা অর্থনৈতিক কাঠামোর বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তন, বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধের পর, ব্রিকসের ভূমিকা এবং প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই জোট ডলার নির্ভরতা কমিয়ে একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে উদ্যোগী। ভবিষ্যতে, ব্রিকস বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে এবং পশ্চিমা আধিপত্যের বিকল্প হিসেবে বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।