সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিপীড়ন একটি দীর্ঘদিনের বাস্তবতা, যা প্রায়শই সংখ্যালঘুদের দুর্বলতার কারণে ঘটে থাকে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে, যেখানে ধর্মীয় বৈচিত্র্য রয়েছে, এই নিপীড়ন বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পায়। একটি নির্দিষ্ট উদাহরণ হলো দুর্গাপূজা বা অন্যান্য হিন্দু ধর্মীয় উৎসবের সময় অন্য ধর্মাবলম্বীদের আমন্ত্রণ করে সঙ্গীত পরিবেশন করার ঘটনা, যা মাঝে মাঝে সমস্যার সৃষ্টি করে। ধর্মীয় উৎসবগুলো একটি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতীক। এসব উৎসব পালনে সেই ধর্মের অনুসারীদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে উপযুক্ত। কিন্তু যখন বাইরের কেউ সেই উৎসবের সাথে জড়িয়ে পড়ে, তখন অনেক সময় সাংস্কৃতিক মিশ্রণ বা ভুল বোঝাবুঝির কারণে বিরোধ সৃষ্টি হয়। দুর্গাপূজা হিন্দু ধর্মের অন্যতম পবিত্র ও প্রধান উৎসব, যা দেবী দুর্গার আরাধনা এবং ধর্মীয় ভক্তির মাধ্যমে উদযাপিত হয়। সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি দুর্গাপূজার মণ্ডপে ইসলামী গান পরিবেশনের ঘটনা অনেকের মনে অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। এই ধরনের একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবে ভিন্ন ধর্মের গান পরিবেশিত হওয়ায় অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দুর্গাপূজা শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটি হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতির অঙ্গ। তাই এই ধরনের অনুষ্ঠানগুলিতে হিন্দু ধর্মের নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিটি ধর্মেরই নিজস্ব পবিত্রতা ও রীতি রয়েছে। দুর্গাপূজা যেমন হিন্দুদের একটি ধর্মীয় আচার, তেমনি এর পবিত্রতা বজায় রাখা সকলের দায়িত্ব। এই পবিত্র পরিবেশে ভিন্ন ধর্মের কোনো সংস্কৃতি বা সংগীত মিশ্রণ ঘটালে তা অনেকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে। এই ঘটনার জন্য দায়ী কারা, তা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। পূজা কমিটি বা স্থানীয় প্রশাসন, যারা এই অনুষ্ঠানের আয়োজন ও তত্ত্বাবধান করে, তাদের আরও সংবেদনশীল ও সচেতন হতে হবে। কোনো ধর্মীয় উৎসবে যাতে তার নিজস্ব পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ না হয়, সেই বিষয়টিও নজরে রাখা প্রয়োজন। ধর্মীয় সম্প্রীতি মানে একে অপরের ধর্মকে সম্মান জানানো, তবে তার অর্থ এই নয় যে এক ধর্মের আচার অনুষ্ঠানে অন্য ধর্মের চর্চা মিশিয়ে ফেলা হবে। সবার ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আচার-অনুষ্ঠান পালনে আমাদের আরও যত্নবান হওয়া উচিত। যারা অসৎ উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে ধর্মীয় শ্রদ্ধা ও ঐক্য নষ্ট করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনসহ সমাজের সকল শুভ-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে একত্রিত হয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে হবে। পাশাপাশি, এই অসৎ উদ্দেশ্য ধারণকারীদেরকে বিচার ব্যবস্থার আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
বিশ্বের অনেক স্থানে যখন হিন্দুরা তাদের দুর্গাপূজা উদযাপন করে, আমরা প্রায়ই দেখতে পাই যে কিছু মানুষ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এমন কিছু কার্যক্রমে লিপ্ত হচ্ছে যা পূজার মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। যেমন, ধর্মীয় গানের পরিবর্তে অনুপযুক্ত বা অশ্লীল গান বাজানো, মদ্যপান করা, এবং এমন নাচ বা আচরণ প্রদর্শন করা যা তরুণ প্রজন্মের জন্য অপ্রতুল ও ক্ষতিকর হতে পারে। এছাড়াও, অনেক সময় হিন্দু ধর্মের বাইরের ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করে তাদের দিয়ে বক্তব্য রাখানো হয়, যেখানে মূলত ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন, অভিজ্ঞ এবং জ্ঞানী হিন্দু ব্যক্তিদের বক্তব্য রাখার প্রয়োজন ছিল। এই ধরনের নেতিবাচক পরিণতির মূল কারণ হলো উৎসব উদযাপনের সময় নিজেদের ধর্মীয় আদর্শ ও মূলনীতি থেকে বিচ্যুতি। যারা এই ধরনের অনুপযুক্ত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তারা আসলে তাদের নিজের ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে না বা সেই মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে। উদাহরণস্বরূপ, পূজার সময় মদ্যপান এবং অশ্লীল নাচ শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে অবমাননা করে না, এটি সামাজিকভাবে অনুপযুক্ত এবং তরুণদের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এছাড়াও, বাইরের ব্যক্তিদের দ্বারা পূজার আসরে বক্তৃতা দেওয়াও একটি বড় সমস্যা হতে পারে। বাইরের লোকেরা হয়তো হিন্দু ধর্মের গভীর জ্ঞান না থাকার কারণে সঠিক ভাবে দর্শন বা নীতি উপস্থাপন করতে পারে না, যা ভুল বোঝাবুঝি বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। এইসব সমস্যার মূল কারণ হলো, যারা এই অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজন করে, তারা হয় নিজেদের ধর্মীয় জ্ঞান থেকে দুর্বল, বা তারা পূজার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে উৎসবকে একটি সামাজিক উদযাপন হিসেবে বিবেচনা করছে, যেখানে ধর্মীয় আবেগের চেয়ে আনন্দ-উল্লাসের প্রাধান্যই বেশি। এই সমস্যাগুলোর সমাধান আসলে উৎসের দুর্বলতা থেকে আসে। যখন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের নিজেদের ধর্মীয় বিধান ও মূলনীতি সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন হবে এবং পূজার প্রকৃত উদ্দেশ্যকে গুরুত্ব দেবে, তখন এই ধরনের নেতিবাচক কার্যকলাপ হ্রাস পাবে। পূজা উদযাপনের সময় ধর্মীয় আদর্শ ও শুদ্ধতার উপর জোর দিলে এই ধরনের সমস্যাগুলোর প্রতিকার সম্ভব।
দুর্গা পূজা বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। এই পূজা দেবী দুর্গার বিজয়, মঙ্গল এবং অসুরদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক শক্তির প্রতীকী রূপে পালন করা হয়। তবে বিগত কয়েক দশকে, দুর্গা পূজা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এর ফলে ধর্মীয় শুদ্ধতার ধারণাটি কোথাও যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। দুর্গা পূজা মূলত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান হিসেবে পালন করার কথা। দেবী দুর্গার পূজার উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় আনুগত্য, শুদ্ধতা এবং আধ্যাত্মিক চেতনা বজায় রাখা। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে পালিত হওয়া উচিৎ, যেখানে মানুষ দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানায়, এবং ধর্মীয় বিধিবিধান অনুসরণ করে। ধর্মীয় শুদ্ধতা মানে হচ্ছে আচার-বিধান মেনে, সঠিক নিয়মে পূজা করা। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, পূজার আয়োজনের সঙ্গে সামাজিক ও বিনোদনমূলক কার্যক্রম যেমন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাচ, গান, মেলা, এবং আনন্দ-যাত্রা মিশে গেছে। এটি মূল ধর্মীয় মানসিকতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে, দুর্গা পূজার এ ধরনের সামাজিকীকরণ ধর্মীয় শুদ্ধতার ক্ষতি করছে। অনেক সময় ধর্মীয় আচার ও পূজার মূল উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে, আমরা উৎসবের আনন্দকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। যদিও সামাজিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক আয়োজন মানুষের মধ্যে ঐক্য ও মিলনের বার্তা দেয়, তবে দুর্গা পূজার ধর্মীয় শুদ্ধতা রক্ষা করা আবশ্যক।
প্রকৃতপক্ষে, ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে সামাজিকতার মিশ্রণ অবশ্যই খারাপ নয়, তবে তা এমনভাবে হওয়া উচিৎ যাতে ধর্মীয় মূল্যের হানি না ঘটে। পূজার মূল আচার-বিধান, উপাচার ও প্রার্থনা যেন ঠিকমতো পালিত হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের উচিত পূজার ধর্মীয় দিকটিকে অগ্রাধিকার দেয়া, এবং যথাযথ নিয়ম ও শুদ্ধতার সাথে পূজা অনুষ্ঠান পালন করা। এছাড়াও, পূজা উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আনন্দ আয়োজন অবশ্যই ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের বাইরে গিয়ে পালন করা উচিৎ। পূজার সময় পূজা মণ্ডপে উচ্চস্বরে গানের আয়োজন, নাচ কিংবা অনানুষ্ঠানিক আনন্দ-যাত্রা দেবীর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারে, যা কখনোই কাঙ্ক্ষিত নয়। দুর্গা পূজা কেবল ধর্মীয় উৎসব, এটি সামাজিক বা বিনোদনমূলক উৎসব নয়। ধর্মীয় শুদ্ধতা বজায় রেখে পূজা পালনের মাধ্যমেই আমরা দেবী দুর্গার প্রকৃত আশীর্বাদ লাভ করতে পারি। আমাদের বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উচিত পূজার ধর্মীয় শুদ্ধতা বজায় রেখে তা পালনের মাধ্যমে ধর্মীয় চেতনাকে সমুন্নত রাখা। পূজার প্রতিটি ধাপ যেমন বোধন, নবপত্রিকা প্রবেশ, সন্ধি পূজা, এবং বিসর্জন সঠিকভাবে পালন করা উচিত। এসব আচার-বিধান উপেক্ষা করে পূজা করা আসলে দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা-হীনতা প্রদর্শন করা। মণ্ডপে বিনোদনমূলক কার্যক্রম সীমিত করা উচিত, কারণ এগুলো পূজার ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পূজার মণ্ডপে শান্তিপূর্ণ ও ধর্মীয় পরিবেশ বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
তবে আজকের দিনে অনেক ক্ষেত্রে দুর্গা পূজাকে কেবলমাত্র ধর্মীয় উৎসব হিসেবে না দেখে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে দেখা হচ্ছে। মণ্ডপ সাজানো থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন, সব কিছুতেই ধর্মীয় চেতনার চেয়ে সামাজিক দিকগুলো বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, দুর্গা পূজার সময় বহু মণ্ডপে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, উচ্চস্বরে গান বাজানো, বিভিন্ন বিনোদনমূলক আয়োজন করা হয়। যদিও এগুলো একদিকে মানুষের মধ্যে আনন্দ দেয়, কিন্তু অন্যদিকে পূজার ধর্মীয় শুদ্ধতার ক্ষতি করে। ধর্মীয় শুদ্ধতার সাথে সামাজিকতা মিশ্রিত হওয়ার একটি উদাহরণ হলো, পূজার সময় অনেক জায়গায় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অতিরিক্ত উপস্থিতি। পূজার মণ্ডপে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বক্তব্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির কথা উঠে আসে। যদিও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, কিন্তু দুর্গা পূজার মতো ধর্মীয় উৎসবে এর জায়গা কতটা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ধর্মীয় শুদ্ধতা এবং আচার পালনে পুরো মনোযোগ দেওয়া উচিত, যাতে এই ধর্মীয় উৎসব শুধুমাত্র একাত্মতার মাধ্যমে দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন হয়, অন্য কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়। রাজনৈতিক বক্তব্য বা সামাজিক আয়োজনকেও পূজার ধর্মীয় আচার থেকে আলাদা রাখা উচিত। ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পূজা কোনো রাজনৈতিক বা বিকৃত সংস্কৃতির মঞ্চ নয়। ধর্মীয় গান এড়িয়ে, যে সব গান ও উগ্র নাচানাচির মাধ্যমে পূজার শুদ্ধতা ব্যাহত হয়, সেগুলি করা উচিত নয়। তাই পূজার সময় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে মনোযোগ দেওয়া উচিত এবং সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে পূজাকে দূরে রাখা প্রয়োজন।
আমরা যারা বিদেশে বসবাস করছি দেশের মতো হয়তো পুজোর আনন্দ উপভোগ করতে পারি না কিন্তু শতো ব্যস্ততার মাঝেও মাকে বরন করে নেওয়ার মাঝে যেন কোন ক্লান্তি নেই, বরং সম্প্রীতি, ভালোবাসা, আনন্দ আর প্রশান্তির ডালি সাজিয়ে মাকে নিয়ে কি এক শ্রাবস্তীর নান্দনিকতায় মেতে থাকি বছরের এই শারদীয় মাসটিতে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই নানা পরিসরে দুর্গা পূজা পালিত হয়। লন্ডনে, কয়েকটি দুর্গা পূজার বয়স এখন ৩৫ বছরের বেশি। কলকাতার দুর্গাপূজা এই উৎসবের কেন্দ্রস্থল হলেও লন্ডনের দুর্গাপূজাও সমান বিখ্যাত এবং দিন দিন উৎসবের মাত্রাটাও বেড়েই চলেছে। প্রতি বছরের মতো এবারও লন্ডনের অনেক বাঙালি সম্প্রদায় এই অনুষ্ঠানটি আনন্দের সাথে এবং ঐতিহ্যবাহী উপায়ে উদযাপন করেছে। সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছু বদলেছে। বেড়েছে বাঙ্গালী পরিবারের সংখ্যা। এখন পূর্ব লন্ডনেই বাংলাদেশীদের আয়োজনে পনেরটিরও বেশী পূজা হয়। পুজোর সময়ে পূর্ব লন্ডনের চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে অক্টোবরের শীতল ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকাটিকে তখন বাংলাদেশের কোন এক ছোট্ট শহরের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কতো না দল বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে কাঁসা আর ঢাকের বাদ্যে আন্দোলিত হয়েছিলাম। পূজা দেখার কি এক অনবদ্য শারদীয় আনন্দ।
কিন্তু সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, লন্ডনসহ বিভিন্ন স্থানে দুর্গাপূজার আয়োজনকে কেন্দ্র করে এক ধরনের অপসংস্কৃতির চর্চা বেড়ে চলেছে। দুর্গাপূজা, যা মূলত একটি পবিত্র ধর্মীয় আচার এবং ভক্তিমূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যম, তা এখন অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ আওয়াজের গান, ডিজে, এবং নাচানাচির উৎসবে পরিণত হচ্ছে। এই ধরনের আচরণ অনেকের কাছে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পরিপন্থী বলে মনে হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, যারা এই ধরনের আয়োজন করে, তারা কি সত্যিই দুর্গাপূজার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব বুঝতে অক্ষম, নাকি তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এই পবিত্র আচারকে বিনোদনের উৎসবে পরিণত করতে চায়? দুর্গাপূজা দেবী দুর্গার প্রতি ভক্তি, শৃঙ্খলা ও আন্তরিক প্রার্থনার একটি মূর্ত প্রতীক। এতে উচ্চ আওয়াজে গান-বাজনা এবং নাচানাচির কোনো স্থান নেই। দেবীর প্রতি ভক্তি প্রকাশে শাস্ত্রসম্মত পূজা এবং ধ্যান-প্রার্থনাই প্রকৃত পথ। এখানে আসলে দুটি বিষয় হতে পারে— একদিকে হয়ত আয়োজকদের একাংশ ধর্মীয় ভাব-গম্ভীরতা এবং পূজার আধ্যাত্মিক দিক সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখেন না, অন্যদিকে কেউ কেউ হয়ত এই ধরনের অনুষ্ঠানকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। তবে বাস্তবে, এই ধরনের কর্মকাণ্ড পূজার মূল আদর্শ এবং আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে বিরোধী। পূজা মানে শুধুই আনন্দ-উল্লাস নয়, এটি ধর্মীয় ভাব, ভক্তি ও নীরব প্রার্থনার সময়। যদি কেউ এই ধরনের আয়োজন করে থাকে, তাদের কাছে পূজার প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য তুলে ধরা প্রয়োজন। দুর্গাপূজার অন্তর্নিহিত অর্থ হলো ভক্তির মাধ্যমে আত্মার শুদ্ধি এবং সামাজিক সম্প্রীতি, যা শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাই পূজার পরিবেশ যেনো পবিত্র এবং আধ্যাত্মিক থাকে, সেই বিষয়ে পূজা আয়োজকদের আরও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।
অপসংস্কৃতির চর্চার এই প্রবণতা শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর পবিত্রতাকে ক্ষুণ্ণ করছে না, বরং ভক্তদের মধ্যে বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি করছে। আমাদের উচিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মুল উদ্দেশ্যকে সঠিকভাবে অনুধাবন করে সেই অনুযায়ী পূজার পরিবেশ তৈরি করা, যাতে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় থাকে এবং এর সঙ্গে জড়িত আধ্যাত্মিকতা প্রজ্বলিত হয়। আমরা আমাদের যুব সমাজকে কি শিক্ষা দিচ্ছি, তা নিয়ে চিন্তা করা জরুরি। বর্তমান সময়ে অনেক তরুণ ও শিশুদের মধ্যে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে—অনেকে উচ্চ শব্দ এবং অপসংস্কৃতির পরিবেশে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিকে মিশিয়ে ফেলছে। আমি নিজে বেশ কিছু ঘটনা দেখেছি যেখানে শিশু-কিশোরেরা দুর্গাপূজার সময় উচ্চ আওয়াজের গান বাজানোর কারণে কান বন্ধ করে থাকে, বা কেউ কেউ এ সব গান শোনার মধ্যে মনোযোগ দিচ্ছে। এটি সত্যিই উদ্বেগের বিষয় যে, এই প্রজন্মের তরুণরা দুর্গাপূজার সঙ্গে যেসব সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চেতনাকে পরিচিত হওয়া উচিত, তা থেকে তারা দূরে সরে যাচ্ছে। তারা হয়তো মনে করতে শুরু করছে যে, দুর্গাপূজা মানে শুধুমাত্র ডিজে গান ও নাচের অনুষ্ঠান। কিন্তু দুর্গাপূজার প্রকৃত অর্থ হলো দেবী দুর্গার আরাধনা, ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ। যুব সমাজ যদি এই ধরনের অপসংস্কৃতির মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে, তাহলে তারা আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে অবগত হবে না এবং এর গুরুত্ব বোঝার সুযোগ হারাবে। আমরা যদি শিশুদের কাছে দুর্গাপূজার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য তুলে ধরতে না পারি, তাহলে তারা ভবিষ্যতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রতি আরও বিমুখ হয়ে পড়বে। আমাদের উচিত তাদের সঠিকভাবে শিক্ষিত করা, যাতে তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিকে শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে না দেখে, বরং সেগুলির গভীর অর্থ, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে উপলব্ধি করতে পারে। ধর্মীয় উৎসবগুলো যেন তাদের মধ্যে ভক্তির অনুভূতি সৃষ্টি করে, তা নিশ্চিত করতে আমাদের সচেতনভাবে কাজ করতে হবে।