আমরা যারা বিদেশে বসবাস করছি দেশের মতো হয়তো পুজোর আনন্দ উপভোগ করতে পারি না কিন্তু শতো ব্যাস্ততার মাঝেও মাকে বরন করে নেওয়ার মাঝে যেন কোন ক্লান্তি নেই, বরং সম্প্রীতি, ভালোবাসা, আনন্দ আর প্রশান্তির ডালি সাঁজিয়ে মাকে নিয়ে কি এক শ্রাবস্তীর নান্দনিকতায় মেতে থাকি বছরের এই সারদীয় মাসটিতে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই নানা পরিসরে দুর্গা পূজা পালিত হয়। তবে এই বছরের আনন্দ আর আয়োজনের মাত্রাটা যেন অন্যরকম ছিলো। ইউনেসকো কলকাতার দূর্গা পূজাকে গতবছর (২০২১) সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত করেছে। তিন শতাব্দীরও বেশী বয়সী পুরনো শহর কলকাতা এবং পশ্চিম বঙ্গের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসবের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে এই বছর পূজোর আমেজটা ছিলো ভিন্ন মাত্রার এবং পূজোর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার বিলেতেও ধুমধাম করে এই দুর্গা পূজা পালিত হয়। লন্ডনে, কয়েকটি দুর্গা পূজার বয়স এখন ৩৫ বছরের বেশি। কলকাতার দুর্গাপূজা এই উৎসবের কেন্দ্রস্থল হলেও লন্ডনের দুর্গাপূজাও সমান বিখ্যাত এবং দিন দিন উৎসবের মাত্রাটাও বেড়েই চলেছে। প্রতি বছরের মতো এবারও লন্ডনের অনেক বাঙালি সম্প্রদায় এই অনুষ্ঠানটি আনন্দের সাথে এবং ঐতিহ্যবাহী উপায়ে উদযাপন করেছে। শুধু তা নয়, এই প্রথম বারের মতো টেমসে একটি দুর্গা প্যারেড অনুষ্ঠিত হলো, অনেকটা কলকাতার দুর্গা পূজা কার্নিভালের মতোই। গ্লোবাল হেরিটেজ বেঙ্গল আয়োজনে এই প্যারেডটি, নৌকায় করে ওয়েস্টমিনস্টার, লন্ডন আই, সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল, লন্ডন ব্রিজ, টাওয়ার ব্রিজ ঘুরে পূজো মন্ডপে ফিরে আসে। কলকাতার দুর্গাপূজাকে বিশ্বব্যাপী পর্যটন গন্তব্য হিসেবে প্রচার করার জন্যই মূলতঃ এ বিশেষ থেমস প্যারেডের আয়োজন।
লন্ডনে কয়েকটি উল্লখযোগ্য পূজা আয়োজককারীদের মধ্যে আছে লন্ডন ক্যামডেন দুর্গা পূজা, যুক্তরাজ্যে পঞ্চমুখী দুর্গাপূজা, উইম্বলডন কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন, সনাতন বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন, পামার্স গ্রীন ইউকে, লন্ডন বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন দুর্গা পূজা অর্পিংটন, হিন্দু প্রগতি সংঘ মন্দির, হাউন্সলো লন্ডনে প্রবাসী দুর্গাপূজা, লন্ডন শারদ উৎসব - বেঙ্গল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, স্পন্দন– ক্রয়ডন বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন দুর্গাপূজা, লন্ডন দুর্গা পূজা দশেরাহ সমিতি, সনাতন অ্যাসোসিয়েশন লন্ডন (বাংলাদেশীদের আয়োজনে সবচেয়ে পুরাতন দূর্গা পূজা), সার্বজনীন বাবা লোকনাথ এসোশিয়েশন, লন্ডন। এ দেশে আসার পর নব্বইর দশকের প্রথম দিকে সনাতন এসোশিয়েশন আয়োজিত দূর্গা পূজায় যেতাম, আনন্দের মাত্রাটা ছিলো অন্যরকম। কেমন জানি দেশীয় সারদীয় আশ্বিনি গন্ধ এবং আনন্দের স্ফুলিঙ্গ চোখে মুখে দৃশ্যমান ছিলো। পুরো ইষ্ট লন্ডন জুড়ে সম্ভবত এই পূজোটিই হতো। তখন মনে হতো পূজোটা ছিলো সর্বজনীন। সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছু বদলেছে। বেড়েছে বাঙ্গালী পরিবারের সংখ্যা। এখন পূর্ব লন্ডনেই বাংলাদেশীদের আয়োজনে পনেরটিরও বেশী পূজা হয়। পুজোর সময়ে পূর্ব লন্ডনের চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে অক্টোবরের শীতল ঠান্ডা আবহাওয়ায় বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকাটিকে তখন বাংলাদেশের কোন এক ছোট্ট শহরের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কতো না দল বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে কাঁসা আর ঢাকের বাদ্যে আন্দোলিত হয়েছিলাম। পূজো দেখার কি এক অনবদ্য শারদীয় আনন্দ।
এই শতাব্দীর শুরু থেকে লন্ডনে প্রবাসী বাঙালি জনসংখ্যা ক্রমাগতভাবে বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্নায়ুকেন্দ্র বিদেশে বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসবের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। লন্ডনে দুর্গা পূজার বৃদ্ধিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন এবং এর লন্ডন শারদ উৎসব। তবে এখানে উল্লেখ করা অবশ্যই প্রয়োজন যে বিলেত প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে সনাতন এসোশিয়েশনই দূর্গা পূজার আয়োজনে প্রথম উদ্যোগ নেয়। গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে আরেকটি সংগঠন সর্বজনিন এই দূর্গাৎসবকে প্রবাসী বাংলাদেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে নিয়ে আসে এক নতুন মাত্রা। শুধু দুর্গা পুজোই নয়। হিন্দুদের প্রতিটি পুজোই বিধান মেনে নিয়মিত করা সহ মাসিক ধর্মীয় আরাধনার আয়োজন করে। কোন ধর্ম, গোত্র বা পটভূমি নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকে এই সব পুজোয়। দুর্গা পূজার দিনগুলিতে ভক্তরা শান্তি, সমৃদ্ধি কামনা করে দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা করেন।
দুর্গাপূজা হল মূলতঃ বাঙ্গালী হিন্দুদের একটি বার্ষিক উৎসব যা অসুর রাজা মহিষাসুরের উপর দেবী দুর্গার বিজয়কে সারা ভারত জুড়ে অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণভাবে উদযাপিত হয়। এই হিন্দু উৎসবের মাহাত্ম্য এবং ব্যাপকতা এখন সাড়া বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। বেশ আড়ম্বরের সাথে নানা সাঁজে এই পুজোটি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদির মতো বিশাল ভারতীয় প্রবাসী দেশগুলিতেও উদযাপিত হয়। উৎসবটি সারদীয়া নবরাত্রি নামেও পরিচিত এবং হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে আশ্বিন মাসে পালন করা হয় যা সাধারণত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মধ্যে পড়ে। দুর্গা পূজা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা ভাবে উদযাপিত হয়, তবে সব অঞ্চলের পূজোতেই উপাসনার আচার, ভোজন, সঙ্গীত এবং নৃত্যের সংপৃক্ততা থাকে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশায়, যেখানে এটি বিশেষভাবে জনপ্রিয়, অস্থায়ী মাটির কাঠামো দিয়ে বাননো হয় যেখানে দেবী দুর্গার সাথে তার চার সন্তান গণেশ, কার্তিকেয় (দেবসেনার সেনাপতি), সরস্বতীর (শিক্ষার দেবী) এবং লক্ষ্মী (সম্পদের দেবী) প্রতিমূর্তি স্থাপন করা হয়। পুজোর দিনগুলিতে পুষ্পাঞ্জলি নামে পরিচিত বিশেষ নৈবেদ্য দেওয়ার জন্য উপাসকরা এই প্যান্ডেলগুলিতে ভিড় করে। যদিও হিন্দুদের শরৎকালের এই পুজোটি কবে শুরু হয় তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও মাতৃ পূজার প্রচলন ভারতে মাতৃতান্ত্রীক দ্রাবির জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ছিল। অনার্য সভ্যতায় দেবীদেরকে বেশ প্রাধান্য দেওয়া হতো। অন্যদিকে দেবতাদের প্রাধান্য ছিলো আর্য সভ্যতায়। কৃঞ্চ ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরান মতে কৃঞ্চ ছিলেন শরৎকালীন দূর্গা পূজার প্রথম প্রবর্তক। মূল বাল্মিকীর রামায়নে কিন্তু আমরা এই দুর্গা পূজার কোন হদিস খুঁজে পাই না তবে কৃত্তিবাসের রামায়নে উল্লেখ আছে যে শ্রী রামচন্দ্র ১০১টি নীল পদ্ম দিয়ে সাগর কূলে বসে সীতা উদ্ধারের জন্য বসন্তকালে বাসন্তী পূজা বা অকালবোধন করেছিলেন। মারকেন্দ পুরানেও উল্লেখ আছে যে চেদী রাজবংশের রাজা সুরাথা দসেরা দুর্গা পূজার প্রচলন করেছিলেন কলিঙ্গে। দুর্গা পূজার অস্তিত্ব মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যেও পাওয়া যায়। তবে আধুনিক কালের দুর্গোৎসব বাংলায় মুঘল শাসনামলে সম্রাট আকবরের নেতৃত্বে বিশাল রাজকীয় শোভাযাত্রার সাথে শুরু হয়েছিল এবং অন্যান্য আঞ্চলিক রাজারা যেমন আহমেদাবাদের সুবিন রাজবংশ এবং মারাঠা রাজ্যের ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সেই শোভাযাত্রায়। স্বাধীনতার পর, নেহরু পরিবার সহ অনেক রাজনৈতিক নেতা এই ঘটনাবহুল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন নানাভাবে যা এখন জাতিধর্মকে অতিক্রম করে একটি জাতীয় এবং বিশ্ব পর্যায়ের উদযাপনে পরিণত হয়েছে, ইউনেস্কোর স্বীকৃতির মাধ্যমে তা আরো দৃশ্যতঃ হলো।
হিন্দু ধর্মে অনেক দেবী আছে, কিন্তু দেবী দুর্গার পূজ্যতার প্রাধান্যই একটু বেশী। তিনি শক্তি এবং দৃঢ়তার মূর্ত প্রতীক। দেবী দুর্গা গণতন্ত্র, ন্যায়পরায়ণতা এবং বৈচিত্র্যেরও প্রতীক। এমন একটি বিশ্বে আমরা বসবাস করছি যা প্রায়শই অন্যায়, দূর্বৃত্তায়ন, অপরাধ এবং অশুভ শক্তির উন্মাদনায় পরিপূর্ন। দেবী দূর্গা সবার জন্য আশা এবং ন্যায়বিচারের প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উৎস। তিনি বৈষম্যহীন এবং শান্তিকামী। গণতন্ত্রের এটাই হওয়া উচিত – জাতি, ধর্ম বা ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য সমতা। এমন এই নশ্বর বিশ্ব প্রায়শই জাতি, ধর্ম এবং জাতিগত বেষম্য দ্বারা বিভক্ত। দেবী দুর্গা আমাদের মনে করিয়ে দেন যে আমরা সবাই এক মানব পরিবারের সদস্য। আমরা বাইরে থেকে আলাদা হতে পারি, কিন্তু আমরা সবাই একই আশা এবং স্বপ্নকে ধারন, লালন এবং পালন করি। দুর্গা দেবীর পূজা হয়ে উঠুক আমাদের মানবতা, ন্যায়বিচার ও শান্তির প্রতিক। হিন্দুধর্মে, তাকে সর্বোচ্চ শক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয় কারন তিনি ঐশ্বরিক নারীত্বের সমস্ত দিককে প্রতিনিধিত্ব করেন।
প্রতিবছরের মতো বিলেতের বিভিন্ন শহরে যেখানে বাঙ্গালীদের বসবাস রয়েছে সেখানেই মা দূর্গাকে বরন করে নেওয়ার জন্য পাঁচ দিনব্যাপী বেশ ধুমধামের সাথে দুর্গাৎসব পালন করা হয়েছে। বিদেশের কর্মব্যস্থতার মাঝেও এ যেন হয়ে উঠেছিলো আনন্দ আর উৎসবে মেতে উঠার এক মহা মিলনমেলা। মাকে ঘিরে সন্তানদের এ যেন এক শ্রাবস্তীয় ভালোবাসার উচ্চসিত উল্লাস আর উদ্দীপনা। তবে পূর্ব লন্ডনের বাঙ্গালী এলাকার দুর্গা পূজোগুলিতে ছিলো সবচে বেশী উপচেপড়া দর্শনাত্রীদের ভীড় আর উৎসবের আনন্দধারা। কি অনাবিল শান্তি আর সাম্যের নিবীরতায় মা দেবীর কাঠামোতে সংপৃক্ত আছেন দেবীর সন্তানেরা আর অসুর শক্তি মহিষাসুর এবং শিব, আর দৃপ্ততার সাথে ধরে আছেন ধনুক, ত্রীশুল, শঙ্খ এবং ঘন্টা সহ নানা ধরনের অস্ত্র। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর তেজস্বীনি প্রকৃতির দেবী সাকম্বরী মা যেন বিশ্ব মৈত্রী আর প্রগতীর অগ্রদূত। জাতী, ধর্ম, বর্ন, গোত্র নির্বশেষে সবাই মিলে মিশে মায়ের চরনে অঞ্জলী নিবেদন করা থেকে শুরু করে ষষ্ঠী থেকে বিজয়ার দশমী পর্যন্ত মহাসমারোহে পূর্ব লন্ডনের বাঙ্গালী পাড়ায় এবার ভিন্ন মাত্রায় দুর্গা পূজা উদযাপিত হয়েছে। সার্বজনিন বাবা লোকনাথ এশোসিয়শনের আয়োজনের দূর্গাৎসবটি ছিলো মনোমুগ্ধকর। নানা আয়োজনে সাঁজানো হয়েছিলো প্রতিটি দিনকে। শিশু কিশোরদেরকে ধর্মীয় এবং নৈতিক মানবিক বিকাশের জন্য রাখা হয়েছিলো বেশ কিছু অনুষ্ঠান যা দুর্গা পূজার মাহার্ত্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে নিয়ে যাওয়ার এক চমৎকার উদ্যোগ। যা ছিল শিশু কিশোরদের প্রেরনার এক অনবদ্য সংযোজন। অন্যদিকে অঞ্জলী, আরতী, আর মন্ত্রোচ্চারনের সাথে কাঁসা, শঙ্খ, আর দ্রুপদীয় তালে ঢাকের বাদ্যের সাথে ধর্মীয় উৎসবের গভীর চেতনাকে ধারন এবং পালন করার এক চমৎকার পরিবেশ তেরী করা হয়। আর উৎসবকে কানায় কানায় পূর্ন করার জন্য ছিলে মনমাতানো সংগীত, নৃত্য আর মহিষসুর মর্দীনির প্রানবন্ত উপস্থাপনা। জীবনের সব ক্লান্তি আর ক্লেদাক্ত গ্লানি যেন এক অনিন্দ সুন্দর শুভ্র শীতল অলকানন্দার জলে আর মা দূর্গার ঐশ্বরিক আশির্বাদে ধুয়ে মুছে যায়। শুদ্ধতায় আর ভালোবাসায়, সাম্য আর সৌভাত্রে, দৃঢ়তা আর সৌহাদ্রতার বন্ধনের মহামিলনে পরিনত হয় পূজামন্ডপ। মা দুর্গার শান্তির বানী ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বব্যাপী, এই আমাদের প্রত্যাশা।