'এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে'- কে না শুনেছে এই কাব্যপংক্তিটি। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি এই কবিতাটি। মেঘনাদ বধ কাব্যে থেকে নেয়া। এই কাব্যপঙ্ক্তি বাঙালি সমাজের জনপরিসরে বহুল উচ্চারিত। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিরচিত মহাকাব্য 'মেঘনাদবধ' । রাবনপুত্রের হাহাকার মিশ্রিত এই উপলদ্ধি বাঙালী সমাজের আনাচে-কানাচে, ঘর-গেরস্থালীতে কিংবা সামাজিক পরিমন্ডলে এক প্রাঞ্জল প্রবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মহাকাব্যের রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত। রামায়ন উপাখ্যান অবলম্বনে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত মেঘনাদবধ কাব্যটি ছিলো মধুসূদন দত্তের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। তিনি ১৮২৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি বৃটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত বাংলা প্রদেশে (বর্তমানে বাংলাদেশ) যশোর জেলার কেশবপুরের কাছে সাগরদাঁড়ি নামক ছোট্ট গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত ও তার পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। তার পিতা রামনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানী আদলতের একজন খ্যাতনামা উকিল। ছোটবেলা থেকেই তিনি সাহিত্য ও কবিতা লেখার প্রতি গভীর আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে মাইকেল 'বীরাঙ্গনা' নামে তার প্রথম কবিতাটি লেখেন। পনের বছর বয়সে এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল, যা তাকে অনেক খ্যাতি ও স্বীকৃতি এনে দেয়। তার পর থেকেই শুরু হলো তার সাহিত্যে পদচারনা।
সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্ম হলেও ছোট কাল থেকেই পাশ্চাত্য সাহিত্যে ছিলো দূর্নিবার আকর্ষন মধুসূদন দত্তের। তাই ইংরেজী সাহিত্যে বেশ ভালোভাবেই মনোনিবেশ করেন। নিজের গ্রামের বাড়ী সাগরদাড়িতে মাত্র পনের বছর বয়সে স্কুলের শিক্ষা শেষ করার পর পিতা রাজনারায়ন দত্ত ছেলেকে ব্যারিষ্টার হওয়ার আশায় কলকাতার হিন্দু কলেজে ভর্তি করান। ইংরেজী পাঠ্যক্রমে মধুসূদন অধ্যায়ন শুরু করেন এবং খুব অল্প দিনের মধ্যেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় মধুসূদনের আগ্রহ বেড়ে যায়। এই কলেজটি চলতো বিলেতের মতো পরিবেশেই। পশ্চিমা পোশাক পড়া থেকে শুরু করে, খাবারের সময় ইংরেজী কায়দায় কাটলারি ব্যাবহার করা, ইউরোপীয়ান খাবার খাওয়া, পাশ্চাত। সাহিত্য-সংগীত এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠা, চলনে-বলনে প্রায় সব কিছুতেই দৃশ্যতঃ হতো পশ্চিমা শৈলী। এই হিন্দু কলেজে পড়াকালীন সময় থেকেই মধুসূদনের মধ্যে ভারতীয় এবং বাংলা সংস্কৃতির প্রতি অনিহা দেখা দেয় এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ তৈরি করেন। যা পরবর্তীতে তার জীবনকে চালিত করে এক অপ্রীতিকর গন্তব্যের দিকে যার অসহ্য প্রবাহের দাবদাহে তার শেষ বয়সের দিনগুলো এক বিষাদ আর ট্র্যাজিডীর বাতাবরনে অতিবাহীত হতে থাকে। এ যেন জীবনের প্রাপ্যতা, তাকে খন্ডাবে কি করে?
১৮৪২ সালে পিতা রাজনারায়ন যখন ছেলের বিবাহের বন্দোবস্থ করেন তখনই মধুসূদন বাঁধ সাধেন। শেষ পর্যন্ত স্ব্প্ন আর প্রাশ্চাত্যের নতুন নতুন চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের ধর্মকে ত্যাগ করে যৌবনেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহন করে মাইকেল মধুসূদন নামটি গ্রহন করেন। কিন্তু তার এই ধর্মান্তরনের কারনে সাথে সাথে নেমে আসলো সামাজিক, পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়। সমাজে সৃষ্টি হলো ব্যাপক আলোড়ন। রাগে, ক্ষোভে এবং কষ্টে পিতা রাজনারায়ন একমাত্র সন্তানকে অস্বীকার করে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষনা করেন। হঠাৎ করেই যেন এক বজ্রাঘাতে পরিবারের সবকছু লন্ডভন্ড হয়ে গেলো। মধুসূদনের জীবন যেন বিচ্যুত নক্ষত্রের মতো ছিটকে পড়লো আকাশ থেকে। কিন্তু পাশ্চাত্যের হাওয়ায় ভেসে চলা টগবগে যুবকের উদ্বেলিত প্রান সেইদিনের বিপর্যয়ে রাগ করেছিলো তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু তাঁর ভয়াবহ পরিনতিকে উপলদ্ধি করার দূরদর্শিতা এবং প্রাজ্ঞতা হয়তো ছিলো না। আর তাইতো জীবনের এক প্রান্তে এসে বেঁজে উঠে কপোতাক্ষ্যের বন্দনা এবং ফেলে আসা জীবনের আহাজারি. উপলব্ধি করলেন জন্মভূমি আর নিজের ভাষা স্বর্গের চেয়েও প্রিয়:“সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে, সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে। শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে, জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে। বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলেদুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।“
খ্রীষ্টধর্ম গ্রহনের পরও শিবপুরের বিশপস কলেজে পড়াশুনা চালিয়ে যান। পুত্রকে ত্যাজ্য করলেও পিতা রাজনারায়ন দত্ত কলেজে পড়াশুনার খরচ বহন করতে থাকেন। বিশপস কলেজে থাকাকালিন সময়ে মধুসূদন দত্ত সংস্কৃত সহ ল্যাতিন এবং গ্রীক ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। কলেজ বন্ধুদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলো মাদ্রাজি। তারাই পরবর্তীতে মধুসূদনকে নানাভাবে সহযোগীতা করে। কলেজের ডিগ্রী পাওয়ার পর অনেক চেষ্টা করেও যখন চাকরির কোন সুবিধা করতে পারলে না তখন মাদ্রাজি বন্ধুদের সহযোীতায় মধুসূদন ১৮ই জানুয়ারী ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজে চলে যান। শুরু হলো তার জীবনের নতুন এক অধ্যায়। এখানে এসেও তেমন কোন সুবিধা হলো না মধুসূদনের। অনেক চেষ্টা করেও একটি চাকুরি জোগার করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত মাদ্রাজে খ্রীষ্টান বন্ধুদের সহযোগীতায় কোন রকম চলার মতো একটি স্থানীয় ইংরেজি স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরি পান। কম বেতন থাকায় সংসারের ব্যায় সংকুলান হতো না। সেই সময়ে লিখলেন তার প্রথম ইংরেজী কাব্যগ্রন্থ দ্য ক্যাপটিভ লেডি । বইটি প্রকাশের পরপরই ইংরেজি কবি ও লেখক হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। মাদ্রাজে আসার কিছুকাল পরেই ২৪ বছর বয়সে, জুলাই মাসের ৩১ তারিখ ১৮৪৮ সালে মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে মাদ্রাজের এক মহিলা অরফান অ্যাসাইলামের এক ইংরেজ যুবতীকে বিবাহ করেন। মধুসূদন দত্ত এবং রেবেকার চারটি সন্তান ছিল। ১৮৫৫ সালে বাবার মৃত্যুর পর যখন মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন, মাদ্রাজে রয়ে যান রেবেকা। তবে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের কোন সঠিক তথ্য মেলেনি কিন্তু তার কিছুদিন পরেই আরেক ইউরোপীয় মহিলা হেনরিয়েটা সোফিয়া হোয়াইটের সাথে মধুসূদন নতুন জীবন শুরু করেন। হেনরিয়েটাই মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন।
স্বদেশে থাকাকালীন সময়ে মধুসূদন দত্ত বেশ খ্যাতি এবং যশ লাভ করেছিলেন। কিন্তু পাশ্চাত্যের ধ্যান ধারনায় নিমগ্ন উচ্চাকাঙ্ক্ষী কবি পরিতৃপ্ত হতে পারেননি। বড়ো ধরনের স্বপ্নের পসরা নিয়ে এগিয়ে চলার এক অদম্য স্পৃহায় ভাসমান ছিলেন। দূর্বার উচ্চকাঙ্খা ও অপরিতৃপ্ত বাসনা তাকে তার শৈল্পিক স্বত্ত্বাকে স্বদেশের মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলো, বেঁধেছিলো পাশ্চাত্য রীতি-নীতির বেড়াজালে। আর তাইতো কবি ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ দেশান্তরে। মাদ্রাজেও মধুসূদন তেমন কোন সুবিধা করতে পারেননি। পদে পদে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়েই চলছিলো তার মাদ্রাজী জীবন। আবারো অন্যপথে হাঁটার পরিকল্পনায় কবি যাত্রা শুরু করলেন বিলেতের উদ্দেশ্যে। ১৮৬২ সালে জুন মাসের ৯ তারিখে মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়ার মনোবাসনায় বিলেতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। কিন্তু তিনি কি কখনো ভেবেছিলেন মা-মাটি-মানুষ আর স্বদেশীয় প্রেম-ভালোবাসা আর গুরুজনদের আশির্বাদের করস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়ে ভীনদেশী আলো-বাতাসে তার পথচলা কখনোই মসৃন হবে না, বরং দুখ-কষ্ট আর বেদনায় পর্যবসিত হবে তার জীবন। সব যেনো বিধি বাম! সব কষ্টের ঢেউগুলো যেন এক সাথেই আসে এবং সব কিছুকে লন্ড ভন্ড করে দিয়ে যায়। তাই ঘটলো মধুসূদনের জীবনে। যে যশ, খ্যাতি আর আর্থিক নিরাপত্তার আশ্বাসে তিনি বিলেত যাত্রা করেন তা অচিরেই ভেঙ্গে গেলো। পরিবার এবং আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের দুয়ার বন্ধ হয়েছে অনেক আগেই। কলকাতায় তার স্ত্রী হেনরিয়েটা দুই শিশু সন্তানদেরকে নিয়ে সংসারটাকে আর সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছিলেন না। অর্থনৈতীক ভাবে একেবারে দুর্দশায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত নিত্যন্ত নিরুপায় হয়েই ১৮৬৩ সালের ২রা মে হেনরিয়েটা সন্তানদেরকে নিয়ে কলকাতা ছেড়ে বিলেতে স্বামীর কাছে এসে পৌঁছান। তার পরের ঘটনাগুলো আরো কষ্টদায়ক।
আর্থিক সমস্যা এবং জাতিগত কুসংস্কারের কারনে তিনি বেশীদিন বিলেতে থাকতে পারেননি। কম টাকায় সংসার চালিয়ে লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে পারবেন বলে তিনি সপরিবারে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চলে যান ফ্রান্সের ভার্সাইতে ১৮৬৩ সালের ১৭ জুন। নানা বাধা-বিপত্তি আর অর্থনৈতিক দূরাবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবন যুদ্ধের সংপৃক্ততা তাকে ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতি মোহভঙ্গ করে ফেলেছিল। তিনি ফ্রান্সে থাকাকালীন সময়ে এক চিঠিতে তার উপলব্ধির কথাই বন্ধু বসাককে লিখেছিলেন:“যদি আমাদের মধ্যে কেউ থাকে যে তার পিছনে একটি নাম রেখে যাওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন, এবং পাশবিকের মতো বিস্মৃতিতে চলে না যায়, সে যেন তার মাতৃভাষার জন্য নিজেকে উত্সর্গ করে। এটাই তার শেকড়,পরম বৈধ ক্ষেত্র এবং জীবন চলার সারথী” (উৎস: বৃটিশ লাইব্রেরী). ১৮৬৫ সালে তিনি ভার্সাই থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং দুঃখ কষ্টের উত্তাল বৈতরনী পার হয়ে শেষ পর্যন্ত ১৮৬৬ সালে ব্যারিস্টার হন। শেষ পর্যন্ত পারলেন না পাশ্চাত্যের জল-হাওয়ায় নিজকে ধরে রাখতে। বুঝতে পারলেন বিদেশী সংস্কৃতি-শিক্ষা, রীতি-নীতি গ্রহন করা যতো সহজ তাকে ধারন করে বেঁচে থাকা যায় না। নিজের শেকড়ের মধ্যে বিরাজিত তার স্বীয় স্বত্তা, আত্ম পরিচয়, নান্দনিক উৎকর্ষতা এবং পরম শান্তিতে বেঁচে থাকার নির্ভরতা। এই উপলব্ধি আর দুঃখ-কষ্টের বঞ্চনা থেকে নিজকে মুক্ত করার জন্য পাঁচ বছর বিদেশে থাকার পর মাইকেল মধুসূদন দত্ত অবশেষে স্বদেশে ফিরে আসেন।
“মানুষ যাহা চায় তা পায় না, আর যাহা পায় তাহা চায় না”। কবি গুরুর এই দর্শন তত্বটি কবি মধুসূদনের জীবনের এক সার্থক প্রতিফলক। কি চেয়েছিলেন, আর কি পেলেন। তার শেষ জীবনটা যেন গ্রীক নাটকের ট্র্যাজিডির মতো। খুব দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে থাকে তার দৈনন্দিন জীবন। মহাকবি জীবনের অন্তিম পর্যায়ে জন্মভূমির প্রতি তার সুগভীর ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় পংক্তিমালায়। তার সমাধিস্থলে লেখা রয়েছে সেই বিখ্যাত কবিতাটি যেখানে কবি মাইকেল নামটিকে কর্তন করে শুধু লিখলেন শ্রীমধুসূদন। এই যেন তাঁর আত্মপরিচয়, জীবন দর্শনের শেকড় :
'দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে!.........................জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি, রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী'
তিনি আবারো সদর্পে ঘোষনা করলেন পরিবার, সমাজ, স্বদেশ আর জন্মভূমির শীতল জল-হাওয়ায় বেড়ে উঠা জীবনই সবচেয়ে অমৃত। দুঃখ-কষ্ট, যশ-খ্যাতি আর বৈচিত্রতার অলি-গলিতে চলতে চলতে একদিন এই মহান কবি চলে গেলেন এই জাগতীক পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু পেছনে রেখে গেছেন মেঘনাদ বধ মহাকাব্যের মতো বিশাল এক সাহিত্য ভান্ডার। তাই তিনি বেঁচে থাকবেন হাজার বছর তার সৃষ্টির জন্য সমগ্র বাঙালীর হৃদয়ে। অম্লান হয়ে থাকবেন আমাদের চিন্তা চেতনায় আর ভাবনায়।