টেমসের তীরের নগর কাব্য -স্বামী বিবেকানন্দ- ভারতীয় যোগী যখন লন্ডনে

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন ১৯ শতকের একজন স্বনামধন্য ভারতীয় হিন্দু সন্ন্যাসী, লেখক, ধর্মীয় শিক্ষক, আধ্যাত্মিক নেতা এবং দার্শনিক যিনি পশ্চিমা বিশ্বে বেদান্ত এবং যোগের দর্শন প্রবর্তনের জন্য অতন্ত প্রশংসনীয় এবং নিরলসভাবে মানবিক কল্যানে কাজ করে গেছেন। তিঁনি আন্তঃধর্ম সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হিন্দুধর্মকে একটি প্রধান বিশ্ব ধর্মের মর্যাদায় নিয়ে আসার জন্য কৃতিত্বপ্রাপ্ত। এখন পর্যন্ত তিনি ব্যাপকভাবে আধুনিক হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হন এবং তাঁর শিক্ষা ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তাঁর দর্শন নিজের মধ্যে ঐশ্বরিক স্বীকৃতির গুরুত্বের পাশাপাশি সমস্ত ধর্মের মধ্যে সাদৃশ্যের প্রয়োজনীয়তার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল। বিবেকানন্দ ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি উৎসবের সময় কলকাতার পৈতৃক বাড়ি তিন নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম নরেন্দ্র নাথ দত্ত, কিন্তু তিনি মাত্র ১৯ বছর বয়সে যখন সন্ন্যাসীর উপাধি গ্রহণ করেন তখন নাম রাখেন স্বামী বিবেকানন্দ। কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত বাঙালি কায়স্থ পরিবারে জন্ম নেওয়া বিবেকানন্দ ছোটবেলা থেকেই ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। ছোটকাল থেকেই নরেন নামে পরিচিত স্বামী বিবেকানন্দ দশ ভাইবোনের একজন ছিলেন। তাঁর পিতা, বিশ্বনাথ দত্ত, কলকাতা হাইকোর্টের একজন অ্যাটর্নি ছিলেন। নরেন্দ্রের পিতামহ দুর্গাচরণ দত্ত ছিলেন একজন সংস্কৃত ও ফার্সি পণ্ডিত। তাঁর মা, ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ গৃহিণী। নরেন্দ্রের পিতার প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী মনোভাব এবং তার মায়ের ধর্মীয় ভাবধারা তার চিন্তা-ভাবনায় বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। যদিও শৈশবে নরেন খুব দুষ্ট এবং অস্থির প্রকৃতির ছিলেন তবে খুব অল্প বয়স থেকেই আধ্যাত্মিকতায় আগ্রহী ছিলেন। নরেনের দুষ্টমীর জন্য তাঁর মা দুঃখ করে বলতেন "আমি শিবের কাছে একটি পুত্রের জন্য প্রার্থনা করেছিলাম এবং তিনি আমাকে তার একটি রাক্ষস পাঠিয়েছেন"। কিন্তু শৈশবের পথ পেরিয়ে কৈশোরের গন্ডোলায় পা দিতে দিতেই নরেনের চিন্তা-চেতনায় আসে ঋজুতা, সৃজনশীল দর্শনিক ভাবধারা, আধ্যাত্বিকতার অমলিন নিবিরতা এবং মানবিক বলিষ্ঠতা। তাইতো তিনি ঘুরে বেড়িয়েছিলেন সারা ভারতজুড়ে, সন্ধান করেছিলেন আধ্যাত্মিক শিক্ষকদের যারা তাকে জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করতে পারে। এই সময়ে তিনি শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস সহ বিভিন্ন গুরুর অধীনে অধ্যয়ন করেছিলেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁকে প্রভাবিত করেছিলো গভীরভাবে, যিনি তাকে মানবতার প্রতি প্রেমময় সেবার গুরুত্বের তিলক পড়িয়ে দিয়েছিলেন।

 

বিবেকানন্দ ১৮৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনের উদ্দেশ্যে আমেরিকা ত্যাগ করেন এবং এক বছরেরও বেশি সময় সেখানে বসবাস করেন। তিনি হিন্দু ধর্মের একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবে লন্ডনে যাওয়ার ধারণা দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিলেন এবং মিস হেনরিয়েটা মুলার তাকে তার অতিথি হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মিঃ ই. টি. স্টার্ডি (পরবর্তীতে তাঁর একজন কনিষ্ঠ শিষ্য) এই খবরটি শুনে তাকে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ চিঠি লিখেছিলেন এবং তাঁকে তার সাথে থাকার জন্য আমন্ত্রন করেন। এই দুজনের সাথেই বিবেকানন্দের আমেরিকাতে সাক্ষাৎ হয়।  স্টার্ডি তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে লন্ডনে তার কাজের জন্য একটি ভালো জায়গা এবং তাঁর এই মহৎ কাজে সহায়তা করার জন্য তিনি প্রস্তুত। তাঁর এই সফর তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং সেই সময় তিনি যথেষ্ঠ সাফল্য অর্জন করেছিলেন।  তিনি ভারতীয় বেদান্ত দর্শনের মূল বিষয়গুলিকে নিয়ে গভীরভাবে আলোকপাত করেন। তার উপস্থিতি, কথা-বার্তা এবং বেদান্ত দর্শন নিয়ে বক্তৃতা বিপুল শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল, এমনকি রাজ পরিবারের অনেকেই তার বেশ কিছু আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। এই সময়কালে, বিবেকানন্দ প্রাচ্যাত্যের বিভিন্ন সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের সংস্পর্শে এসেছিলেন যা তার আধ্যাত্মিক বিকাশকে এগিয়ে নিয়েছিল। ১৮৯৫ সালে স্বামী বিবেকানন্দের লন্ডন সফরকে তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মনে করা হয়। লন্ডন অবস্থানের সময়কালে তিঁনি অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে বৈঠক, ধর্ম, দর্শন এবং সংস্কৃতির উপর বক্তৃতা এবং আলোচনা করেন। লন্ডনে থাকাকালিন সময়ে তিঁনি লেখায়ও মনোযোগ দিয়েছিলেন। এই লেখাগুলির মাধ্যমেই, তিঁনি রেখে গেছেন একটি সমৃদ্ধ স্থায়ী উত্তরাধিকার যা আজ সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। “আমি বিবেকানন্দ বলছি”র মুখবন্ধে শংকর বিবেকানন্দের পশ্চিমা দেশে দেওয়া তুলনাহীন বক্তৃতাগুলিকে নিয়ে যা লিখেছেন: “বিবেকনন্দের দেওয়া মূল বানীর বিদুৎ প্রবাহ থেকে আমরা চিরতরে বঞ্চিত হয়েছি। যৎসামান্য যেটুকু জে জে গুডউইন নামক ইংরেজ ক্ষিপ্রলিপিকারের নিষ্ঠা ও অসামান্য নৈপুন্যে রক্ষা পেয়েছে তার জন্য আমরা এই বিদেশী মানুষটার কাছে চিরঋণী। শোনা যায় বিবেকানন্দের ভাষনের শর্টহ্যান্ড নোট উদাসী গুডউইনের ট্যাংকে সযত্নে সংগৃহীত ছিলো। কিন্তু দক্ষিন ভারতে তার আকস্মিক মৃত্যুর পর সেই ট্র্যাংক সকলের অজান্তে ইংল্যান্ডে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।“ অর্থাৎ স্বামীজীর দেওয়া বক্তৃতার একটা বড়ো অংশ চিরতরে হারিয়ে যায়। সেই ট্র্যাংককে খুঁজে বের করার জন্য সিস্টার নিবেদিতা পর্যন্ত বিলেতে গিয়ে অনেক খোঁজ খবর করেছিলেন, কিন্তু গুডউন পরিবারকে খুঁজে বের করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁর দেওয়া ভাষনের এ অমূল্য সংগ্রহ চিরতরে কালসমুদ্রে নিমজ্জিত হয়েছে। স্বামীজীর ইংল্যান্ডে অবস্থান কালের কয়েকটি খন্ডচিত্র সহ তাঁর বক্তৃতামালার দার্শনিক বিষয়গুলিকেই এখানে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।

 

১৮৯৩ সালটি ছিলো স্বামী বিবেকানন্দ সহ সারা ভারতবাসীর জন্য একটি অবিস্বরনীয় বছর। এ সালেই স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোতে অনুষ্ঠিত ধর্ম পার্লামেন্টে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন, যেখানে তিনি প্রথমবারের মতো পশ্চিমা শ্রোতাদের কাছে হিন্দুধর্মের দর্শনীয় দিকটাকে তুলে ধরতে এক গুরুত্বপূর্ন ভাষন দেন। দিনটা ছিলো সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ। সেইদিন সকল দর্শক-শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন এই সুদর্শন যুবক সন্ন্যাসীর কথাগুলোকে। তিঁনি বলছিলেন ঈশ্বর উপলদ্ধির জন্য সমস্ত ধর্মই শ্রেয় এবং বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্যের মধ্যে সহনশীলতা অনুশীলন করার জন্য লোকেদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর শব্দের জলসিঁড়িতে ধ্বনিত হচ্ছিল মানবতার মহান মন্ত্র, য আগে কেউ কখনো শুনেনি কিংবা এতো সুন্দর করে, সহজ করে কেউ কখনো বলেনি। তাঁর কন্ঠে উচ্ছারিত হলো-““সাম্প্রদায়িকতা কেবলমাত্র আমাদের সামান্য আত্মের বিরুদ্ধে নিজেকে জাহির করা, কিন্তু যখন আমরা মহান আত্মার সংস্পর্শে আসি তখন আমরা অনুভব করি যে আমরা সকলে একই আত্মার বন্ধনে বাঁধা"। সেদিন যে মানবতার এবং সহনশীলতার ধর্মের বীজ দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে তিঁনি রোপন করেছিলেন তাঁর জন্য তিঁনি হয়েছিলেন প্রশংসনীয়, শ্রদ্ধেয় এবং বিশ্বনন্দিত। তাঁর মানবতার ধর্মের বানীতে অনুপ্রানিত হয়েছিলো সকলেই। শিকাগোতে এই অবিস্বরনীয় ভাষনের পর পরই, তিঁনি ভারতে সামাজিক সংস্কারেরও পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেমন বর্ণ-ভিত্তিক বৈষম্য দূর করা এবং শিক্ষা উদ্যোগের মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন করা। শিকাগো ভাষনের পরবর্তী সময়ে স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৯ সালের মধ্যে বেশ কয়েকবার লন্ডনে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর অবস্থান উল্লেখযোগ্য এবং ঘটনাবহুল ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৯৫ সালের নভেম্বরে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের  সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল স্বামীজির সাথে। সেই থেকেই যেন মার্গারেটের জীবনে বয়ে যায় এক আধ্যাত্মিক নান্দনিকতার ঝড়। বদলে যায় তার জীবন, দর্শন আর সামাজিক ভাবধারা। তিনি শেষ পর্যন্ত ভারতে চলে আসেন দীক্ষা নেন এবং মার্গারেট থেকে হয়ে যান সিস্টার নিবেদিতা। সিস্টার নিবেদিতা ছিলেন একজন আইরিশ শিক্ষক, লেখক, সমাজকর্মী, স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং স্বামী বিবেকানন্দের একনিষ্ঠ শিষ্য। স্বামী বিবেকানন্দের ভাই, মহেন্দ্রনাথ, ইংল্যান্ডে তাঁর বেশিরভাগ সময় স্বামীজীর সাথে বসবাস করেছিলেন। লন্ডন সফরকালে বিবেকানন্দ ৬৩ সেন্ট জর্জ ড্রাইভ সহ লন্ডনের বেশ কয়েকটি ঠিকানায় অবস্থান করেন। মর্টিমার রেজিনাল্ড মার্গেসন এবং তার স্ত্রী লেডি ইসাবেল, যিনি বিবেকানন্দের শিক্ষায় আগ্রহী ছিলেন, বাড়িটিতে বিবেকানন্দের থাকার ব্যাবস্থা করেছিলেন। বিবেকানন্দ প্রথম তলার ডাবল ড্রয়িং রুমে নিয়মিত ক্লাস করতেন, যেখানে প্রায় একশো লোক বসতেন বলে জানা গেছে। তাঁর বসবাসরত সেই বাড়ীটির সামনে ইংলিশ হেরিটেজের দেয়া নীল ফলকে আজও লেখা আছে: “স্বামী বিবেকানন্দ, ১৮৬৩ - ১৯০২, হিন্দু দার্শনিক ১৮৯৬ সালে এখানে বসবাস করতেন।“ ১৮৯৬ সালের ডিসেম্বরে বিবেকানন্দ ভারতের উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন। কলকাতায় ফিরে তিনি রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।

 

১৮৯৬ সালের মে মাসের শুরুতে, স্বামী তার নিয়মিত ক্লাস শুরু করেন, বেশিরভাগই জ্ঞান-যোগের উপর। মে মাসের শেষের দিকে, তিনি পিকাডিলিতে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ পেইন্টার্স ইন ওয়াটার-কালারস-এর গ্যালারির একটিতে রবিবারের বক্তৃতার একটি সিরিজ উদ্বোধন করেন। বিষয়গুলো ছিল, “ধর্মের প্রয়োজনীয়তা”, “একটি সর্বজনীন ধর্ম এবং “বাস্তব ও আপাত মানুষ। এই বক্তৃতাগুলির অভূতপূর্ব সাফল্যের পর, জুনের শেষ থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত রবিবার বিকেলের জন্য প্রিন্সেস হলে আরেকটি কোর্সের ব্যবস্থা করেন। এই বক্তৃতাগুলির মধ্যে ছিল "ভক্তি-যোগ", "ত্যাগ" এবং "উপলব্ধি"। এগুলি ছাড়াও, স্বামী নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে পাঁচটি ক্লাসের আয়োজন করতেন এবং শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রশ্নোত্তর ক্লাসেরও ব্যবস্থা ছিল, যা ছিলো অত্যন্ত শিক্ষণীয়। স্বামীজী মিসেস হান্টের বাসভবনে নটিং হিল গেটেও বেশ কয়েকটি আলোচনায় যোগ দেন। স্বামী সারদানন্দ ৬ জুন লিখেছিলেন:স্বামী বিবেকানন্দ এখানে একটি ভাল কাজ শুরু করেছেন। প্রচুর সংখ্যক লোক নিয়মিত তার ক্লাসে উপস্থিত হয় এবং বক্তৃতাগুলিতে থাকে প্রাঞ্জলতা এবং গভীরতা যা সবাইকে মুগ্ধ করে। ক্যানন হাওয়েস, অ্যাংলিকান চার্চের অন্যতম নেতা, একদিন এসেছিলেন এবং অনেক আগ্রহের সাথে বিবেকানন্দকে শোনেন। শিকাগোতে তিনি স্বামীকে আগে দেখেছিলেন এবং সেই সময় থেকেই তাঁকে ভালোবাসতেন।“ স্বামীজীর লন্ডনে থাকার সময় স্মরণীয় ঘটনাগুলির মধ্যে একটি ছিল, ২৮ মে ১৮৯৬। বিশেষ আমন্ত্রণে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ, প্রফেসর ম্যাক্স মুলারের সাথে তাঁর বাসভবনে স্বামীজীর সাক্ষাৎ। সেই মনোরম অভিজ্ঞতার কথা স্বামী নিজেই লিখেছিলেন ৬ই জুন ব্রহ্মবাদিনের কাছে: “কি অসাধারণ মানুষ প্রফেসর ম্যাক্স মুলার। আমি কয়েকদিন আগে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। বলা উচিত, যে. আমি তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম, যে কেউ শ্রী রামকৃষ্ণকে ভালবাসে, তার সম্প্রদায়, ধর্ম, বা জাতীয়তা যাই হোক না কেন, সেই ব্যক্তির কাছে আমার দর্শন আমি তীর্থ হিসাবে গ্রহণ করি। . . .এই সাক্ষাৎকারটি সত্যিই আমার কাছে একটি অবিস্বরনীয় ছিল। সেই সুন্দর ছোট্ট বাড়িটি, তার সুন্দর বাগানের স্থাপনা, রূপালী মাথার ঋষি, যার মুখ শান্ত এবং সৌম্য। আধ্যাত্মিকতার পিছনে কোথাও উত্তেজনাপূর্ণ আগ্রহ, বিরোধিতা এবং অবজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করার এবং শেষ পর্যন্ত প্রাচীন ভারতের ঋষিদের চিন্তার প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি করার দীর্ঘ এবং কঠিন কাজের মাধ্যমে তার জীবনের সহায়িকা - গাছ, ফুল, শান্ততা এবং পরিষ্কার আকাশএসবই আমাকে কল্পনায় প্রাচীন ভারতের গৌরবময় দিনগুলিতে, আমাদের ব্রহ্মর্ষি ও রাজর্ষিদের দিনগুলিতে, মহান বান-প্রস্থের দিনগুলিতে, অরুন্ধতী ও বশিষ্ঠদের দিনগুলিতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল।“

 

অদ্বৈত বেদান্ত (অ-দ্বৈতবাদ) বা ভক্তি যোগ (ভক্তিমূলক যোগ) এর মতো হিন্দু ধর্মের দর্শনের উপর বক্তৃতা দেওয়ার পাশাপাশি, বিবেকানন্দ ধ্যানের সেশনের মাধ্যমে লোকেদের যোগ অনুশীলন করতে উত্সাহিত করতে শুরু করেছিলেন যা লন্ডনের আশেপাশের বিভিন্ন স্থানে নিয়মিতভাবে পরিচালিত হত। চার্লস হেনরি অ্যালান বেনেট (একজন ইংরেজ বৌদ্ধ এবং হারমেটিক অর্ডার অফ দ্য গোল্ডেন ডনের প্রাক্তন সদস্য ছিলেন) বা জন উড্রফের মতো স্বনামধন্য ব্যক্তিরাও তাঁর সংস্পর্শে আসে। স্যার জন জর্জ উড্রোফ, যিনি তার ছদ্মনাম আর্থার অ্যাভালন নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ যার তন্ত্র এবং অন্যান্য হিন্দু ঐতিহ্যের উপর প্রকাশিত রচনাগুলি হিন্দু দর্শন এবং যোগব্যায়ামের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ তৈরী করেছিল। উড্রোফ রিজেন্টস পার্কের কাছে তার বাসভবনে প্রতি রবিবার সকালে আয়োজিত ধ্যান ক্লাসে অংশগ্রহণের জন্য বেশ কিছু বিশিষ্ট অতিথিকে আমন্ত্রণ জানাতেন। বিবেকানন্দ তার লন্ডন সফরের সময় যাদের মুখোমুখি হয়েছিল তাদের প্রত্যেকের উপর একটি স্থায়ী ছাপ ফেলেছিলেন এবং তাঁর প্রজ্ঞায় ও মানবিক ধর্মে সকলেই অনুপ্রানিত হয়েছিল। এমনকি যারা তার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিল তারাও তার জন্য প্রশংসা অনুভব করেছিল। “ধর্মের মধ্যে ঐক্য” – এই জাতীয় কথাবার্তা তখন খুব কমই শুনা যেত। তাই সেদিন সেই যুবকের দৃঢ়তায় এবং ধর্ম সম্পর্কিত অভিনব ব্যাখ্যায় সকলেই মুগ্ধ হয়েছিল।

 

স্বামী বিবকানন্দের চিন্তা-চেতনায় লালিত হলো মানব প্রেমের মন্ত্রগুলি, নানা ভাষনে উচ্চারিত হতো ধর্মীয় ঐক্য আর সহনশীলতার বানীগুলি, ধ্যান আর যোগ অনুশীলনে দৃশ্যত হতো এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। তিঁনি সবসময় শোনাতেন মানব সম্ভাবনার শক্তিকে। স্বামী বিবেকানন্দ মানুষের সম্ভাবনায় দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন যে প্রত্যেক ব্যক্তিরই তাদের মনস্থির করার ক্ষমতা রয়েছে। তার জন্য, বস্তুগত লাভের বিষয়কে অগ্রাধিকার না দিয়ে বরং  একজনের অভ্যন্তরীণ শক্তি বিকাশের জন্য সত্যিকারের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কর্ম করে যেতে হবে। যখন পৃথিবীতে ছিলো এক কঠিন অস্থিতিশীলতা, ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অনৈক্য আর সামাজিক অবক্ষয়, ঠিক সেই সময় এই ভারতীয় যুবক সন্যাসী শুনালেন আধ্যাত্মিক ঐক্যতার কথা। সকল ধর্মের মধ্যে ঐক্যে তার বিশ্বাস তাকে বিভিন্ন ধর্মের লোকেদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। তিঁনি যেন পৃথিবীতে এসেছিলেন মানবতার সেবায়। তার মতে মানবতার সেবা হল ঈশ্বরের সেবা। তার মানবতার সেবার শিক্ষাটি আজও অনেককে অনুপ্রাণিত করে যারা বিশ্বাস করেন যে সত্যিকারের আধ্যাত্মিক বিকাশ শুধুমাত্র আমাদের চারপাশের মনুষদেরকে কর্মের মাধ্যমে তাদের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে সাহায্য করার মাধ্যমেই আসে।

 

ধ্যান ছিল স্বামী বিবেকানন্দের আরেকটি জীবন দর্শন এবং স্বাত্বিক ভাবে জীবন-যাপনের উত্তম উপায় যিনি এটিকে 'মানসিক একাগ্রতার বিজ্ঞান' বলে অভিহিত করেছেন। এই জীবন দর্শনটি আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সন্ধানকারীদের জন্য অপরিহার্য কারণ এটি একজনকে নিজের অভ্যন্তরীণ সত্তার অন্তর্দৃষ্টি পেতে এবং তার সাথে সংযোগ করতে সহায়তা করে। ধ্যানের মধ্যেই নিহীত রয়েছে ঐশ্বরিক শক্তি। একইভাবে, তিনি যোগব্যায়াম সম্পর্কেও প্রাচ্যাত্যে নানা আলোচনায় গভীরভাবে আলোকপাত করেছেন। তিনি মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন যে ব্যক্তিদের বিভিন্ন শারীরিক ভঙ্গি (আসন) এর পাশাপাশি শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম (প্রানায়াম) এর মাধ্যমে শরীর ও আত্মা উভয়কে শক্তিশালী করতে সহায়তা করতে পারে। এই যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমেই মানুষ সত্যিকার অর্থে মানসিক এবং শারিরীক ভারসাম্য তৈরী করতে পারে। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সারা জীবন জুড়ে যে প্রধান দার্শনিক বিষয়টি নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়েছিলেন তা হলো 'কর্ম যোগ'। নিঃস্বার্থ কর্মের পথ ধরেই মানুষ তাদের আষ্টে-পিষ্ঠে বেঁধে থাকা অহংকে অতিক্রম করার শক্তি পায়। কারো উপর অর্পিত যে কোন ধরনের কাজ বা দায়িত্ব পালন করার সময় কোন পুরস্কার বা স্বীকৃতির আশা যেন কেউ না করে বরং কাজটাকে মনোযোগ ও আনন্দের সাথে করাটাই প্রধান দ্বায়িত্ব হওয়া উচিৎ। স্বামী বিবেকানন্দের রেখে যাওয়া শিক্ষাগুলি আজও প্রাসঙ্গিক। প্রেম, সম্প্রীতি এবং শান্তিতে ভরা আমাদের চারপাশে একটি উন্নত বিশ্ব তৈরির দিকে ইতিবাচকভাবে অবদান রেখে কীভাবে আমরা সকলেই ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি এবং স্বাত্বিক জীবন যাপনের জন্য প্রচেষ্টা করতে পারি তার বাস্তব জ্ঞান দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে এই শিক্ষাগুলি।

 

এই মহান ভারতীয় যোগী স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই হৃদযন্ত্রের ব্যর্থতার কারণে এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে পরপারে চলে যান, কিন্তু তিনি পরবর্তী প্রজন্মর জন্য রেখে যান এক বলিষ্ঠ ও দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকার, যার আদর্শের বাতাবরনে আমরা এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে এক ঋদ্ধতার মূর্তি নিয়ে। এই মহান মানুষটির হৃদয়েও ছিলো মান-অভিমান এবং প্রত্যয়ী মনোভাব। ব্যাক্তিজীবন সম্পর্কে এমন ইঙ্গিত রয়েছে যে,  শরিকী সংঘাতে জরজরিত বিবেকানন্দ সংসার ত্যাগের পর আর কখনো তাঁর জন্মস্থানের ভিটেমাটিতে পদার্পন করেননি। তাঁর দেহাবসানের সংবাদ পেয়ে তাঁর মাতৃদেবী পরেরদিন বেলুর মঠে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিঁনি চলে গেলেন, কিন্তু সমস্ত ধর্মের মধ্যে ঐক্যের বিষয়ে তাঁর শিক্ষা আজও সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। প্রাচ্য আর প্রাচ্যাত্বের মিথস্ক্রিয়ায় তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন জীবন দর্শন-মানবিক ধর্ম। আর তাইতো তার ভাবনায় শব্দের জলসিঁড়িতে তৈরী হয় এই বিশ্বের শ্রেষ্ট মানবিক দর্শনের পদাবলী:জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর!"আত্মারূপে স্বয়ং ভগবান জীবের মধ্যেই অবস্থান করেন। আর তাইতো প্রকৃত জীবের সেবার মাধ্যমেই মেলে আসলে স্রষ্টার সেবা। বস্তুত জীবের প্রতি আন্তরিক না হলে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করা সম্ভব নয়। স্বয়ং স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালোবাসার মাধ্যমেই কেবল স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব। বিশ্বের সবকিছুই স্রষ্টার সৃষ্টি। তাই সংসারের সবকিছুর স্পর্শের মাধ্যমেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা যায়। লোকচক্ষুর অন্তরালে নির্জনে একাকী ধ্যানমগ্ন হলেই সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ করা যায় না, কারণ সেই আরাধনাতে পূর্ণরূপে ঈশ্বর প্রাপ্তি হয় না। স্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন মানবীয় গুণাবলি দিয়ে, জ্ঞান, বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে। যে কারণে জীবজগতের মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব। তার আগে হয়তো আর কেউ মানব ধর্ম সম্পর্কে এতো সহজভাবে বলেননি। আর তাইতো এতো যুগ পরেও এই যোগী সন্ন্যাসী বেঁচে আছেন আমাদের চিন্তা-চেতনায়, আমাদের ভাবনায় অনুরনিত হয় তার জীবন দর্শনের মন্ত্রগুলি, আর তাঁই তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের চেতনায় যুগ যুগ ধরে জীবনের আলোকবর্তিকা হয়ে

Leave your review