বাঙালিরা একটি প্রাণবন্ত এবং বৈচিত্র্যময় জাতিগোষ্ঠী যাদের অনেকেই তাদের নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং সনাতনী ঐতিহ্যগুলিকে পৃথিবীর নানা দেশে তুলে ধরছে। তৃতীয় বাংলাখ্যাত বৃটেনে রয়েছে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী। স্থানীয় অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষানীতি এবং সামাজিক কর্মকান্ডে বাংলাদেশীরা বেশ সংপৃক্ত এবং উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। রেষ্টুরেন্ট ব্যাবসায় বংলাদেশীদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। কয়েক প্রজন্ম ধরে জীবনের পথ চলায় আমাদের বাংলা ভুখন্ডের মানুষগুলো এই বিদেশের মাটিতে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি সাংস্কৃতিক অবয়বের চিহ্ন এঁকে দিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে পুঁজিবাদের অসম বিকাশ আর বিশ্বায়নের কারণে, মনে হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সংস্কৃতি এবং জীবন ধারার সামাজিক, ধর্মীয় এবং ঐতিহ্যগত মূল্যবোধগুলি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এক অসুস্থ মনস্তাত্বিক পুঁজিবাদ এবং বিশ্বায়নের যাঁতাকলে দিন দিন আরও বেশি সংখ্যক মানুষ যাদের জন্ম বাংলাদেশে তারাই মূলতঃ তাদের শিকড় থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ব্যাক্তিনির্ভর দর্শন যেন জীবনের গতিপথ নির্ধারন করছে। যতোই আমরা শিক্ষিত হচ্ছি, অর্থ-সম্পত্তির মালিক হচ্ছি, নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে তর তর করে উচ্চ মধ্যবিত্তর দরজায় পা ফেলছি ততই আমাদের ঘাড় মোটা হয়ে যাচ্ছে, আশে পাশের কোন কিছুকে দেখতে পারছিনা। এক অলীক স্বপ্নে রঙীন ফোয়ারায় যেন গা ভাসিয়ে দিচ্ছি। এইটাই হয়তো মধ্যবিত্তের বড়লোক হওয়ার সমস্যা। একটা অসুস্থ সংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে আমরা বেড়ে উঠছি এমিবার মতো। নির্দিষ্ট কোন আকার, আকৃতি, পরিচয় এবং সংস্কৃতিক মূল্যবোধ তৈরী করা সম্ভব হচ্ছে না। টেমসের তীরের নগর কাব্যের এই নিবন্ধটিতে পুঁজিবাদ কীভাবে পুঁজিবাদের রাজধানী লন্ডনের বাঙালি সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছে এবং কেন আমাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা এত গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়েই কিছুটা আলোকপাত করবো।
খুব দুঃখ করেই কথাগুলি বলছিলেন আমার এক অগ্রজ প্রতীম বন্ধু, যে সময়ের বিবর্তনে আমরা কিভাবে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, রীতি-নীতি কিংবা পারিবারিক ও সামাজিক দ্বায়িত্ববোধ থেকে দিন দিন দুরে সরে যাচ্ছি। দীর্ঘদিন যাবৎ লন্ডনের বাঙালী অধ্যুষিত এলাকায় বসবাস করছেন। সামাজিকভাবে বেশ সক্রিয়। ধর্মীয় সংঘঠন সহ বেশ কয়েকটি জনসেবামূলক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত। বাংলাদেশের কুমিল্লার লাকসামে শ্যামল ছায়া আর লালমাইয়ের পাহার বিধৌত অমলীন প্রকৃতির জল হাওয়ায় বেড়ে উঠা এই মানুষটি এখনো শক্তভাবে বিদেশ বিভূঁয়ে পিতা-প্রপিতামহের সামাজিক মূল্যবোধগুলিকে ধারন করে আছেন। পুঁজিবাদ আর মনোস্তাত্বিক বিশ্বায়ানের রোষানলে যখন মানুষের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি পিষ্ঠ, চিন্তা-ভাবনায় এসেছে স্থুলতা, সার্বজনীন ক্রিয়াকলাপে এসেছে ব্যাক্তিবাদ, সমাজের সর্বত্র বিরাজ করছে অস্থিরতা তখন এই মানুষটির হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়, বাংলার ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির গন্ডোলায় শিড়দাঁড়াকে সোজা করে হাঁটার চেষ্টা করেন । ঝাঁপিয়ে পড়েন মানুষের কল্যানে। যে সমাজ আমাদেরকে করেছে ঋজু, এনেছে আমাদের জীবনে সমৃদ্ধি জীবনের একটা সময়ে এই সমাজে কিছুটা অবদান রেখে যাওয়ার মধ্যেই থাকে বেঁচে থাকার সার্থকতা। সেই বন্ধুটি আরেক বার মনে করিয়ে দিলেন যদিও আমরা পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ আর মনস্তাত্বিক বিশ্বায়নের রাজধানী বৃটেনে বসবাস করছি কিন্তু ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্যটা আমাদেরকে খুঁজে বেড় করতে হবে। সন্তানদেরকে ঠিক পথে পরিচালনা করার দায়িত্ব পিতা-মাতার। নতুন প্রজন্মের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। কিন্তু বড়ো সমস্যাটা হলো স্যোসাল মিডিয়া আর তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে পিতা-মাতারাই যখন অশৃংখল, তাদের চিন্তা চেতনায় বিরাজ করে পুঁজিবাদী ধ্যান ধারনা তখন সামাজিক পরিনতির ভয়াবহতা অনস্বীকার্য। সেই দিন সেই বন্ধুর কথাগুলিকে নীরবে শ্রবন করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না। সত্যিই তাই আমরা সকলেই আজ মনস্তাত্বিক বিশ্বায়নের রোষানলে। এইটা কোন পূর্ব-পশ্চিমের কিংবা নতুন আর পুরনো যুগের দ্বন্দ্ব নয়। প্রজন্মের পার্থক্যে চিন্তা ভাবনায় দ্বিমত এবং ভিন্নমূখিতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু অন্যকে অন্ধের মতো অনুসরন করা বা অন্যের সব কিছুকে বিচার বিবেচনায় না এনে গ্রহন করার মধ্যে কোন স্বকীয়তা নেই, আধুনিকতার চমক নেই। বরং মানুষের নিজস্ব স্বকীয়তার বহিঃপ্রকাশেই থাকে অমলিন সৌন্দর্যতা।
মনস্তাত্বিক বিশ্বায়নে আমাদের যে আর্থ-সামাজিক সংকট তার একটা প্রধান কারন হলো হীনমন্যতা এবং প্রাপ্তির লোভ। হীনমন্যতা একটি মানসিক ব্যাধি যা একজন ব্যক্তির অপর্যাপ্ততা এবং নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি থেকে উদ্ভূত হয়। এটি গুরুতর মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাগুলির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যেমন বিষণ্নতা, কম আত্মসম্মানবোধ এবং উদ্বেগ। এই একবিংশ শতকে আত্মসন্মানবোধ অনেকের কাছেই একটি অচল জিনিস। মানুষ এ জাতীয় মূল্যবোধগুলিকে আর ধারন এবং লালন করে না। একজন ব্যক্তির জীবনে ব্যর্থতা বা সাফল্যের অভাবের অভিজ্ঞতার কারণে হীনমন্যতার অনুভূতি বিকশিত হয়। এটি পারিবারিক গতিশীলতার কারণেও হতে পারে যেখানে ব্যক্তি মনে করে যে তারা তাদের ভাইবোন বা সমবয়সীদের তুলনায় যথেষ্ট ভাল বা মূল্যবান নয়। যখন এই অনুভূতিগুলি স্থায়ী হয় এবং সময়ের সাথে সাথে তীব্র হয়, তখন এটি গুরুতর মানসিক সমস্যাগুলির দিকে নিয়ে যেতে পারে যা একজনের জীবন এবং সামগ্রিক সুস্থতার উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলে। হীনমন্যতায় ভুগছেন এমন লোকেরা প্রায়শই মনে করে যে তারা যাই করুক না কেন, এটি যথেষ্ট ভাল নয়। তাই তারা অন্যদের কাছ থেকে সমালোচনা এবং প্রত্যাখ্যানকে ভয় পায়, যার ফলে তারা নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে অনুধাবন করার জন্য তাদের চারপাশের লোকদের সাথে ক্রমাগত নিজেদের তুলনা করে। এই তুলনা করার মাধ্যমে শুধুমাত্র তাদের মূল্যহীনতা এবং অপর্যাপ্ততার অনুভূতিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। সমাজের এই লোকগুলোর ধারনা তারা তাদের সাফল্য বা স্বীকৃতির জন্য তাদের চারপাশের লোকদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। আর না হারার প্রবনতা কিংবা নিজকে উঁচু স্থানে বসানোর জন্য অন্যের সাথে অহেতুক প্রতিযোগীতা দিন দিন মানুষকে চরম বিষন্নতা এবং উদ্বেগজনিত ব্যাধিগুলির মতো আরও গুরুতর মানসিক অসুস্থতার দিকে পরিচালিত করে। এই জাতীয় হীনমন্যতায় আক্রান্ত লোকগুলোর মধ্যে প্রায়ই কম আত্মসন্মানবোধ থাকে। এই ব্যাপারটা বাঙালীদের মধ্যে বেশ পরিলক্ষিত। এক অস্বাভাবিক প্রতিযোগীতার মধ্যে আমরা সকলেই মত্ত। নিজকে প্রকাশিত করার এই এক অসুস্থ মানষিক প্রবনতা। তথ্য-প্রযুক্তি আর স্যোসাল মিডিয়ার দৌড়াত্বে এই প্রবনতার উত্তরন ঘটছে দিন দিন। নিজকে সমাজের উঁচু স্থানে বসানোর প্রতিযোগীতায় আমরা অন্যের প্রতি সন্মান, ভালোবাসা, প্রেম-প্রীতি, বিনয়ী মনোভাব কিংবা সুসম্পর্ক রাখার মূল্যবোধগুলি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ভোগবাদীতাই এই সামাজিক স্খলনের উৎস, তার সাথে যুক্ত হয়েছে এই যুগের মানুষগুলোর অসুস্থ চিন্তা ভাবনা যা মানুষের বিবেক এবং সৃজনশীলতাকে কেড়ে নিচ্ছে।
যদিও অর্থ এবং বিনিয়োগের এই প্রবাহ বিশ্ববাসীর জন্য বড় অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসছে, মানুষেরা ক্রয় ক্ষমতায় এসেছে স্বাভাবিকতা, ব্যাক্তি সাফল্যে এসেছে অফুরন্ত সম্ভাবনা কিন্তু, আমরা আজ অনেকেই দেখতে পাচ্ছি এই পুঁজিবাদী দর্শন কেমন করে ধীরে ধীরে আমাদের ঐতিহ্যগত ধর্মীয় মূল্যবোধকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে এবং সুস্থ সামাজিক পরিবেশের পতনের কারণও হয়েছে। সাম্প্রতিক দশকগুলিতে, বিলেতের জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে, পৃথিবীর প্রায় তিন শতাধীক ভাষার লোকজনের আবাসস্থল এই শহরটি। ব্রেকজিটের কারনে বিপুল সংখ্যক মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপীয়ানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৈচিত্র্যময়তা নিঃসন্দেহে শহরের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করছে। তবে সাথে সাথে ধর্মীয় এবং সামাজিক পরিবেশেও রয়েছে এর সুদুরপ্রসারী প্রভাব। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে আগের চেয়ে অনক কম লোক ধর্মীয় পরিষেবাগুলিতে যোগ দিচ্ছে বা বিশ্বাস-ভিত্তিক সংস্থাগুলির সাথে জড়িত হচ্ছে। এই প্রবণতা শুধু লন্ডনের ক্ষত্রেই নয়, সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ধর্মনিরপেক্ষতা ধরে রাখার সাথে সাথে ধর্ম ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছে। একদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে ভোগবাদ, আত্মকেন্দ্রিকতা আর অন্যদিকে লোপ পাচ্ছে ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধগুলি। ব্যক্তি সাফল্যই যেন জীবনের মূল মন্ত্র। এই নতুন জীবনধারাই চলছে সমাজের সর্বত্র। মানুষজন ইদানীং দীর্ঘ সময়ের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে, পরিবার একসাথে কম সময় কাটাচ্ছে, একসাথে থেকেও যেন একাকিত্বের জীবন, মোবাইল ফোন কিবা কোন আধুনিক গেজেটে ডুব দিয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। অনেকে আবার কাজ না করেও অতি ব্যাস্ত জীবন কাটাচ্ছে, পরিবারের সাথে সময় না কাটিয়ে প্রতি সপ্তাহেই কোন না কোন আধুনিক ঘরনার পার্টিতে হৈ হুল্লোরে সময় কাটাচ্ছে। মানুষের ঐতিহ্যবহী ক্রিয়াকলাপগুলি শপিং ট্রিপ মদের দোকান এবং ক্লাবগুলিতে রাত কাটানো দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। এমনকি পারিবারিক অনুষ্ঠানাদি যেমন জন্মদিন পালন, পূজা-পার্বন কিংবা বিবাহের অনুষ্ঠানগুলি কয়েক দশক আগে যেভাবে হত তার থেকে ভিন্নভাবে পরিচালিত হচ্ছে, দম্পতিরা ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় অনুষ্ঠানের চেয়ে নাগরিক অনুষ্ঠানের পক্ষে। এই ভাবেই সময়ের বিবর্তনে আমরা হারাতে বসেছি আমাদের পরিচয়। অন্যের পরিচয়ের বাতাবরনে বেড়ে উঠছি এই অবাধ পুঁজিবাদী সমাজে। আমরা পূর্বের মানুষগুলোর পশ্চিমের মতো চলতে-বলতে আর করতে ভালোবাসি। তাই ভলো-মন্দের ব্যাপারটা নগন্য।
তবে এইটা অনস্বীকার্য যে আমরা আজ যে যুগে বসবাস করছি তা পুঁজিবাদ, বিশ্বায়ন, আধুনিকায়ন, গনতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা আর তথ্য প্রযুক্তির যুগ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথ ধরে অবাধ পুঁজিবাদের দামামা বাঁজিয়ে এগিয়ে চলেছে এ বিশ্ব। একদিকে আধুনিকায়নের নব জাগরন দেশে দেশে সমৃদ্ধি আর উন্নয়নের জোয়ার আর অন্যদিকে পুঁজিবাদ আর বিশ্বায়নের জঠরে বেড়ে উঠা এক অস্থিতিশীল, অনিশ্চিত, জটিল এবং দূর্বৃত্তায়নের পৃথিবীর প্রসার। যতোই এগিয়ে চলছে পৃথিবী ততোই আমরা হয়ে পড়ছি ভারসাম্যহীন। বেড়ে যাচ্ছে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য, অসমতা, মূল্যবোধের স্খলন, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অপরাধ, অপসংস্কৃতি আর মানুষের বিকৃত ও অসৃজনশীল চিন্তা-ভাবনার বিকাশ।। চেতনায় বিরাজ করছে ভোগ আর প্রাপ্তির বাসনা। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে ভর করছে শকুনির দৃষ্টি এবং উন্মাদনা। এতো নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও আমরা এই নব্য আধুনিক সমাজের সকলেই বলছি উত্তরণের যুগের মধ্য দিয়ে বসবাস করছি। এ যেন পুরাতনের সাথে নতুনের সহাবস্থান। সত্যি কি তাই? উন্নতির বিজয় ডংকার ডামাডোল আজ সর্বত্র। প্রাচ্যাত্যের আলো-বাতাসে টালমাটাল প্রাচ্য। সত্যিই উত্তরনের ছোঁয়া লেগেছে সমাজের সর্বত্র। বড়ো বড়ো চিহ্ন ধরা দিচ্ছে আমাদের চোখে-মুখে এবং সারা শরীরে। আর তাইতো আমরা সকলেই ভুগছি এক কঠিন আত্ম-পরিচয়ের সংকটে। আমাদের মধ্যে লালন এবং ধারন করা সংস্কৃতি বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। এই প্রজন্মের তরুন-তরুনীরা বলে তোমাদের ধ্যান-ধারনা অচল, অগ্রহনযোগ্য, এই সময়ের জন্য খুব বেমানান। অন্যদিকে এ প্রজন্মের পিতা-মাতারা যেন পুরনো বোতলে নতুন সিরাপ। রং পাল্টানো মানুষগুলোর ভাবনাগুলিও একই রকম। এখন আমরা ইউরোপে বসবাস করছি, বিলেতে থেকে বাঙালীর মতো চলা ফেরা একেবারেই পাগলামী। তাই পরিবর্তন চাই পোষাকে আষাকে, খাদ্যাভ্যাসে, চলনে-বলনে, কথা-বার্তায়। রাতজাগা পার্টিতে থাকতে হবে সক্রিয়, ধর্মীয় উপাসনা নয় যেতে হবে পাবে (মদের দোকানে) কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে হবে নিজের সমৃদ্ধিকে প্রকাশ করার জন্য। পূঁজিবাদের সাথে সংস্কৃতির যে সাংঘর্ষিক দ্বন্দ তা দীর্ঘদিনের, যদিও সাম্প্রতিক কালে তার ব্যাপকতা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। তা আজ খুব সহজেই লক্ষনীয় সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের চ্যালেঞ্জ সম্ভবত ইতিহাসের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় আজকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বেশী প্রকট। যেহেতু বৃটেনের রাজধানী হলো পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যের রাজধানী তাই প্রবাসীদের উপরে এর প্রভাবটা সবচেয়ে বেশী। কারন আমরা দুই সংস্কৃতির যাঁতাকলে পিষ্ঠ হতে হতে কোন সংস্কৃতিক পরিচয়কেই আর ঠিকমতো ধারন এবং লালন করতে পারছিনা।
বিলেতে বসবাসরত শিক্ষিত বাঙালীদের মধ্যে এসেছে অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক ঋজুতা। অনেকে সমাজের নানা ক্ষেত্রে বেশ সক্রিয়। যেহেতু আমরা সকলেই বেড়ে উঠছি পুঁজিবাদী ভাবধারায় তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে এ সামাজিক ভাবধারাটি কিভাবে মানুষের নৈতিকতাকে ধ্বংশ করে দিচ্ছে। আমাদের অতীত, কৃষ্টি, পরিচয়, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যগত ধ্যান-ধারনা ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী দর্শনে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। যার পরিনতি গোষ্ঠীভিত্তিক সংস্কৃতির বিলুপ্তি। এটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার উপায়কে ধ্বংস করে দিচ্ছে দিন দিন। তৈরী হচ্ছে প্রজন্মের মধ্যে দূরত্ব। নতুন আর পুরনো ধ্যান ধারনায় সংঘর্ষ। অতীত আর বর্তমানের আচরিক ক্রিয়াকলাপে ব্যাবধান। প্রাচ্য-আর প্রাচ্যাত্বের ভাবধারায় সাংঘর্ষিক দ্বন্দ্ব। তাই সন্তানেরা পিতা-মাতার ধ্যান ধারনাকে গ্রহন করতে অপ্রস্তুত বা নারাজ। ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রথা এবং মূল্যবোধগুলি যেমন দায়িত্ববোধ, বড়দের প্রতি সন্মান, বিনয়ী মনোভাব, আত্মমর্যাদা, সুশিক্ষা, মানবতা, দুর্বলদের রক্ষা করা, পরিবারের প্রতি কর্তব্য ইত্যাদি এই পুঁজিবাদী প্রজন্মের তরুন-তরুনীরা মানতে নারাজ। এই জাতীয় মূল্যবোধগুলি ঐতিহাসিকভাবে যেন অচল। এই যুগের মূল্যবোধ যেমন ব্যক্তিগত মালিকানা, ভোগবাদীতা, অবাধ স্বাধীনতা, সঞ্চয় এবং ব্যয়ের স্বাধীনতা, প্রতিযোগীতা, সবকিছুতেই চুক্তির ব্যাবস্থা, রাতজাগা, মদ আর আড্ডার ঘর-গেরস্থালী, সবাইর সাথে তুই-তুকারী, উশৃংখল জীবন ধারা, গার্ল ফেন্ড-বয়ফেন্ড রাখার প্রথা, ধর্ম বিমূখ জীবন পদ্ধতি ইত্যাদি প্রতিস্থাপিত হয়েছে প্রথাগত সামাজিক জীবনে। প্রাচ্যাত্যের চিন্তা চেতনায় বেড়ে উঠা এই প্রজন্মের মধ্যে আধুনিকতার প্রভাব। চিন্তা-চেতনায় এবং মূল্যবোধগুলি প্রাচ্যাত্যের আদলে গড়া। পিতা-মাতারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে সন্তানদের কাছ থেকে। তারাও ভোগবাদী নেশা আর প্রাচ্যাত্যর জাঁকজমকে মত্ত। তাই আধুনিকতার ছোঁয়া তাদের মধ্যেও সক্রিয়। এমন কি কথা-বার্তায় চলনে-বলনে, টীকা-টীপ্পনীতে, প্রেম-ভালোবাসায়, সংযুক্তি-বিচ্ছেদে চলে এসেছ পুঁজিবাদের আদর্শে লালিত পশ্চিমা সংস্কৃতি। পূঁজিবাদ, মুক্তবাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়ন এবং অভাবনীয় তথ্য-প্রযুক্তির উদ্ভাবনা সবই হলো সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের প্রধান উৎস। পিতা-মাতারাই ব্যার্থ হচ্ছে তাদের সন্তানদেরকে সত্যিকার অর্থে মানুষ করতে। তাই ঠাকুর মার ঝুলি থেকে তোলে আনা কোন গল্পের উচ্ছ্বাসে আর কেউ মুগ্ধ হয় না। আমার তো মনে হয় এই যুগের মায়েরা আর গল্পই জানে না, তাই শোনাবে কি।
সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে সুস্পষ্ট বিপদ হল যে এটি দেশীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ধীরে ধীরে ধ্বংশ করে দেয়। শিল্পায়নের অভূতপূর্ব উন্নতির কারনে পশ্চিমা বিশ্ব সর্বক্ষেত্রেই আধিপত্যের আসনে বসে আছে। স্বভাবতই শক্তিশালী দেশগুলি তাদের নিজস্ব ভাষা এবং রীতিনীতি কম শক্তিশালীদের উপর চাপিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৬ শতকে যখন স্প্যানিশরা ল্যাটিন আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, তখন তারা তাদের ভাষা (স্প্যানিশ) স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দিয়েছিল, যার ফলে মাত্র কয়েক প্রজন্মের মধ্যে ৫০০ টিরও বেশি আদিবাসী ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের আরেকটি বিপদ হল যে এটি জাতি বা বর্ণের ভিত্তিতে সামাজিক স্তরবিন্যাস ঘটাতে সক্ষম। পুঁজিবাদ এবং সংস্কৃতির মধ্যে সম্পর্ক জটিল। প্রতিযোগিতামূলক মুক্ত-বাজার অর্থনীতি বিশ্বকে করেছে অনেকটাই দারিদ্রমুক্ত, দেশগুলিতে এনেছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু সেই অগ্রগতির সাথে সাথে এসেছে ব্যাপক অস্থিরতা, বর্নবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ, ভোগবাদীতা, হীনমন্যতা, মানসিক এবং সামাজিক ভারসাম্যহীনতা, সন্ত্রাসবাদ, ধর্মীয় উন্মাদনা এবং ত্বরান্বিত সামাজিক পরিবর্তন যা অনস্বীকার্য। পুঁজিবাদের উন্মাদ হাওয়া লেগেছে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের জীবনে উল্লেখযোগ্যভাবে এবং সময়ের সাথে সাথে অনেকেই নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর সনাতন মূল্যবোধগুলিকে বেমালুম ভূলতে বসেছে। পুঁজিবাদী ধ্যান-ধারনা বাঙালীদের অভ্যন্তরে এবং বিদেশে সংস্কৃতিতে একটি নাটকীয় পরিবর্তন এনেছে যা যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের সার্বিক জীবনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। তবে সাংস্কৃতিক ধ্বংসের কারণ হিসেবে পুঁজিবাদকে দায়ী করাও ভুল। প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। সময়ের সাথে সাথে সব কিছুতেই আসবে পরিবর্তন। কিন্তু এই পরিবর্তনকে গ্রহন করার মধ্যে থাকতে হবে আমাদের সুস্থ চেতনার বহিঃপ্রকাশ। সুস্থতাই নান্দনিক ভাবনার ধারক।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে এটা অর্থনীতি নয়, বরং সংস্কৃতি, ধর্ম, এটাই সংস্কৃতির চালিকাশক্তি। ধর্মনিরপেক্ষতাকে নিরপেক্ষ ভাবাও ভুল। আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিবাদ পশ্চিমা জীবনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে এবং এটি অর্থনীতির চেয়ে সংস্কৃতি গঠনে অনেক বেশি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। পুঁজিবাদ নিখুঁত নয়। গণতন্ত্রের মতো, এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে প্রাণবন্ত মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান, সমৃদ্ধ নাগরিক সমাজ এবং একটি শক্তিশালী ধর্মীয় সংস্কৃতি প্রয়োজন। তাই আমরা স্বৈরাচারের জন্য গণতন্ত্রের সাথে কোন আপোষ করব না। আমরা যদি সাংস্কৃতিক অবক্ষয়কে গুরুত্ব সহকারে নিতে যাই, তাহলে কেবল পুঁজিবাদকে দোষারোপ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সত্যিটাকে উপলদ্ধি করতে হবে যে পুঁজিবাদ আর বিশ্বায়নকে আর ঠেকানো যাবেনা। এই যুগের মধ্যেই আমাদের বসবাস। তাই এই সময়ের সাথেই সামঞ্জস্য বজায় রেখেই আমাদের চলতে হবে, অন্যথায় আমাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশী। শুধু আমাদেরকে এ যুগের চ্যালেঞ্জগুলিকে নির্ণয় করতে হবে এবং সেই মোতাবেক নিজকে এবং সমাজকে তৈরী করতে হবে। তবে পুঁজিবাদী ভোগবাদী দর্শনে সৃষ্ট নানা পরিবর্তনের মধ্যে ব্রিটেনে বাংলাদেশী ঐতিহ্য সংরক্ষণে সহায়তা করার জন্য প্রথমে যেটা প্রয়োজন সেটা হলো সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে ঐক্য এবং শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক। ধর্মীয় এবং সামাজিক সংগঠনগুলি এই প্রজন্মের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা এবং সামাজিক ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধগুলিকে তুলে ধরার জন্য প্রয়োজন ওদের সম্পৃক্ততা। তাই সামাজিক অনুষ্ঠানগুলিতে আনতে হবে পরিবর্তন যেখানে এই প্রজন্মের তরুন-তরুনীদের সম্পৃক্ততা থাকবে সক্রিয়। বিভিন্ন সামাজিক সংস্থাগুলি ব্রিটেনের বহু-সাংস্কৃতিক পরিবেশে বাঙালি সংস্কৃতি উদযাপনের মতো সাংস্কৃতিক উৎসবের মতো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই প্রজন্মের মধ্যে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সক্ষম। তবে কাজটা শুরু হক পরিবার থেকে, পিতা-মাতার হাত ধরে।