সে অনেক দিন আগের কথা। সালটা ১৯৮৯। সোভিয়েত ইউনিয়নে চলছে পতনের উন্মাদনা। অস্থিতিশীল বিশ্ব। পশ্চিমা দেশগুলোর কয়েক যুগের বিশেষ ষড়যন্ত্র এবার পূর্ন হতে চলেছে। মিখাইল গর্ভাচেভের মাধ্যমে এই বিশাল শক্তিধর দেশটাকে টুকরো টুকরো করে ছাড়বে। সেই সালের শেষদিকেই পৃথিবীর তাবৎ মানুষের সামনে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো শক্তিধর পরাশক্তির এই সমাজতান্ত্রিক দেশটা। সৃষ্টি হলো পনেরটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। চিহ্নিত হলো প্রতিটি রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট ভুখন্ড, জাতীয় পতাকা এবং নিজস্ব পরিচয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ঠিক কয়েক মাস আগে গ্রীস্মের ছুটিতে আমি রওনা দিলাম লন্ডনের উদ্দেশ্যে। মাস দুয়েকের ছুটি। অনেকের মতো লন্ডনে এসে কিছুটা সময় কাটানো পশ্চিমাদের চোখ ধাঁধানো নগরায়নের জৌলুসময় উন্নয়নের আধুনিকায়নের বলয়ে আর সাথে সাথে বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টে কিছুদিন কাজ করে পয়সা রোজগার করা। যেন রথ দেখা আর কলা বিক্রির মতো। মস্কো থেকে বৃটেনে আসাটা খুব সহজ ছিলো তখন। একদিন ধলপ্রহরের শেষ অন্তে মস্কোত ট্রেনে চেপে বসলাম। গন্তব্য লন্ডন। মস্কো থেকে ট্রেনটি রওনা দিয়ে যখন বিলারুশের উপর দিয়ে পোল্যান্ড এবং পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি হয়ে হুক ব্যান হল্যান্ড বন্দরে এসে থামে তখন প্রায় ৪৪ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। নির্ধারিত সময়ে জাহাজে চেপে ইংলিশ চ্যানেল পাড় হয়ে যেতে হবে ইংল্যান্ডের হারউইচ বন্দরে। এই ইংলিশ চ্যানেলটির কথা মনে হলেই চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাসের কথা মনে পড়ে যায়। গর্বে আর সাহসিকতায় কিছুক্ষনের জন্য বুকটা ফুলে উঠে। চোখে মুখে উচ্ছ্বাসের চিহ্ন ধরা দেয়। বাঙালী বলে পরিচয় দিতে বড্ডো ভালো লাগে। ক্ষুধা, অভাব, অনটন, অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা, নিরক্ষরতা আর উর্ধগতি জনসংখ্যার বিস্ফোরনে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ যদিও জর্জরিত ছিলো একসময়, সেই ভৌগোলিক সীমানার মানুষগুলি ইতিহাসের পরতে পরতে যে শৌর্য-বীর্য আর উদ্যাম সাহসিকতার মহতি পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছেন তা আজন্ম বাঙালীর হৃদয় মননে গ্রথিত হয়ে থাকবে। এই আমাদের একান্ত গর্ব যে এই বাংলায় জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্কিম চন্দ্র, মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, মোতাহার হোসেন, লালন ফকির এবং জসিম উদ্দিনের মতো বিশ্ব নন্দিত মহামানবেরা। এই বাংলায় জাতীর পিতা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে শিখিয়েছিলেন স্বাধীনতার মন্ত্র, দেখিয়েছিলেন সৌভাত্রের বন্ধন আর অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পথ চলার নিশানা এবং পড়িয়েছিলেন বিজয়ের মুকুট। এই অমলীন বাংলার আকাশে বাতাসে সবুজ শ্যামলিমায় মিশে আছে হাজার বছরের এক বলিষ্ট সাংস্কৃতিক পরিচয়। আমরা বাঙালী। এটাই যেন আমাদের কপালের তিলক।
হুক ব্যান হল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডের হারউইচ বন্দরে যেতে সময় লাগে ৮ ঘন্টা। সেই সময় দিনে দুটো জাহাজ হুক ব্যান আর হারউইচ এর মধ্যে আসা-যাওয়া করতো। প্রথমটি দুপুর ১২টায় আর দ্বিতীয়টি সন্ধা ৬টায়। যথাসময়েই দুপুরের জাহাজে চড়ে বসলাম। জীবনে এ প্রথম জাহাজে উঠা। তাও আবার ইউরোপীয়ান কোন দেশে। মস্কো থেকে যে ট্রেনটিতে আমি হল্যান্ডের হুক ব্যানে এসে পোঁছেছি সেখানে আমি একাই কোন বাঙালী ছিলাম। তবে মস্কোতে অধ্যায়নরত অন্যান্য দেশের বেশ কয়েকজন এশিয়ান, আফ্রিকান এবং লাতিন আমেরিকান শিক্ষার্থী ছিল। আমার সাথে দুটি পেরুর ছাত্রীও ছিলো যারা আমার সাথে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরতা। তাই স্বাভাবিকভাবেই ওদের সাথে গল্প করতে করতেই অনেকটা সময় কাটালাম। কয়েকজন শ্রীলংকান সহ ওদেরকে সাথে নিয়ে এই বিশাল আকৃতির বারো তলা জাহাজের সুসজ্জিত দোকানগুলি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে এক সময় দেখা হলো সোভিয়েত ইউনিয়নে অধ্যয়নরত কয়েকজন বাংলাদেশীর সাথে। খুশী আর রাখি কোথায়? এমনিতেই বাঙালী তারপরে আবার পরিচিত। মস্কোতেই পড়াশুনা করে। সাথে সাথে বাঙালীদের সাথে আড্ডায় যুক্ত হলাম। অনেকক্ষন চললো এই খাস-গল্পের পাঁচ মিশেলি আড্ডা। ওরা চলে গেলো। একসময় আমি এসে দাঁড়ালাম জাহাজের রেলিং এর ধারে। একটি চেয়ার নিয়ে বসলাম। সামনে কুল কিনারাহীন ইংলিশ চ্যানেল। খ্যাচ খ্যাচ আর বিকট আওয়াজ তুলে ইংলিশ চ্যানেলের বুক চিরে এগিয়ে চলছে দৈত্যাকার জাহাজটি। এলোমেলো বাতাসেরা যেন পেখম মেলেছে। খুব পরিচ্ছন্ন রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। খুব ভালো লাগছিলো পৃথিবীর এই অনুপম সৌন্দর্যটাকে। রেলিং এর এপাশ ওপাশ দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকে বসে আছে। জাহাজটি তার আপন নিয়মেই দম দম করে এগিয়ে চলেছে। মর্টারের তীব্র পেষনে পিষ্ঠ উত্তাল জলরাশী একটি সফেদ সোজা সরল রেখা টেনে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে আমার গায়েও এসে পড়ছে দুয়েকটি জলকনা। বাতাস মোটামুটি ঠান্ডা। তাই জ্যাকেটটি গায়েই চাপা ছিলো। আমি চুপ চাপ বসে ইংলিশ চ্যানেলের অপূর্ব দৃশ্য দেখছিলাম। হঠাৎ এক দীর্ঘাকায় স্যুট কোট পরিহিত সুঠাম দেহের এক ভদ্রলোক এসে আমার পাশের খালি চেয়ারে এসে বসলেন। মার্জিত চেহারা। বয়েস সম্ভবতঃ চল্লিশের কাছাকাছি হবে। কেন জানি আমার মনে হলো উনি বাঙালী। উনার চেহারায় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি তিলক আমার দৃশ্যতঃ হলো।
আমি কিছু বলার আগেই ভদ্রলোকটি শুদ্ধ ইংরেজীতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: `কোথায় যাচ্ছেন ভাই?`
বললাম, লন্ডন যাচ্ছি। তারপর আলাপ জমে উঠলো। ভদ্রলোক বেশ সাঁজিয়ে গুছিয়ে বলতে পারেন। মাঝে মাঝে জোকস বলেন। বেশ রসিক! দীর্ঘক্ষন উনার সাথে আলাপ চললো। আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করছি জেনে সোভিয়েত ইউনিয়নের বর্তমান অবস্থা, গর্ভাচেভ, ইয়েলেৎসীন, পেরেস্ত্রইকা, গ্লাসনস্থ ইত্যাদি অনেক বিষয়ে জানতে চাইলেন। আলোচনার এক পর্যায়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম-`ভাই, আপনার জন্ম স্থান কোথায়?` ভদ্রলোক একটু চমকে উঠলেন। শেষে বললেন পাকিস্থানে। তবে ভারত বিভাগের আগে আমার পূর্বসূরীরা ইন্ডিয়াতেই ছিল। পরে আমাকেও তিনি একই প্রশ্ন করলেন। বললাম-আমি বাঙালী ভাই। বাংলাদেশেই আমার জন্ম। শেষে পাকিস্থান সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন করলাম। ভুট্টো, বেনজির ভুট্টো, ৭১ এর পাকিস্থান বাংলাদেশের যুদ্ধ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চাইলে ভদ্রলোক ইতস্তত করছিলেন, সঠিক জবাব দিতে পারছিলেন না। তবে বলছিলেন অনেক দিন যাবৎ দেশের বাইরে থাকার কারনে দেশের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। ২০ বৎসর যাবৎ বিলেতে বসবাস করছেন। এক ইংরেজ তরুনীকে বিয়ে করে বৃটিশ নাগরিত্ব পেয়ে বৃটেনেই চাকুরি বাকুরি করে ঘর সংসার করছেন। ভাবলাম হয়তোবা তাই। পরে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলাপ শুরু হলো। আলাপ করতে করতে দেখা গেলো বাংলাদেশ সম্পর্কে উনার জ্ঞানের ভান্ডার যথেষ্ট। কক্সবাজার থেকে শুরু করে, সোঁনারগাঁও, রাঙ্গামাটি, টাঙ্গাইল, সিলেটের শাহজালালের দরগা, চিটাগং, কুমিল্লার ধর্ম সাগর, ভাষা আন্দোলন, ৭১এর গন অভ্যুত্থান, এরশাদের রাজনীতি, তার অপসারন, নতুন নির্বাচন, বিএনপির ক্ষমতায় আরোহন ইত্যাদি নানা বিষয়ে বেশ আলোচনা করে গেলেন। আমার কেন জানি মনে হলো একজন বাংলাদেশী হয়েও বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত। উনি বরং অনেক তথ্য সমৃদ্ধ নতুন কিছু শোনালেন যা আমার অজ্ঞাত ছিলো। মাঝে দিয়ে আবার দুয়েকবার ফোড়নও কাটলেন। “২/৩ বার বাংলাদেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। তাই নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে বেশ ভালোই দক্ষতা অর্জন করেছি। তাছাড়া সংবাদিকতার লাইনে আছিতো? তাই জানার দায়িত্বটা একটু বেশী”।
তবে ভদ্রলোকের কথাগুলি শুনে আমার কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছিলো। নিজের দেশ সম্পর্কে যে একেবারে অজ্ঞ সে বাংলাদেশ সম্পর্কে এতো জানে কেমন করে? হঠাৎ আমার চোখ দুটি মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেলো ভদ্রলোকের পাশে রাখা একটি খোলা ব্যাগে কয়েকটি বাংলা উপন্যাস এবং সাপ্তাহিক বাংলা ম্যাগাজিনে। বুঝতে বাকী রইলো না লোকটি আমার স্বজাতী জাত ভাই। মনের কৌতুহল চেপে রাখতে পারিনি। বলেই ফেললাম-আপনি দেখি বাংলা জানেন তা না হলে এতো বাংলা বই পত্র সাথে কেন? কিছুটা হতভম্ব খেয়ে গেলেন কিন্তু উত্তর যেন তৈরী ছিলো। বললেন-এগুলো আমার নয়। আমার এক বাংলাদেশী বন্ধুর। বাংলা আমি জানি না ভাই। এক সময় উনি উঠে চলে গেলেন। আমি উঠলাম না। তার পর অনেকক্ষন বসে ছিলাম। কেন জানি বার বার লোকটার কথাই মনে হচ্ছিলো। এক সময় ক্ষুধা অনুভব করলাম। কিছু খাওয়ার জন্য জাহাজের একটা ক্যাফে কাম খাওয়ার রেষ্টুরেন্টে ঢুকলাম। খাওয়া নিতে গিয়ে হঠাৎ করেই বাংলায় কথা বলার আওয়াজ পেলাম। এই এক অভ্যাস। বিদেশের মাটিতে বাংলায় কথা বলা বা কোন বাঙালীর সন্ধান পেলে মনটা হঠাৎ করেই উদাস হয়ে যায়, আনন্দের পেখম গজায়, মনে ভরসা জাগে। তাই চোখ দুটো চঞ্চল হয়ে উঠলো। চোখ বুলাতেই দেখি ভদ্রলোক এক মহিলার সাথে বাংলায় কথা বলছে। পাশে দুটি শিশু বসে আছে। আমিই যেন একটু লজ্জায় পড়ে গেলাম। লোকটা আমাকে দেখে আরো লজ্জা পাক সেটা আর করতে দিলাম না। খাবার না নিয়েই আগের জায়গায় এসে আবার বসলাম। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো সম্রাট আওরঙ্গজবের শাসন আমলের কবি আব্দুল হাকিমের `বঙ্গবানী` কবিতার কিছু লাইন-
“যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবানী
সে সব কাহার জন্ম নির্নয় ন জানি।
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়,
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে ন যায়?”
খুব রাগ হচ্ছিলো আমার সেই দিন। একজন বাঙালী হয়ে কেমন করে আরেক বাঙলীর কাছে নিজকে পাকিস্থানী বলে পরিচয় দেয়? যে পাকিস্থানিরা আমাদের উপর নিশংস অত্যাচার চালিয়েছিলো, হত্যা করেছিলো লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে, লুটে নিয়েছিলো আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত, সেই দেশে জন্ম পরিচয় দিতে লোকটার একটুও বিবেকে বাঁধেনি। এতো ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ। তাহলে বাঙালী বলিয়া পরিচয় দিতে এতো দ্বিধা কেন? এই ব্যাপারটা আমাকে সেদিন খুব ভাবিয়ে তুলেছিলো। তবে ইদানীং এসব ঘটনায় খুব একটা বিচলিত হই না। তিন দশকের ব্যাবধানে এখনকার পরিস্থিতি যেন আরো ভয়ানক। আমাদের সমাজ, কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর সামাজিক মূল্যবোধে এসেছে ক্ষয়রোগ। বাংলাদেশে থেকেও আমরা অনেকেই অবাঙালী বিদেশী। আর বিলেতে থেকে আমরা অনেকেই হয়ে গেলাম বাংলিশ। জীবন দর্শনের এক নতুন বাস্তবতার মুখোমখি আমরা সকলে। সত্যিকার সভ্যতার এ যেন এক ক্রান্তিলগ্ন। বিশ্বায়ন গ্রাস করছে আমাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত, চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে নিচ্ছে আমাদের সুস্থ চেতনার কোষগুলিকে, সৃজনশীলতা আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে। ভূলে যাচ্ছি আমাদের অতীত, বর্তমান এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা। ভোগবাদের প্রাপ্তিতে আমরা আজ সকলেই মোহগ্রস্থ। আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ইতিহাস আজ অপসৃয়মান। আমরা দিন দিন ভূলে যাচ্ছি শতাব্দীর পরম্পরা। সংস্কৃতি যে কোনো জাতির আত্মপরিচয়ের চিহ্ন। এটি একটি গোষ্ঠীর সম্মিলিত সামাজিক ঐতিহ্য, যা তার ইতিহাস, বিশ্বাস, ভাষা, সঙ্গীত, শিল্প, খাদ্য এবং জীবনধারা দ্বারা পরিবর্তিত, পরিমার্জিত এবং রুপায়িত হয়। সময়ের বিবর্তনে এবং বহিরাগত শক্তির প্রভাবে পরিবর্তিত হয় এর আকৃতি এবং ধারা। সংস্কৃতি শুধু আমাদের জীবন দর্শন, চলা-ফেলায়, অঙ্গ-ভঙ্গি, পোশাক-আশাক, শৈলী-অশৈলী কিংবা আত্ম-পরিচয়কেই ধারন করে না, একটি জাতীর সার্বিক উন্নয়নে সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি জাতির সংস্কৃতি তার নাগরিকদের পরিচয় এবং স্বতন্ত্রবোধের সাথে অবিচ্ছেদ্য। সামাজিক রীতিনীতি এবং মূল্যবোধ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্থানান্তরিত হয়ে সমাজের মানুষগুলোর মাঝে যে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবয়ব সৃষ্টি করে তা একটি জাতীকে করে অনুপম, ঋজু এবং অদ্বিতীয়। শুদ্ধ এবং অনন্যসূলভ সাংস্কৃতিক গন্ডোলায় হাঁটতে হাঁটতে একটি সমাজের মানুষগুলো আত্মশুদ্ধিতে হয় বলিয়ান, লালন করে ইতিবাচক মানবিক এবং নান্দনিক মনোভাব, মানুষের মধ্যে তৈরী করে দৃঢ় বন্ধন এবং সৃষ্টি করে সৃজনশীল চিন্তাভাবনা। মুক্ত চিন্তা কিংবা নান্দনিক বুদ্ধিচর্চা সবকিছুই সুস্থ এবং বলীষ্ঠ সংস্কৃতির ফসল। কিন্তু গতো কয়েক যুগ ধরে সামাজিক বিশ্বায়ন আর তথ্য প্রযুক্তির উলঙ্গ ছোবলে আধিপত্যহীন জাতীগোষ্ঠীর সংস্কৃতি এক মহা সংকটের মুখে।
ব্যাক্তির আচার আচরন, মনোভাব এবং ব্যাক্তিত্বের প্রতিফলন হলো মার্জিত রুচি সম্পর্ন শৈলী। যে কোন পোশাকেই হোক না কেন, আমার কাছে তা হল ব্যাক্তির আত্ম প্রকাশের রুপ যার মাধ্যমে ব্যাক্তির ব্যাক্তিত্ব এবং নান্দনিক শালিনতাপূর্ন চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আমরা বসবাস করছি এমন একটি বিশ্বে যেখানে প্রগতি, স্বাধীনতা, স্বাধীকার, ব্যাক্তিত্ববাদ, নৈতিকতা আর গনতান্ত্রিক দার্শনিক চর্চার ছড়াছড়ি। এক ভোগবাদীয় জগতে যেন সবাই মশগুল। আর লন্ডন এই পূঁজিবাদী ভোগবাদী দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। বিলেতে আমরা যারা বসবাস করছি আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা বাঙালি বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি। বাংলাদেশের জলবায়ু, মাটির সোঁদাগন্ধ আর ষড়ঋতুর বৈচিত্রময় শ্যামল প্রকৃতি এবং ঘাস-ফড়িং এর মৃদুল ছোঁয়ায় বেড়ে উঠা আমাদের ভৌগলিক অবয়বে, চেতনায়, মননে, ভাবনায় আর ব্যাক্তিত্বে মিশে আছে বাঙালিত্বের ছাপ। আর্য-অনার্য আর দ্রাবিড়ীয় রক্ত বইছে আমাদের শরীরে, শিরা উপশিরায়। যতো ভাবেই নিজকে বদলানোর চেষ্টা করি না কেন, দেশী-বিদেশী নামি-দামী পোশাক আর অলংকারে নিজকে আবৃত করি না কেন, বিশ্বায়নের গড্ডালিকায় নিজকে আধুনিকরন করার চেষ্টা করি না কেন, আমাদের চোখে-মুখে, কথা-বার্তায়, চলনে-বলনে, অঙ্গভঙ্গি আর চাহনীতে বাঙালিত্বের অনিন্দ সুন্দর ছাপ দৃশ্যতঃ। তাকে বদলাবো কি করে? বাঙালিত্বই আমাদের পরিচয়। বাংলার শিল্পকলা, বিশ্বাস, কৃষ্টি সহ সমস্ত ক্রিয়াকলাপ যা আমাদের জীবনের সাথে গেঁথে আছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে, আমাদের সার্বিক সামাজিক জীবনধারা-এই আমাদের সংস্কৃতি। আমাদের শিষ্টাচার, পোষাক, ভাষা, ধর্ম, আচার-ব্যাবহার আর শিল্প সবকিছুই এ সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। তবে বিদেশী সংস্কৃতিকে অস্বীকার নয় বরং নানা দেশের সংস্কৃতির ভালো দিকগুলিকে সঠিকভবে গ্রহন করতে পারলেই আমাদের সাংস্কৃতিক জীবন হবে আরো বেগবান এবং সমৃদ্ধ। এখনো তিন যুগ আগের সেই লোকটির অসভ্য আচরনের পূনরাবৃত্তি দেখতে পাই সচরাচর। তার বিস্তৃতি এখন পোশাক-আশাকে, চলনে-বলনে, খাওয়ায়-দাওয়ায়, আদব-কায়দায়, কথা-বার্তায়, তর্ক-বিতর্কে সব জয়গায় যেন বিশ্বায়নের উৎপাত আর নগ্ন থাবা। বাঙালীর অবয়বে যেন একেবারে বেমানান। আর তাইতো চলছে বিদেশী চালচলনের মহা সমারোহ।
ইদানীং একটা ব্যাপার খুব দৃশ্যতঃ যে আমরা কেমন জানি হয়ে যাচ্ছি। শৈলিতা আর অশৈলিতা, সংস্কৃতি আর অপসংস্কৃতি, ভালো আর খারাপের মধ্যে আর কোন তফাৎ খুঁজে পাচ্ছি না। এক অন্যরকম পৃথিবী এবং অন্যরকম তার মানুষগুলো। যতোক্ষন পর্যন্ত না নিজকে সমকালীনের দোঁড়গোড়ায় নিয়ে যেতে পারছি, ততক্ষন পর্যন্ত মনে হচ্ছে আমরা যেন অযোগ্য, অসত্য, অনাধুনিক কিংবা সমাজে বসবাসের অযোগ্য এক ক্লীব। কি দ্রুত সংস্কৃতি আর অপ-সংস্কৃতির রুপ পাল্টাচ্ছ। আমরা যাকে সংস্কৃতি বলি সমাজের কিছু লোক তাকে বলে অপ-সংস্কৃতি। ভালো আর মন্দের সংজ্ঞা যেন বদলে যাচ্ছে। অনেক সময় কেমন যেন সবকিছু এলোমেলো মনে হয়। একি সভ্যতায় বন্যতা! নাকি সভ্যতারই আরেক রুপ যা উন্মাদনা আর উন্মত্ততার। সভ্যতার এক নতুন সংজ্ঞা। ইদানীং বিলেতে বাঙালিদের মধ্যেও এই সংস্কৃতি আর অপ-সংস্কৃতির এক দ্বান্দিক সংঘর্ষ দেখতে পাচ্ছি। দিন দিন অপ-সংস্কৃতিই যেন সত্যিকারের সংস্কৃতিতে পরিনত হচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে সামাজিক এবং দেশজ রীতি নিতী। বদলে যাচ্ছে মানুষের আচরিক ধ্যান ধারনা। সংস্কৃতি হলো বিশ্বাস, প্রথা, কৃষ্টি এবং ঐতিহ্য যা কোন সমাজ কিংবা গোষ্ঠীর মানুষের মননে এবং চেতনায় ধারন করে। সংস্কৃতি মানুষের ভাবনায়, চলনে-বলনে, ব্যক্তিত্বে প্রস্ফুটিত হয়। বাংলার সাংস্কৃতিক ধারার বৈচিত্রময় গতি চলে এসেছে শতাব্দী ধরে। ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত ও সাহিত্য থেকে শুরু করে রন্ধনপ্রণালী, শিল্পকলা, ভাষা এবং আরও অনেক কিছুর মধ্যেই সংপৃক্ত রয়েছে বাঙালির সংস্কৃতিক পরিচয়ের শিকড় যার উপর ভিত্তি করেই বাঙালী এগিয়ে চলেছে সময়ের পথ ধরে। আমরা পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, যে পরিবেশে থাকি না কেন ভেতরের মানুষটাকে পরিবর্তন করার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। জীবনের তাগিদে এবং উন্নততর জীবনের আশায় আমরা আজ পৃথিবীর নানা দেশে অবস্থান করছি। তার মানে এ নয় যে আমরা ভূলে যাবো আমাদের ঐতিহ্যকে, পারিবারীক মূল্যবোধ বা ছাড়তে হবে বাংলা গান, কবিতার সান্নিধ্য, ভূলতে হবে নিজের ভাষা এবং মাতৃভূমিকে, ধর্মীয় আদর্শকে। ধর্ম এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের অবয়বে একটি জাতীর সংস্কৃতি পায় সমৃদ্ধি। আশির দশক থেকে আকার নেওয়া বর্তমান বিশ্বায়নের উন্মাদ হাওয়া লেগেছে সর্বত্র। আর তাইতো আমরা লক্ষ করছি সামাজিক, পারিবারিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধগুলি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে কিংবা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে টেলিভিশন শো এবং চলচ্চিত্রের বর্ধিত প্রকাশের কারণে সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাসগুলি প্রাচ্যের ভোগবাদী বিশ্বাসের দ্বারা স্থানান্তরিত হচ্ছে। এই নতুন নতুন বিশ্বায়নের ভাবনাগুলি সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে। উপরন্তু, আধুনিকায়ন এবং নগরায়নের মতো বিশ্বায়ন শক্তির কারণে প্রাচাত্যের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এবং মানবিক মূল্যবোধগুলি ধীরে ধরে হারিয়ে যাচ্ছে এবং মানুষকে তাদের ঐতিহ্য থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে।
তথ্য-প্রযুক্তি আর বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের সামাজিক নিয়ম আর রীতি-নীতিতে। দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যগত দিকগুলো বিশ্বায়ন আর উন্মাদ সোস্যাল মিডিয়ার যুগে বেড়ে উঠা তরুণ প্রজন্মের কাছে কম জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রাচ্যের সামাজিক রীতি-নীতিতে তারা বেশী মাত্রায় অভ্যস্থ হয়ে পড়ছে। এই প্রাচ্যমনা তরুন সমাজ ভুগছে আত্মপরিচয়ের সংকটে। আচারে ব্যাবহারে পশ্চিমা ঢং এর পোশাক পরিধান করলেও অবয়বে ফুটে উঠে বাঙালীর চেহারা, কন্ঠে বেজে উঠে বাংলার আওয়াজ, চলনে-বলনে ধরা দেয় গ্রাম বাংলার চিরায়ত নদ-নদীর গতিপথ। তাই এরা প্রাচাত্যের ঐতিহ্যকে হারিয়ে না পারে প্রাচ্যের তালে তালে পা ফেলতে। এই বাংলীশ তরুন-তরুনীরা সময়ের সাথে সাথে এমিবার জীবন নিয়েই বসবাস করেছে। বিশ্বায়নের যুগে এই হলো এক সাংস্কৃতিক ট্র্যাজেডি। এক ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জাতীগত সংস্কৃতি বিবর্তিত হচ্ছে। তবে এর অদূর ভবিষ্যত অত্যন্ত নেতিবাচক। সামগ্রিকভাবে, বিশ্বায়ন গত কয়েক দশকে বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটিয়েছে। জীবনের অনেক দিক, যেমন ভাষার ব্যবহার, ধর্মীয় অনুশীলন এবং সামাজিক নিয়ম-কানুন নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে মূলত বৈশ্বিক প্রভাবের কারণে,। তাই এখনই সময় আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলিকে ধরে রাখার জন্য, বাঙালীর নিজস্ব পরিচয়কে সংজ্ঞায়িত করার মাধ্যমে এবং সাংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলি সংরক্ষণের লক্ষ্যে নিজেদের সার্বিক মসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন অতীব প্রয়োজন। প্রয়োজন প্রবাসী বাঙ্ঙলীদের মধ্যে একটি সামাজিক নবজাগরন যা মানুষের মানসিকতায় ইতিবাচক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের আনবে।