পহেলা বৈশাখের উৎসব, বা বাংলা নববর্ষ, সারা বাংলায় অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসাহের সাথে উদযাপিত হয়। বাঙালীর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ধারক, কৃষক আর কৃষানীর চৈত্রের শেষ অন্তে নতুন ধানের জলজ ঘ্রানের অফুরন্ত উচ্ছ্বাস, বাংলাভাষী মানুষের এক আনন্দমেলা যা বাংলায় মুঘল আমল থেকে এই প্রাচীন উৎসবটি পালিত হয়ে আসছে। এই শুধু পন্জিকাবদ্ধ কোন আনন্দের দিন নয়, এ যে বাঙালী সংস্কৃতি আর আত্মপরিচয়ের এক শাস্ত্রীয় উপাচার আর নান্দনিক উচ্ছ্বাসের চেতনা। যে দিনটির সাথে মিশে আছে আমাদের পূর্ব পুরুষদের নিঃশ্বাস, জীবন-দর্শন আর রয়েছে এক ঐতিহাসিক তাৎপর্য। বহু যুগ ধরে এই দিনটিকে ঘিরেই বাঙালীর বৈরাগ্য চেতনা আর নদ-নদী, বিল-হাওর আর পাহার-পর্বত বিধৌত প্রকৃতির লোনা জলে বেড়ে উঠা এই অঞ্চলের মানুষের বাউল মন উন্মাদ আর উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা হয়। প্রতাপ বিক্রমাদিত্য থেকে শুরু করে মোঘল সম্রাট আকবর আর বাঙালীর স্বপ্নদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরম মমতায় ছড়িয়ে দেন বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক আর দার্শনিক অনুভূতির পরাগ। আর তাতেই আমরা হই অনুরণিত, যা জাগিয়ে তোলে আমাদের সকলের মধ্যে অমলিন সৌভাত্রের বন্ধন, দেশ প্রেম আর মানবতা। আমরা হই ঋজু এবং অলকানন্দার মতো সচল। এ নববর্ষ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদা বলেছিলেন ‘প্রতিটি মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ যতোটা বৃহৎ, সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া হয় আরো বৃহৎ, সেদিন সমস্ত মানুষত্বের শক্তি অনুভব করিয়া হয় বৃহৎ।’ সত্যিই তাই বন্ধু বাৎসল্য আনন্দপ্রবন বাঙালী (বিশেষ করে বাংলাদেশী ভুখন্ডের মানুষেরা) এই বর্ষবরনের দিনটিতে সব নিংসঙ্গতা আর একাকিত্ব ভূলে একদন্ডে মিলিত হয় সৌভাত্রের বন্ধনে, বলীয়ান হয়ে উঠে সমষ্ঠিগত শক্তিতে। ভেদাভেদহীন ভাবে শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ আর পাড়া-মহল্লা, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এক কাতারে সাদা-লালে রঙিন হয়ে ওঠে, উচ্ছ্বাসে হয় মাতোয়ারা বান ভাসা জোয়ারের মতো। তাছাড়া চৈত্র সংক্রান্তীর শেষ লগ্নে বৈশাখের তাপদাহ রুদ্র রুপ আর কখনো সখনো ফেঁসে উঠা ঝড়ো হাওয়ার প্রকৃতি কবির হৃদয়ে আনন্দের আল্পনা এঁকে দিতো। তাইতো কবি নববর্ষ উদযাপনকে রূপ দিলেন নবোচ্ছ্বাসের আগমনীতে। আর এই আগমনী হাওয়া শুধু বাংলা ভুখন্ডের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলা ভাষাভাষীরা যেখানে আছে সেখানে মঙ্গল শোভাযাত্রা আর আনন্দের পসরা সাঁজিয়ে বরন করে নেয় এ নতুন বছরটিকে। বিলেতেও এ বর্ষবরন অনুষ্ঠানটি ধুমধামের সাথে পালন করা হয়। বিলেতের এই বর্ষবরন উৎসব `বৈশাখী` মেলাকে নিয়েই টেমসের তীরের নগর কাব্যের এই পর্বটিতে আলোকপাত করবো।
তবে এই বর্ষবরনের অতীতকে নিয়ে একটু আলোকপাত করলে একটু সুবিধা হবে কালের বিবর্তনে এর বর্তমান রুপটাকে অনুধাবন করতে। মূলত নববর্ষের উৎসবগুলো ভারতের পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে `হিন্দু বিক্রমী দিনপঞ্জিকা`র সাথে সম্পর্কিত। বিক্রমাদিত্যের নামানুসারে এই দিনপঞ্জির নামকরন করা হয়েছে যা বাংলা এবং নেপালে ৫৯৩ সালে শুরু হয়েছিলো। নানা তথ্যমতে প্রথম বাঙালী সম্রাট ও স্বাধীন বাঙালী নৃপতি শশাঙ্কের শাসনামলেই `বঙ্গাব্দের` সূচনা হয়। তার রাজত্বকালের সময় ছিলো ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রীষ্টাব্দ। আমরা ইতিহাস থেকে দেখতে পাই পহেলা বৈশাখের দিনটিকে `শকাব্দ` হিসেবে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক চালু করেন। কিন্তু পরবর্তীতে দেখতে পাই মোঘল শাসনামলে সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) প্রথম ১৫৮৪ সালে ১৪ই এপ্রিল বাংলা সন গণনা শুরু করেন। তাঁর শাসনামলেই আকবরের দরবারে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং দরবারী জ্যোতিষী ফকরুদ্দিন পঞ্জিকা সংস্কারের সূচনা করেন। তিনি ১৪ এপ্রিল সৌর গণনা অনুসারে বাংলা বছর প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার সরকারকে এই নতুন পদ্ধতির ভিত্তিতে কর গণনা করার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ অনুসারে, প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া নতুন বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে সকল নাগরিকের কর পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। কালক্রমে এই দিনটি শেষ পর্যন্ত 'পহেলা বৈশাখ' বা 'বাঙালি নববর্ষ' নামে পরিচিতি লাভ করে। সেই থেকে পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। এই দিনে, অতীতে লোকেরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক যেমন পাঞ্জাবি এবং ঢাকার তাঁত কলের সূক্ষ্ম মসলিন কাপড় দিয়ে তৈরি শাড়ি পরতো। শুরুতেই ফসলী সন নামে এই দিনটির উদযাপন শুরু হয়। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে এই দিনটি পরিচিতি পায় ‘বর্ষবরন উৎসব হিসেব। বাংলার এই দিনটি অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ মোঘল স্ম্রাট আকবরের সময় থেকেই মূলত শুরু হয়। সেই সময় প্রত্যেক প্রজারা বাংলা মাসের চৈত্রের শেষ দিনটিতে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকতো। একই নিয়ম ছিলো সকল ব্যবসায়ীদের জন্যও। আকবরের আমল থেকে বর্ষবরন হালখাতা বা কর আদায় দিয়ে শুরু হয়েছিলো। আমরাও শৈশবে এই আচরিক ব্যাবস্থা দেখেছি। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা বসতো বৈশাখের প্রথম দিনটিতে সেদিন প্রতিটি গ্রামে-গন্জে চলতো উৎসবের ধুমধাম। বাড়ীতে বাড়ীতে নানা ধরনের মিষ্টি-পায়েসে আপ্যায়ন করা হতো। সকলে দল বেধে যেতো মেলাতে। পায়ে হেঁটে আমরাও প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তির এই বিশেষ মেলা উৎসবটাকে উপভোগ করতে গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে চার মাইল দুরের বড়ো মেলাটিতে যেতাম। ধীরে ধীরে পহেলা বৈশাখ হয়ে উঠে বাঙালীর সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। হয়ে উঠে এক সামাজিক প্রথা।
কিন্তু এই পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরনের সাথে একটা গভীর সম্পর্ক আছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রথম নববর্ষ আসে (১২৬৯ বঙ্গাব্দ ১৮৬২খ্রি.) জন্মের পর মাত্র দ্বিতীয় বছরে পা দিয়ে। ১৯০২ সালে শান্তিনিকেতনে খুব আনন্দঘন এক উৎসবমূখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে পালিত হয় পহেলা বৈশাখ। সেই দিনটি ছিলো একটু অন্যরকম। আগের বর্ষবরনের সব প্রথাকে ভেঙ্গে দিয়ে কবিগুরু উপহার দিলেন এক নতুন বর্ষবরনের। আনন্দ এবং উদ্দীপনা যুক্ত হলো নানা মাত্রায়। যেখানে নেই কোন হালখাতা, কর দেয়া-নেয়ার প্রথা, লেন-দেনের হিসেব নিকেষ। আছে শুধু বাংলার পহেলা মাসে বৈশাখকে বরন করার সন্মিলিত প্রয়াস-সব রোগ জরাকে বিদায় দিয়ে নতুনকে বরনের আহ্বান। সেই নতুনের আহব্বানের নান্দনিক ভাবধারাটি আমরা এই বাংলা ভূখন্ডের মানুষেরা দেখতে পাই ১৯৬৭ সালে ছায়ানটের বর্ষবরণে। তাই এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় এক নতুন আঙ্গিকে পহেলা বৈশাখকে বরন করা শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের বর্ষবরনের মাধ্যমে। বাংলার সংস্কৃতিতে ঠাকুরের অবদান ছিল অপরিসীম। তার কাজগুলি পরবর্তী প্রজন্মের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এরকম একটি কাজ হল তার "এসো হে বৈশাখ" গানটি যা সারা বাংলায় পহেলা বৈশাখের উৎসবের সময় গাওয়া হয়। কালক্রমে গানটি যেন বৈশাখী উদযাপনের সমার্থক হয়ে উঠেছে। এর ভাব, সামাজিক এবং দার্শনিক গভীরতা বাঙালীর জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে কারন সব বাঙালীরাই এই বর্ষবরনের আনন্দের উপলক্ষটি পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে একইভাবে উদযাপন করে – মিষ্টি বিনিময়, ঐতিহ্যবাহী পোশাক যেমন মহিলাদের জন্য শাড়ি বা পুরুষদের জন্য কুর্তা পরা। সবাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই নিরন্তর ক্লাসিকটি গাওয়ার সাথে সাথে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা হয়। পহেলা বৈশাখ দীর্ঘকাল ধরে সারা বিশ্বের বাঙালিদের জন্য একটি প্রতীক হয়ে এসেছে। এটি জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক। দিনটি নানা পটভূমির লোকেদের মধ্যে উত্সাহ আর প্রানখোলা আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে যারা এই উত্সব অনুষ্ঠানটি উদযাপন করতে একত্রিত হয়। দিনটি আরম্ভরের সাথে শীতের মাস অন্তে বসন্তকালের আগমনকে উদযাপিত করে। নানা আয়োজনে উদযাপিত হয় নতুন বছরের এই দিনটি, গ্রামে-গঞ্জে বসে মেলা, মাইকে বাজতে থাকে গ্রাম-বাংলার চির চেনা লোক সংঙ্গীত, যা পহেলা বৈশাখকে করে তোলে প্রানবন্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পহেলা বৈশাখ বাংলার দুটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রতীক।
তবে এখানে একটু বলে রাখা ঠিক হবে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগে, বাঙালিরা দুটি পৃথক অনুষ্ঠান উদযাপন করত - একটি তাদের আর্থিক বছরের শুরুতে এবং আরেকটি বসন্তকালকে স্বাগত জানাতে। এই দুটি উপলক্ষই আলাদাভাবে উদযাপন করা হতো অতীতে, কিন্তু তাদের এই উদযাপনগুলির সাথে একটি সাধারণ থিম ছিল যা তাদের জীবনের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে খুব জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ঠাকুর যখন খ্যাতি লাভ করেন, তখন তিনি এই দুটি অনুষ্ঠানকে কীভাবে একটি জমকালো অনুষ্ঠানে একীভূত করা যায় যা সৃষ্টি করবে এক নতুন উৎসবের উদ্দীপনা এবং সেই সাথে সমস্ত বর্ণ, শ্রেণী এবং ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্মিলিত আনন্দের সূচনা করবে সেই নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দুটি অনুষ্ঠানকে একত্রিত করার সিদ্ধান্ত নিলেন । শুরু হলো নতুন উৎসব পহেলা বৈশাখ। "পহেলা" নামের অর্থ প্রথম (বাংলায়) যখন "বৈশাখ" হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রথম মাসকে বোঝায়, যা সাধারণত প্রতি বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পরে। এইভাবে, এটি পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রথম দিন হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। এই জমকালো উৎসবের দিনটি আয়োজনের মাধ্যমে ঠাকুর নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে সবাই যেন এই মহিমান্বিত অনুষ্ঠানে অংশ নেয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে যেখানে লোকেরা শাড়ি এবং লুঙ্গির মতো ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত হবে, থিয়েটার শো সঞ্চালনে মাতোয়ারা হবে, পিঠা, মিষ্টান্ন আর পায়েশের মতো সুস্বাদু খাবার পরিবেশীত হবে ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়, আলপনার নকশায় আলোকিত হবে পথ জনপদ, আনন্দে ভরে উঠবে আবাল-বৃদ্ধ-বনীতা সকলের হৃদয়। সকল দুঃখ, বেদনা আর পংকিলতাকে ভুলে গিয়ে সকলেই মাতোয়ারা হবে এক নতুন স্বপ্নকে বুকে নিয়ে। শুধু তাই নয়। বাংলায় বসবাসকারী সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের অনুভূতি তৈরি করার পাশাপাশি, ঠাকুর এই উৎসবের মাধ্যমে স্থানীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণের লক্ষ্যও রেখেছিলেন। এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য, তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের কারিগরদের উৎসাহিত করেন, যেমন মুর্শিদাবাদ জেলার বালুচর শাড়ি বা ঢাকা শহরের মসলিন তাঁতি ইত্যাদি। আর্থিকভাবে এই পেশাদারের লোকেরা লাভবান হতো পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সময় তাদের তৈরী জিনিস বিক্রি করে। এই উদ্যোগটি আজ অবধি সফলতার সাথে বহাল রয়েছে, যেহেতু অনেক ছোট ব্যবসা এখনও আয়-উন্নতির উদ্দেশ্যে পহেলা বৈশাখের মতো উত্সবের উপর নির্ভর করে, সুতরাং, এটা বলা যেতে পারে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একশত বছরেরও বেশি সময় আগে পহেলা বৈশাখ উত্সবের প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতে সত্যিকারের সাংস্কৃতিক উদযাপনে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, যা সময়ের সাথে সাথে মানুষের চোখে-মুখে আনন্দের হাসি নিয়ে এসেছে।
এই পহেলা বৈশাখের বর্ষবরনের উচ্ছ্বাস আর আনন্দে মাতোয়ারা বিশ্বের সব বাঙালী এবং বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা। বাংলার ভুখন্ডের বাইরে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক বাঙালী বসবাস করছে বিলেতে। তাইতো বিলেতের রাজধানী শহর লন্ডনের বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা টাওয়ার হ্যামলেটসকে তৃতীয় বাংলাদেশ বলা হয়। এই এলাকার ব্রিক লেইনতো আনুষ্ঠানিকভাবেই বাংলা টাউন হিসেবেই পরিচিত। আর তাই আবাহমান বাংলার সব ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, চেনা-পরিচিত শ্যামলা বাংলার জলজ এবং বনজ প্রকৃতির মাটির সোঁদা গন্ধের আমেজ ভেসে উঠে বিলেতের বাংলা পাড়ায়। বাংলা দেশর মতো এখানের বাঙালীরাও “এসো হে বৈশাখের” চিরন্তন সুরে বরন করে নেয় বৈশাখের এই প্রথম দিনটিকে নানা আয়োজনের পসরা সাঁজিয়ে ।গত প্রায় আড়াই যুগেরও বেশী সময় ধরে বৈশাখী মেলার বিশাল মিলন মেলা বসে লন্ডনের এই বাঙ্গালীর এলাকা টাওয়ার হেমলেটসে। বৈশাখের বর্ষবরন একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিনত হয়েছে। তাই বাংলাদেশের বাইরে বিলেত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা সহ বিশ্বের নানা দেশে বাঙালী প্রবাসীরা ধুমধাম এবং নানা সাঁজে এক আরম্ভরপূর্ন জমকালো পরিবেশে পহেলা বৈশাখের আয়োজন করে। বিলেতের লন্ডন ছাড়াও ম্যানচেষ্টার, লিভারপর, ইয়র্কশায়ার, বার্মিংহাম, লীডস, পৌর্টসমাউথ সহ অন্যান্য বাঙালী বসবাসকারী শহরগুলিতে বর্ষবরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তবে লন্ডনে বাংলা টাউনের বৈশাখী মেলার আনন্দের মাত্রাটাই একটু অন্যরকম। কোন কোন বৈশাখী মেলায় প্রায় লক্ষাধীক মানুষের আগমন ঘটে। সারা বৃটেন সহ ইউরোপীয়ান দেশগুলি থেকে বাঙালীরা যুক্ত হয় এ আনন্দমেলায়। যদিও বৈশাখী মেলাটি বিলেতের প্রবাসী বাংলাদেশীরা শুরুর দিকে আয়োজন করতো, তবে পরবর্তীতে তা `বৈশাখী মেলা ট্রাষ্ট` এর মাধ্যমে আয়োজন করা হয়। কিন্তু নানা সমস্যার কারনে ২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ মেয়াদী পরকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখার অঙ্গীকারে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল বৈশাখী মেলা আয়োজনের দায়িত্ব নেয়। সে থেকে মেলাটকে "বাংলাটাউন ব্রিক লেন এ অনুষ্ঠিত একটি বৈশাখী মেলা (a Boishakhi Mela in Banglatown Brick Lane)" । কাউন্সিলের তত্বাবধানে আয়জিত ২০০৯ সালের ১০ মের বৈশাখী মেলায় প্রায় লক্ষাধীক মানুষ অংশগ্রহন করে।
অতীতে লন্ডনের বাংলা টিভি ছিলো এই বৈশাখী মেলার প্রধান সম্প্রচারক। কিন্তু ২০০৫ সাল থেকে চ্যানেল এস সরাসরি সম্প্রচারের দ্বায়িত্বটি পালন করে। এই টিভি চ্যানেলটি স্থানীয় বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের প্রতি বেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং রয়েছে বেশ গ্রহনযোগ্যতাও। ১৯৯৭ সালে খুব ছোট আকারে এই বৈশাখী মেলার যাত্রা শুরু হয় টেমসের তীরের লন্ডনের বাংলা টাউনের প্রানকেন্দ্রে। তারপর থেকেই দিন দিন এর ব্যাপকতা বাড়তে থাকে। মেলাটি বাংলা টাউনের বেথন্যাল গ্রিন এর ওয়েভার্স ফিল্ডস এবং এলেন গার্ডেনস এর এলাকা জুড়ে আয়োজিত হয়। নানা ধরনের সাংস্কৃতীক অনুষ্ঠানমালায় সাঁজানো হয় দিনটিকে। দিনটির শুরু হয় এক বিশাল শোভাযাত্রার সাথে। এটা হলো মেলার গ্র্যান্ড প্যারেড যেখানে আবাহমান বাংলার রুপটকে তুলে ধরা হয়। হাজারো বাঙালীর অংশগ্রহনে এই শোভাযাত্রা রুপ নেয় সত্যিকারের আনন্দ হিল্লোল আর উচ্ছ্বাসের জলসিঁড়িতে। আর তার মাঝে এগিয়ে চলে রঙিন ঐতিহ্যবাহী পোশাক এর নানা রঙ আর আকৃতির মুখোশ পরিধানরত শিশু-কিশোর সহ অংশগ্রহনকারীরা। বাজতে থাকে বাংলার প্রিয় বাদ্য-যন্ত্র ঢাক-ঢোল, বাঁশি, বাউলের একতারা,। `এসো হে বৈশাখের`আগমন গানে পুরো এলাকাটি উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা হয়। এক লহমায় এই মেলাটি হয়ে উঠে বাংলা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক। গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির কি এক গভীর যোগাযোগ রয়েছে এই মেলার সঙ্গে। মেলা মানেই ধর্ম-বর্ন-পেশা-গোত্র নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহনে আনন্দের ধুমধাম আর জীবনের প্রানচঞ্চল্যতা। বাঙালীর সংস্কৃতিতে রয়েছে সব ধর্মের মানুষের সংস্কৃতির সমন্বয় । মেলায় বিনোদনের যেন কোন অভাব থাকে না। গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলার চমৎকার মাধ্যম হলো বিনোদন। তাই লন্ডনের বৈশাখী মেলাকে ঘিরে লোকসংগীত, নাগরদোলা, জারি-সারি, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি লোকগান মুগ্ধ করে আগত দর্শনার্থীদের। গ্রামীণ মৃৎশিল্প ও কারুপণ্যের বিকিকিনি মেলার আরেক আকর্ষণ। সাথে সাথে পুরো মেলাজুড়ে অবস্থিত পিঠা-মিষ্টি, আর নানা পদের বাঙালী খাবারের স্টলগুলি খাদ্যরসিক বাঙালীর মনকে কেড়ে নেয়। তার সাথে পান্তা ভাত আর ইলিশের ব্যাপরটি যেন হয়ে উঠে এই বৈশাখী সংস্কৃতীর একটি গুরুত্বপূর্ন দিক।
লন্ডনে বাংলার এই বৈশাখী মেলাটি সাধারণত এপ্রিলের শেষ রবিবার বা মে মাসের প্রথম দিকে ব্রিক লেন, স্পিটালফিল্ডস মার্কেট এবং পূর্ব লন্ডনের আশেপাশের অন্যান্য স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। এটি স্থানীয় বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের সদস্যদের দ্বারা পরিবেশিত ঐতিহ্যবাহী গান এবং নৃত্য দিয়ে শুরু হয়, তারপরে 'শুভ নববর্ষ' লেখা ব্যানার বহন করে একটি বিশাল জমকালো শোভাযাত্রা। এর পরে চলে বিশাল আয়োজন স্থানীয় পার্কে যেখানে চলে সারাদিন ব্যাপী সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, নৃত্য, বাংলা ফোক সংগীত থকে শুরু করে এই সময়ের জনপ্রিয় সিনেমার গান পরিবেশিত হয় জনপ্রিয় স্থানীয় এবং বাংলাদেশ থেকে আগত জনপ্রিয় শিল্পীদের দ্বারা। ব্রিটিশদের বাংলাদেশী সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি, বাংলা বৈশাখী মেলা বাংলাদেশী জীবনের বিভিন্ন দিক উদযাপন করে। যেমন খাবারের স্টলগুলি সামোসা, তরকারি এবং বিরিয়ানি সহ ঐতিহ্যবাহী খাবার সরবরাহ করে, ফ্যাশনের দোকানে শাড়ি বিক্রি হয়, গহনা চুড়ি দিয়ে সজ্জিত স্ট্যান্ড, শিশুদের রাইড, হস্তশিল্পের স্টলগুলি বাংলাদেশে হস্তনির্মিত জিনিসগুলি প্রদর্শন করে। সময়ের সাথে সাথে, বাংলা বৈশাখী মেলা ব্রিটেনে বসবাসকারী এশীয় সম্প্রদায় এবং অ-এশীয় উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ইভেন্টে পরিণত হয়েছে, যারা প্রতি বছর এই রঙিন উদযাপনে যোগ দিতে একত্রিত হয়। এটি শুধুমাত্র একটি নতুন বছর উদযাপনের বিষয়ে নয়, বরং জাতীয়তা বা ধর্ম নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষকে একত্রিত করার বিষয়েও - এমন কিছু যা এটিকে বিশেষভাবে তাৎপর্যময় করে তোলে।
পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মাধ্যমে সারা বাংলায় বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক নিবীর সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং একই সাথে বাংলার ঐতিহ্যগত মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখে। সামগ্রিকভাবে, পহেলা বৈশাখ হল বাংলার সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা শতাব্দীর পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা অনন্য রীতিনীতি এবং আচার-অনুষ্ঠানের কারণে বাংলা ভূখন্ডে পালিত অন্যান্য উৎসবের মধ্যে আলাদা। এটি কেবল প্রকৃতির অনুগ্রহই উদযাপন করে না বরং বিভিন্ন পটভূমির লোকেদের মধ্যে একতাকে উত্সাহিত করে। তাই বলা যায়, বাংলার সংস্কৃতির জন্য পহেলা বৈশাখের গুরুত্ব অপরিসীম। বৈশাখ এলেই বাঙালীর উদাসী বাউল মন আনন্দের জলসিড়িতে হেঁটে বেড়ায়। আমাদের চেতনায়, ভাবনায়, মননে জেগে উঠে রবীন্দ্রনাথ। যে আনন্দ, সম্প্রীতি, ভালোবাসা আর প্রাঞ্জলতার জ্যোতিরেখা বাঙালীকে এই বৈশাখের দিনটিতে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় সেই আলোর পথ ধরেই যেন আমরা চলতে পারি। তাঁর নান্দনিক ভাবনার পথ ধরেই উদযাপিত হোক পহেলা বৈশাখের এই অনিন্দ্য আয়োজন। উপলক্ষ যাই হোক না কেন বাঙালীর সব উৎসব আর আনন্দমেলার থাকে একটি অসাম্প্রদায়িক এবং সার্বজনীন রুপ। সব ধরনের উঁচু-নীচু, জাত-পাতকে দূরে ঠেলে দিয়ে সকলেই আনন্দের ফোয়ারায় মাতোয়ারা হয় এই উৎসবের দিনটিতে, গড়ে তুলে সকলের মধ্যে প্রেম আর ভালোবাসার সেতুবন্ধন। আর এই কারনেই হয়তো কালের বিবর্তনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার ধরন পাল্টালেও আবহমান বাংলার সামাজিক উৎসব, পার্বণ বা গণমানুষের মেলবন্ধনের ঐতিহ্য-কৃষ্টিগুলো আজও হারিয়ে যায়নি। বরং মহামিলনের উচ্ছ্বাস-উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে উৎসবের সময়। বৈশাখী বর্ষবরন হয়ে উঠুক আমাদের সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক, নান্দনিক জীবনের চেতনা আর সৃজনশীল ভাবনার প্রেরনা।