যে কোন জাতীর জন্ম যন্ত্রনায় মিশে থাকে অনিবার্যতা, অনিশ্চয়তা আর মানসিক আঘাতের বিপর্যয়ের বিষাদগ্রস্থতা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা ছিলো ধ্রুব সত্য। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। বাংলার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মুক্তি যুদ্ধ ছিলো একটি অবিস্বরনীয় মূহুর্ত। বাঙালী এবং এই বাংলা ভুখন্ডের মানুষের জন্য ছিলো প্রত্যয় আর শিড়দারা শক্ত করে বেঁচে থাকার এক অমলীন শ্রাবস্তীয় মাহেন্দ্রক্ষন। ভারত বিভাজনের পর থেকে বছরের পর বছর আমরা পশ্চিম পাকিস্থানিদের অন্যায়, অত্যাচার আর অসহ্য নিপীড়নের আঘাত সহ্য করতে করতে এক সময় হয়ে উঠেছি প্রতিবাদী। শেষ পর্যন্ত অনেক সংগ্রাম, রাজনৈতিক এবং নাগরিক অস্থিরতার পর আমরা অর্জন করেছিলাম বাংলার স্বাধীনতা। শুধুমাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধই নয়, বাঙালীর সংগ্রামের যাত্রাটা ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিলো ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। তার পর থেকেই বাংলার আকাশে নেমে এসেছিলো কালো মেঘেরা, শকুনীর দল মেলেছিলো ভয়ংকর পেখম আর পদ্মা-মেঘনায় ভেসে চলেছিল রক্তের ফুলকী। এক সময় আসে সেই অবিস্বরনীয় দিন যেদিন বাংলার জনগন শুনলো বেঁচে থাকার সেই পরম মন্ত্র। বাংলার প্রবাদপুরুষ স্বপ্ন দ্রষ্টা ৭ই মার্চ তখনকার ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার সমাবেশে শোনালেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো নান্দনিক সংগ্রামী বার্তা-“রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইন্শাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। সেইদিন সেইক্ষনে দ্রোহ আর ভালোবাসায় স্বপ্ন বিভোর বাঙালীর ধমনীতে গর্জে উঠেছিলো প্রতিবাদী হুংকার। মুহুর্তেই মুখরিত হলো সেইদিনের ঢাকার আকাশ-বাতাস, নদী-নালা গাছ-গাছালী। মানুষের সংগ্রামী মনে হিন্দোলিত হলো প্রত্যয় আর উচ্ছ্বাসের বহ্নিশিখা। একদন্ডে মিলিত হলো বাংলার হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান, পাহাড়ী-উপজাতী সৌভাত্রের বন্ধনে। ঝাঁপিয়ে পড়লো স্বাধীকার আন্দোলনে।
অনিকেত সময়ের গন্ডোলায় সংগ্রামী পদে চলতে চলতে একসময় স্বাধীকার আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে রুপ পরিগ্রহ করে। ৭১এর ১৬ই মার্চ থেকে ২৪শে মার্চ পর্যন্ত আপোষ মীমাংসার লোক দেখানো মহড়া করলেন পাকিস্তানের সুচতুর ইয়াহিয়া খাঁন। দফায় দফায় বসলেন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে। কিন্তু তখনো বাংলার জনগন বুঝতে পারেনি যে এই নরপিশাচ ইয়াহিয়া খাঁন মীমাংসার আড়ালে গোপনে তৈরী করছে সে ভয়ানক কালো রাত্রির হত্যাযজ্ঞের নীল নকসা। গোপনে ঢাকা ছাড়লেন ২৫শে মর্চের বিকেলে। বাঙালী নিধনের সেই নীল নকশাটি রেখে গেলেন তার সামরিক দোসরদের হাতে। তার পরের ঘটনা আমরা সবাই জানি। সে ভয়ানক কাল রাত্রির কথা, ২৫শে মার্চের সেই রাত্রে হানাদার বাহিনীর সামরিক বহর নামলো ঢাকার রাস্তায়। ঘুমন্ত মানুষের উপর চললো পৃথিবীর ইতিহাসের এক জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ। সেই ভয়ানক রাতটি ছিলো বাংলার বুদ্ধিজীবিদের হত্যার এক পাশবিক ক্ষন। নরপিশাচ হানাদার বাহিনী ২৬শে মার্চ ৭১এর প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে নিয়ে গেলো প্রথমে ঢাকার কুর্মিটোলায়। তারপর তিন দিন পর অর্থাৎ ২৯শে মার্চ অতি সংগোপনে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্থানের করাচিতে। তার পর পরই শুরু হলো বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়। ফলস্বরূপ, নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আনুমানিক ত্রিশ লাখ লোকের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙালী জাতী পশ্চিমাদের সকল প্রহসন, আর অন্যায়কে প্রতিহত করে উত্তোলিত করলো লাল সবুজের পতাকা। ২৬শে মার্চ ঘোষিত হলো বাংলার স্বাধীনতা। তাই এই দিনটি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জন্য একটি আত্ম-অহংকারের দিন, একটি পবিত্র, আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর সংকল্পের দিন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর বলিষ্ঠ প্রত্যয়ের দিন। বাঙালী সংস্কৃতির বৃত্তায়নে বিকশিত হওয়ার এক পরম অমলীন মূহুর্ত। হাজারো বছরের বাঙালীর স্বপ্ন, আশা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং দর্শন, আমাদের পিতা-প্রপিতামহের মাটিতে হেসে-খেলে বেঁচে থাকার আগ্রহ, আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ঐক্যবদ্ধতার প্রয়াস, ঘর-গেরস্থালী আর মুক্ত চিন্তায় বিকশিত হওয়ার প্রেরনা সব কিছুই জড়িয়ে আছে এই দিনটির সাথে।
“প্রত্যেকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে”। এই আপোসহীন তর্জনীর হুংকার আর অদম্য উচ্ছ্বাসের কন্ঠ নিঃসৃত প্রতিবাদে জাগ্রত চৈতন্য আর তেজস্বিতার অমলীন মহিমায় আবির্ভূত হয়েছিলেন স্বাধীনতার মানসপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান। তার শানিত চেতনার অগ্নি মন্ত্রে সেই দিন সৌভাত্রের বন্ধনে আবদ্ধ হলো সারা বাংলার আমজনতা। বাঙালী জাতীয়তাবাদের অপ্রতিরোধ্য বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার শুরু হয়েছিলো সেই দিন যেদিন বাংলার উদ্যমী মা-মাটি-মানুষকে ভালোবাসা তরুনেরা গর্জে উঠেছিলো মায়ের ভাষাকে পাকিস্তানী বর্বরদের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য। সেই ভাষা আন্দোলনের সময়। ৫২ এর রক্ত ঝরা একুশে যখন বাংলার দামাল ছেলেরা বুলেটের মুখে লুটে পড়েছিলো। করাচির জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকে পাকিস্থানের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য যে প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন তাঁর ন্যায্য প্রাপ্তির জন্য এই ভাষা আন্দোলন হয়ে উঠে বাঙালীর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু। সেইদিন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ন্যায্য দাবিতে বর্বর হুংকারে ফেটে পড়েছিলো খাজা নাজিমুদ্দিন, লিয়াকত আলী খাঁন সহ প্রায় সব মুসলিম লীগের নেতারা। শুধু প্রত্যাক্ষান করেই ক্ষান্ত হননি বরং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ভারতীয় এজেন্ট, ইসলাম বিরোধী, পাকিস্থানের শত্রু ইত্যাদিতে আখ্যায়িত করা হয়। সেই অধিবেশনে ২৯শে মার্চ উর্দুকে পাকস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়ে একটি বিল পাশ করা হয়। পাকিস্থান গনপরিষদে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানে ধীরেন্দ্রনাথের উথ্থাপিত দাবীই সূচনা করে ভাষা আন্দোলনের। সেই থেকে শুরু হলো বাংলার সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়। আমরা বুঝতে পারলাম এই দেশ আমাদের নয়। পাকিস্তানীদের সাথে পরাধীনতার জীবন নিয়ে বেঁচে থাক যাবে না। তাই সে দিন থেকে শুরু হলো আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস।
বাংলাদেশের মানুষেরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এমন একজন ব্যক্তিত্বকে নিজেদের কাছে পেয়েছিলেন যিনি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রুদের মোকাবেলা করতে এবং দৃঢ়তার সাথে সকল বাধা-বিপত্তি ও সংকট মুহুর্তকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজেকে একজন প্রবল ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন যিনি তার জনগণের প্রয়োজন ও দুর্ভোগের সময়ে ছিলেন অতি সংবেদনশীল এক মানবীয় ব্যাক্তিত্ব, আবার একই সঙ্গে প্রয়োজনের মুহূর্তে ছিলেন কঠোর ও নির্মম। অবিচার ও ক্লেশের সময়ে শক্তি এবং দৃঢ় প্রত্যয় সম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে কাছে পাওয়া জীবনের এক বড়ো প্রাপ্তি কারন তাদের ঋজুতা, মানবীক চৈতন্য এবং প্রত্যয়ী মনোভাব আমাদেরকে করে অনুপ্রানিত এবং উজ্জীবিত। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই মহান নেতা যার গতিশীলতা, বুদ্ধিদ্বীপ্ততা, সামাজিক এবং রাজনৈতীক প্রাজ্ঞতা, বাস্তববাদী মানষিকতা তাকে চরম বিপদের সময় একটি নতুন জাতিকে পরিচালনা করতে সক্ষম করেছিলো। তিনি একজন সত্যিকারের পিতা হিসেবে তার মেয়ের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামকে গ্রহণ করেছিলেন, লালন করেছিলেন এবং শুরু থেকেই যে কোন পরিস্থিতিতে তিনি চূড়ান্ত মূল্য দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। সময়ের সাথে সাথে তিনি হয়ে উঠলেন বাঙালী এবং সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বাংলা ভুখন্ডের মানুষেরা ভাগ্য বিধাতা, স্বাধীন বাংলার প্রতিষ্ঠাতা এবং জাতীর পিতা। হয়ে উঠলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক। আর তাইতো তিনি পেরেছিলেন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধান উপহার দিতে। তিনি কখনোই মৃত্যুর ভয়ে উদ্বিগ্ন কিংবা উৎকন্ঠা ছিলেন না। আর তাইতো তার প্রতিবাদী কন্ঠ গর্জে উঠেছিলো বার বার। তার ডাকে সমগ্র বাংলার মানুষ এক কাতারে দঁড়ালো। মুহূর্তের মধ্যেই সসস্ত্র হয়ে উঠলো। বজ্রকন্ঠে এক সাথে ঘোষিত হলো আমরা বাঙালী। ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারী বাংলার ভাগ্য বিধাতা জাতীর পিতা পাকিস্তানের ওয়ালী কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালেন। তারপর ১০ই জানুয়ারী তিনি ফিরে যান সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে। রাষ্ট্রপধান হিসেবে স্বাধীনতা অর্জনের পর এটিই ছিল তার প্রথম বিদেশ সফর। বাংলাদেশে সরাসরি না গিয়ে তিনি কেন এসেছিলেন লন্ডনে। ২৬ ঘন্টা লন্ডনে অবস্থানকালে কি করেছিলেন তিনি, কার কার সাথে দেখা করেছিলেন, কি কি ঘটেছিলো তার জীবনের এই মাহেন্দ্রক্ষনে? টেমসের তীরের নগর কাব্যের এক মহান চরিত্রের এই সফর কালীন সময়ের কিছু অবিস্বরনীয় ঘটনার জলসিড়িতে আলোকপাত করবো নগর কাব্যের এই এপিসোডে।
“একাত্তরের মুজিব” বইটির লেখক মহিউদ্দিন আহম্মদ। তিনি লন্ডনে শেখমুজিবুর রহমানের অবস্থানকালের বিবরন দিয়েছেন বাংলাদেশি কুটনৈতিক রেজাউল করিমের ভাষ্যে। সেই সময় অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারী সকাল ৭টায় এবং দ্বিতীয়বার সকাল ৮টায় ইসলামাবাদে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার জন পামফ্রের বাসায় ফোন আসে। তিনি তখন বাসায় ছিলেন না। প্রাতভ্রমনে বেড়িয়েছিলেন। সকাল ৯টায় তিনি পাকিস্থানের পররাষ্ট দপ্তরে আসেন এবং পাকিস্থানের সরকারের পক্ষ থেকে একটি বার্তা গ্রহন করেন। নির্দেশ মোতাবেক বৃটিশ হাইকমিশনার সেই বার্তাটি পড়ে স্থানীয় সকাল সোয়া নটায় লন্ডনে ফরেন এন্ড কমনওয়েল্থ অফিসে একটি টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রামটির মূল বার্তা ছিলো” মুজিব হিথরো আসছেন ৮ই জানুয়ারী। পাকিস্তান সরকারের অনুরোধ : বিমানে তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে সরাসরি যেন ভিআইপি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়ি পাওয়া গেলে তাঁকে তাঁর ইচ্ছামাফিক স্থানে নিয়ে যেতে হবে, এবং তিনি মুখ খোলার আগে এটা যেন প্রচার করা না হয়”। সেই সময় ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান ছিলেন ইয়ান সাদারল্যান্ডে। তার হাতে তারবার্তাটি যখন আসে তখন লন্ডনে দিবাগত রাত ৩টা। পাকিস্থান সরকারের ইচ্ছাতেই রাওয়ালপিন্ডি থেকে পাকিস্থান সরকারের চাটার করা পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে (ফ্লাইট নম্বর-৬৩৫) লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বংলাদেশ সহ সারা বিশ্ববাসীর নজর তখন লন্ডনের দিকে। লন্ডনে যখন পোঁছান তখন স্থানীয় সময় সকাল প্রায় সাড়ে ছয়টা। ভোরবেলা সাদারল্যান্ড হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান। তদানীন্তন লন্ডনে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত মিশনপ্রধান রেজাউল করিমের ফোন নম্বরটি ইয়ান সাদারল্যান্ড ড. কামাল হোসেনকে দেন। তিনিই প্রথম রেজাউল করিমকে সকালে ফোন করে বঙ্গবন্ধুর সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দেন। তাড়াতাড়ি তিনি মিশনের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহম্মদকে ব্যাপারটা জানান এবং বিমান বন্দরে যাওয়ার জন্য রেডি হতে বলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই রেজাউল করিম, মহিউদ্দিন আহমদকে নিয়ে ছুটলেন হিথরো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানাতে। তাদের সাথে ছিলেন মহিউদ্দিন জায়গীরদার, যিনি ওই সময় নাইজেরিয়ার পাকিস্তান দূতাবাস থেকে পক্ষ ত্যাগ করে লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। হিথ্রো বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধু তিন ঘন্টা অবস্থানকরেন। অতি ব্যাস্ততার মধ্যে জাতীর পিতা ২৬ ঘন্টা লন্ডনে কাটিয়েছিলেন।
হিথ্রো থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হলো হোটেল ক্লারিজেসে। যদিও বঙ্গবন্ধু সেখানে না গিয়ে বরং রাসেল স্কয়ারে অবস্থিত অল্প দামের হোটেল প্রসিডেন্টেই যেতে চেয়েছিলেন। খরচের কথা ভেবেই এই প্রস্তাবটি করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ মিশন প্রধান সাদারল্যান্ডের সাথে আলোচনা কর ক্লারিজেসে নিয়ে যওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই হোটেলে অতীতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীও থেকেছেন। বঙ্গবন্ধুকে এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি বৃটিশ সরকারের দেয়া একটি লিমোজিনে করে হোটেলে নিয়ে আসা হয়। সেদিনের হোটেলের দৃশ্যটি ছিলো একেবারেই ভিন্ন। প্রিয় নেতাকে এই হোটেলে নিয়ে আসছে এই খবরটি যেন ছড়িয়ে পড়ে বিদুৎবেগে। গনমাধ্যমের প্রতিনিধি সহ অসংখ্য বাংলাদেশীরা হোটেলে ভীর জমালো এই প্রিয় নেতাকে এক নজর দেখার জন্য। চোখে মুখে সবার বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের উচ্ছ্বাস। কারো কারো চোখে আনন্দাশ্রু। শুধুমাত্র সাধারন জনগনই নন। বিশিষ্ট গন্যমান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য। তাদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন, কমনওয়েলথের মহাসচিব আরনল্ড স্মিথ, সাবেক মন্ত্রী পিটার শোর সহ বহু সংসদ সদস্য ও অন্যরা। সেই সময় বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে ছিলেন না। ছুটিতে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে আসার সংবাদটি শুনে তিনি ছুটি থেকে তড়িঘড়ি করে লন্ডনে ফিরে আসেন এবং সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের মেহনতী মানুষের এই নেতাকে ১০ নম্বর ডাউনিং ষ্ট্রীটে আমন্ত্রন করেন। বিকেল পাঁচটায় বঙ্গবন্ধু হাজির হলেন বৃটিশ প্রধান মন্ত্রীর বাসবভনে এবং সেখানে দুজনে এক একান্ত সক্ষাৎকারে বসেন। আলোচনার এক পর্যায়ে বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন “আপনাকে আর কী সহযোগীতা করতে পারি, বলুন”। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন, আমার একটা বিমান চাই। আমি খুব দ্রুত দেশে ফিরতে চাইছি”।এডওয়ার্ড হিথ ব্যবস্থা নিলেন সঙ্গে সঙ্গে।
হোটেল ক্ল্যারিজেসে এসে ভীড় জমালো বিশ্বের নানা দেশের সাংবাদিকরা। কিন্তু এতো জনের সাথে আলাদাভাবে দেখা করা কার্যত সম্ভব নয় বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সংবাদ সন্মেলনের। সেই সময় বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন প্রখ্যাত সংবাদিক সিরাজুর রহমান। তিনি একটু নারাজ হলেন। প্রখ্যাত টিভি ব্যক্তিত্ব ডেভিড ফ্রস্টও খুশি হলেন না। যদিও পরবর্তীতে তাদেরকে বঙ্গবন্ধুকে সন্মান প্রদর্শনের জন্য কয়েক মিনিট দেয়া হলো সাক্ষাতের জন্য। তখন বিকেল ছুঁই ছুঁই। এক সময় শুরু হলো প্রান প্রিয় এই নেতার সংবাদ সন্মেলন। যদিও সংবাদ সন্মেলনটি শুরু হয়ছিলো ২০ মিনিট দেরীতে। সেদিন হোটেলের প্রধান কনফারেন্স হল ছিলো লোকে লোকারন্য। ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ বেজে চলেছে অনবরত। বাংলাদেশ মিশন প্রধান বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছু বললেন শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে। খুব মনোযোগ দিয়ে সকলেই বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো শুনলেন। “জয় বাংলা” স্লোগান দিয়ে সাংবাদিকদের অভিনন্দিত করেন প্রিয় নেতা। বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতার সুরে যুক্তরাজ্য সহ বিশ্ববাসীকে ধন্যবাদ জানান এবং জাতীর সংকট মুহুর্তে বাংলাদেশের মানুষের পাশে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। বঙ্গবন্ধুর সফরটি সাফল্যের সাথেই শেষ হয়েছিল। তিনি শুধু বাংলাদেশী সংগ্রামের প্রতি প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই সক্ষম হননি বরং তিনি বিদেশী সরকারগুলির কাছ থেকে যুদ্ধোত্তোর বিধ্বস্ত বাংলাদেশের বিনির্মানে সহায়তা এবং স্বীকৃতি দেয়ার জন্য উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও লাভ করেছিলেন। সংবাদ সন্মেলনে সাংবাদিকরা একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন। ঢাকার পরিবর্তে লন্ডনে আসার কারন জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিলেন “আমি বন্দি ছিলাম। এটি পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছে, আমার নয়। আমি এখানে কতক্ষণ থাকব তা জানি না। তবে লন্ডন ত্যাগের আগে আমি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করার আশা করছি”। (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ জানুয়ারি ১৯৭২)। লন্ডনে অবস্থান কালীন সময়েই ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলেন এবং নয়াদিল্লি সফরের আমন্ত্রণ জানান। ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবুর রহমানের কুশল জানতে চেয়ে বলেন, ‘আমরা খুবই খুশি আপনি মুক্তি পেয়েছেন।’ শেখ মুজিবুর রহমান ইন্দিরা গান্ধীর মাধ্যমে ভারতের জনগণকে অভিনন্দন জানান। এরপর ইন্দিরা গান্ধী জানতে চান, ‘কেমন আছেন?’বঙ্গবন্ধু স্বভাবজাত কন্ঠে কৃতজ্ঞতা জানান এবং ভালো আছেন বলে উত্তর দেন।
২৬ ঘন্টা ব্যস্ততম সময় পাড় করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এবার তার দেশে ফেরার পালা। কোটি জনতা অধীর আগ্রহে প্রতিক্ষা করছেন সকলের প্রিয় নেতাকে গ্রহন করার জন্য, একটা নজর দেখার জন্য অথবা তার মুখনিঃসৃত কথাগুলো শুনার জন্য। এক দন্ডও আর সহ্য হচ্ছেনা সদ্য স্বাধীন হওয়া এই বাংলার মানুষদের। কখন আসবে জাতীর পিতা? ৯ই জানুয়ারী ১৯৭২ দিল্লী হয়ে ঢাকায় যওয়ার জন্য বৃটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুর জন্য রয়্যাল এয়ারফোর্সের কমেট নামের একটি বিশেষ বিমানের ব্যাবস্থা করলেন। নিরাপত্তার জন্য ফিরে যাওয়ার দিন এবং সময়টাকে গোপনকরা হয়েছিলো। সে মোতাবেক হোটেল থেকে সামনের দরজা দিনে না বেড়িয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হলো বিমান বন্দরে। সকাল সাতটায় বঙ্গবন্ধু সহ তার সহযাত্রীদের নিয়ে বিমানটি হিথ্রো বিমান বন্দর ছেড়ে যায়। তার পরের দিন অর্থাৎ ১০ই জানুয়ারী বিমানটি ওমান এবং সাইপ্রাস হয়ে নয়া দিল্লীর পালাম বিমান বন্দরে (ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) অবতরন করে। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিসভার সদস্য ও শীর্ষ কর্মকর্তারা বাংলাদেশের জাতির পিতাকে ঐতিহাসিক অভ্যর্থনা জানান। সেইদিনই জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেন। তার পরে বেশ কয়েকবার লন্ডনে এসেছিলেন জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গলব্লাডারের অপারেশন করতে এসছিলেন ১৯৭৩ সালের ২৭শে জুলাই। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ,শেখ কামাল, শেখ রাসেল সহ আরো বেশ কয়েকজন তার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। গ্রেট পোর্ট ল্যান্ড স্ট্রিটের লন্ডন ক্লিনিকে গল ব্লাডারের সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয় বঙ্গবন্ধুর। সৈয়দ মোজাম্মেল আলীর স্মৃতিচারণে জানা যায় তিনি সহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু, নজরুল ইসলাম, জনমতের তৎকালীণ সম্পাদক অলি আশরাফ দেখা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। সেই সময় প্রায় তিন সপ্তাহ ছিলেন। ।
স্বপ্নাদ্রষ্টা এই মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে একদিন ভবিষ্যত বাংলাকে নিয়ে উচ্ছসিত কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিলো “আমি চাই আমার দেশ এমন একটি জায়গায় পৌঁছুবে যেখানে মানুষ জাতি বা ধর্মে বিভক্ত না হয়ে শান্তিতে ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করবে, যেখানে সকল নাগরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে, যেখানে সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের পূ্র্ন বাস্তবায়ন হবে, যেখানে নারী পুরুষেরা সমান অধিকার ভোগ করতে পারবে, সবার শিক্ষার সুযোগ থাকবে, যেখান থেকে দারিদ্র্যতা এবং ক্ষুধা চিরতরে বিলুপ্ত হবে”। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন তার হাতে গড়া বাংলাদেশ এক কঠিন দুঃসময়ের বৈতরনী পাড় হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় আশার আলো হয়ে উঠবে। আজ এই প্রিয় নেতার দেশ অর্থনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কালের বিবর্তনের ধারায় আর তার যোগ্য উত্তরসূরী কন্যা শেখ হাসিনার সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা বাংলাদেশকে করেছে গর্বিত। অর্থনৈতিক বিকাশের অভাবনীয় সুযোগের সুফলতা পাচ্ছে বাংলার জনগন। বাংলাদেশের অভ্যুথ্থানে, সাংস্কৃতিক সংগ্রামে, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একটি স্বাধীন মুক্ত দেশ উপহার দেওয়া পর্যন্ত যে অকুতোভয় মানুষটি আপোষহীনভাবে সংগ্রাম করে গেছেন তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে বিশ্ব মেহনতী মানুষের হৃদয়ে। সেই দিনের টেমসের বুকে রৌদ্রকরোজ্জ্বল শীতের সকালে যে শব্দের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়েছিলো এই বিশ্বনেতার আগমনে তা ধারন করে টেমসের তীরের নগর কাব্য হলো আরো ঋদ্ধ এবং তাৎপর্যপূর্ন।
(তথ্যসূত্র: দেনিক ইত্তেফাক, বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা টাইমস, বিএসএস নিউজ, মহিউদ্দিন আহম্মদের একাত্তরের মুজিব, শামসুল হুদা চৌধুরী (একাত্তরের বিজয়),