বাংলা, বাঙালী এবং হাজারো বছরের ইতিহাস, দর্শন, কৃষ্টি-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ শতো শতো নদ-নদী, গিরী-শৃঙ্গের বৃত্তায়ন ঘেরা ভারতবর্ষের বাংলা ভূখন্ডের প্রবাদ পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাঁর লিখনিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছে ঋজুতা, প্রান আর নান্দনিকতার ছোঁয়া। এনে দিয়েছে পৃথিবীর মানুষের হৃদয়ে নন্দিত স্থান, ছিলেন একজন মহান মানুষ, মানবতার প্রতীক, দার্শনিক, ভারতের মেসিয়ানিক কবি,দেশপ্রেমিক, চিত্রকর, গীতিকার, সুরকার। বাংলাদেশ এবং ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা। তাছাড়াও সর্বাধিক প্রচলিত মত অনুসারে শ্রীলঙ্কার সুরকার আনন্দ সামারাকুন ভারতীয় বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং প্রভাবিত হয়ে শ্রীলংকার জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ঠাকুর ছিলেন প্রথম অ-ইউরোপীয় এবং বাঙালী যিনি সাহিত্যে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যকে করেছেন বিশ্ব নন্দিত, বাঙালি নবজাগরণের মূল উদ্যোক্তা। অহিংসা মতাদর্শের মাধ্যমে রবি ঠাকুর বিংশ শতাব্দীর উন্মাদনা, সামাজিক অস্থিতিশীলতা আর রাজনেতিক দূর্বৃত্তায়ন সহ অসুস্থ এবং অশান্ত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিশ্ব শান্তির একটি নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছিলেন। যিনি বিশ্বকে উপহার দিয়েছিলেন এক বিশাল সাহিত্য ভান্ডার এবং বাংলা ভাষাকে করেছিলেন সমৃদ্ধ। এ মহান বিশ্ব কবি নিজকে আরো ঋদ্ধ এবং অন্যকে তাঁর সাহিত্যের সাথে পরিচয়ের নিমিত্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। পাঁচটি মহাদেশের ত্রিশটিরও বেশি দেশ পরিদর্শন করেছেন তিঁনি। অবাঙালিদেরকে তাঁর সাহিত্য কাজের সাথে যুক্ত করতে এবং তাঁর দার্শনিক মতাদর্শকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিঁনি ভ্রমন করেছেন। তাঁর এই ভ্রমণগুলির অনেকগুলিই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯১২ সালে তাঁর ইংল্যান্ডে সফর। যেখানে তার লেখাগুলো অ্যাংলো-আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, রবার্ট ব্রিজস, আর্নেস্ট রাইস, টমাস স্টার্জ মুরকে, মুগ্ধ করেছিলো। ঠাকুর উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড হিথের হিথ ভিলাসে কয়েক মাস বসবাস করেছিলেন, যেখানে বসে তিনি তাঁর বিখ্যাত কবিতা সংকলন 'গীতাঞ্জলি' অনুবাদ করেন। কবি ইয়েটস গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের মুখবন্ধ লিখেছিলেন। টেমসের তীরের নগর কাব্যে এই মহান বিশ্ব নন্দিত কবি গীতাঞ্জলীর রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লন্ডন জীবনের কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে নিয়ে আলোকপাত করবো ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম বিখ্যাত ভারতীয় কবি, লেখক এবং দার্শনিক। ভারতীয় সংস্কৃতি ও শিল্পে তাঁর অপরিসীম অবদানের কারণে তিনি "আধুনিক ভারতের জনক" নামেও পরিচিত। ঠাকুর ১৮৬১ সালে একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং অল্প বয়স থেকেই তিনি ভারতের সাহিত্য ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে নিমগ্ন ছিলেন। তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন দার্শনিক এবং ধর্মীয় সংস্কারক, অন্যদিকে তাঁর মা সারদা দেবী ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা মহিলা যিনি তাঁর মধ্যে সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতি গভীর ভালোবাসা জাগিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান এবং অষ্টম পুত্র। তার বড় ভাই, সত্যেন্দ্রনাথ, প্রথম ভারতীয় যিনি লন্ডনে আইসিএস প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন এবং পাস করেছিলেন। তিনি বোম্বেতে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। ঠাকুর বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে ১৮৭৮ সালে ইংল্যান্ডে যান। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন তার ছেলে ব্যারিস্টার হবে। পিতার ইচ্ছা পূরনের আশায় ইংল্যান্ডের ইস্ট সাসেক্সের ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। মেদিনা ভিলাসের ব্রাইটন এবং হোভের কাছে ঠাকুর পরিবারের মালিকানাধীন একটি বাড়িতে তিনি কয়েক মাস অবস্থান করেছিলেন। তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে কিছুদিনের জন্য আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেন কিন্তু পড়াশুনায় তেমন মন বসাতে পারলেন না। তাই প্রথাগত পড়াশুনা ছেড়ে দেন। তাঁর স্বাধীনচেতা মন যেন স্কুলের ধরা বাঁধা গন্ডিতে আর টিকতে পারছিলনা। তাই স্বাধীন ভাবে অধ্যয়নের জন্য বেছে নেন শেক্সপিয়রের নাটক কোরিওলানাস, অ্যান্টনি এবং ক্লিওপেট্রা এবং টমাস ব্রাউনের খ্রীষ্টিয়ান শাস্ত্রীয় বই রিলিজিও মেডিসিকে। শেষ পর্যন্ত ১৮৮০ সালে, ঠাকুর ডিগ্রি না নিয়েই ভারতে ফিরে আসেন। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, সেই প্রথম বিলেত সফরের সময় তিঁনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পার না হতে পারলেও জীবন দর্শন এবং প্রাচ্যাত্য শাস্ত্রীয় সাহিত্য, সঙ্গীত এবং সংস্কৃতির জ্ঞানটুকু বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন যা পরবর্তীতে তাঁর জীবন ও সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলো। তার চিন্তাধারায় নিয়ে এসেছিলো ঋজুতা এবং শাস্ত্রীয় নান্দনিকতা।
মুখস্ত বিদ্যার প্রতি ঠাকুরের প্রতিরোধ এবং ভয়ানক নেতিবাচকতার কারনে ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে মাত্র পাঁচজন শিক্ষার্থী নিয়ে একটি পাঠভবন তৈরি করেন। মুক্ত চিন্তা এবং সৃজনশীল শিক্ষার উন্মেষ ঘটানোই যার মূল উদ্দ্যেশ্য ছিলো। ঠাকুরের চিন্তা-ভাবনায় বিশেষ প্রভাব ছিলো পারিবারিক দার্শনিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশ। ঠাকুরের পরিবার ব্রাহ্ম আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে সংপৃক্ত ছিলেন। ব্রাহ্ম আন্দোলন ছিল একটি ধর্মীয় আন্দোলন যা আধুনিক বিশ্বের প্রয়োজনের সাথে খাপ খাইয়ে হিন্দুধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিলো। ঠাকুর প্রথাগত নিয়মে নয় বরং বাড়িতেই প্রাইভেট টিউটরদের দ্বারা লেখা পড়া করেই সত্যিকারের শিক্ষীত হয়েছিলেন। তিনি ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর সাহিত্য জীবনের ভাবনায় বার বার ধরা দিয়েছে বিজ্ঞান ভিত্তিক দার্শনিক ধারনাগুলি যা তাঁর অনেক লেখায়ই প্রতিফলিত হয় ব্যাপকভাবে। ঠাকুর তাঁর কবিতায় প্রায়ই গভীর আধ্যাত্মিক এবং প্রাকৃতিক বিশ্বের সৌন্দর্য সম্পর্কে লিখেছেন নানাভাবে ছন্দের পর ছন্দ বসিয়ে। তিনি প্রেমের শক্তিতেও বিশ্বাস করতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে সত্যিকারের প্রেম সমস্ত বাধা এবং যাবতীয় জাগতিক দূর্ভাবনাকে অতিক্রম করতে পারে। তাঁর সাহিত্যে এবং সংগীতের নানা শাখা-প্রশাখায় দ্বীপ্ততার সাথে প্রভাব বিস্তার করেছে বিলেতে ভ্রমনকালীন সময়ে শেখা, জানা এবং পঞ্চ ইন্দ্রীয়ের মাধ্যমে রপ্ত করা প্রাচ্যাত্যের সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং দর্শন।
ঠাকুর বিলেতে বেশ কয়েকবার ভ্রমন করেছিলেন তাঁর জীবদ্দশায়। ইউকের অপেন ইউনিভার্সিটির আর্খাইভের উৎস মতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নয় বার বিলেতে এসেছিলেন। কখনো থেকেছেন দীর্ঘ কয়েক মাস, কখনো বা স্বল্প সময়ের জন্য। তাঁর প্রথম সফরকালীন সয়টা ছিলো ১০ই অক্টোবর ১৮৭৮ থেকে ফেব্রুয়ারী ১৮৮০। প্রায় সতের মাস কাটান সেই সময়। পড়াশুনার উদ্দ্যেশ্যে তাঁর পিতা তাঁকে লন্ডনে পাঠান। কিন্তু পড়াশুনা যে শেষ করতে পারেন নি তা আগেই উল্লেখ করেছি। তার পরের ভ্রমনগুলোর সময় ছিলো যথাক্রমে-১০ই সেপ্টেম্বর ১৮৯০ থেকে ৯ই অক্টোবর ১৮৯০, ১৬ই জুন ১৯১২ থেকে ১৯ই অক্টোবর ১৯১২, ১৯ই এ্রপ্রিল ১৯১৩ থেকে ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯১৩, ৫ জুন ১৯২০ থেকে ৬ই আগষ্ট ১৯২০, ২৪শে মার্চ ১৯২১ থেকে ১৬ই এপ্রিল ১৯২১, ৪ই আগষ্ট ১৯২৬ থেকে ২০শে আগষ্ট ১৯২৬, ১১ই মে ১৯৩০ থেকে জুলাই ১৯৩০। সেই বছরই ২২শে ডিসেম্বর আবারো বিলেত সফর করেন এবং জানুয়ারী ১৯৩১ দেশে ফিরে যান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক ভারত এবং মেট্রোপলিটান ব্রিটেনের মধ্যে ভ্রমণে বহু বছর অতিবাহিত করেন। তার এই ভ্রমনের মাধ্যমে উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সফল প্রাচ্য আর প্রাচ্যাত্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে একটি দৃঢ় সেতু বন্ধন তৈরী করেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই পারিবারীক, সামাজিক এবং তার নিজস্ব সৃজনশীল সাহিত্য চর্চার কারনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছিল যথেষ্ঠ।
১৯১২ সালের প্রথম দিকে ঠাকুরের লন্ডনে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সুস্থ হয়ে উঠার জন্য পদ্মা নদীতে অনেক সময় কাটিয়েছিলেন। সেই বছরের শেষের দিকে তিনি যখন লন্ডনে যান এবং তখনই তিনি ইংরেজিতে "গীতাঞ্জলি" থেকে তাঁর রচনাগুলি অনুবাদ করেন। ইন্ডিয়ান সোসাইটি বইটি প্রকাশ করে। বইটি প্রকাশ হওয়ার পর পরেই তিঁনি হয়ে উঠেন নন্দিত ও বিখ্যাত। সেই সফরকালীন সময়ে গান্ধী-শিষ্য ধর্মপ্রচারক যাজক চার্লস এফ অ্যান্ড্রুস, আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস এবং ইংরেজ কবি-শিল্পী টমাস স্টার্জ মুর তাঁর কাজের ভক্ত হয়ে ওঠেন। উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড হিথের হিথ ভিলাসের যে তিন বেডরুমের বাড়িটিতে থাকতেন সেটি এখন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অধিগ্রহণের কথা বলা হচ্ছে। ২০১৫ সালে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন যুক্তরাজ্য সফরে আসেন, তখন তিনি লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনকে পশ্চিমবাংলা সরকারের পক্ষে সেই সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে বিখ্যাত কবি ও লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ঐতিহাসিক বাড়িটিকে একটি জাদুঘর-কাম-স্মৃতিতে রূপান্তর করা হবে। তবে তার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে আর কোন অগ্রগতি হয়নি (তথ্যসূত্র-রিপাবলিক ডট কম)। সে বাড়ীতে থাকাকালীন, ঠাকুর শিল্পী ও লেখক স্যার উইলিয়াম রথেনস্টাইনকে গীতাঞ্জলি সংগ্রহটি দেখান, যিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি এটি ডব্লিউবি ইয়েটসের কাছে পাঠিয়েছিলেন। সেই বছরের ৭ই জুলাই রথেনস্টাইনের বাড়িতে ইয়েটস গানগুলি পড়েন এবং সেই সময় শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন অ্যালিস মেনেল এবং এভলিন আন্ডারহিল। হ্যাম্পস্টেডের হিথের এই ভিলাতে একটি নীল ফলক দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে লেখা আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১-১৯৪১ ভারতীয় কবি ১৯১২ সালে এখানে অবস্থান করেছিলেন (উৎস: ইংলিশ হেরিটেজ)। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলীর জন্য ঠাকুর নোবেল পুরুস্কারে ভূষিত হন। রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেন বিশ্ব কবি। ১৯১৫ সালের জন্মদিনের সম্মানে রাজা পঞ্চম জর্জ তাকে নাইটহুড প্রদান করেন, কিন্তু ১৯১৯ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর ঠাকুর তা ত্যাগ করেন। পান্জাবের জলয়ানওয়ালাবাগের নিশংস হত্যাকান্ডে শতো শতো নিরীহ মানুষ প্রান হারায়। নাইটহুড ত্যাগ করে, ঠাকুর ভারতের তৎকালীন ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডকে সম্বোধন করে একটি চিঠিতে তিঁনি তাঁর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন (উমা দাশগুপ্ত, ২০০৪)।
ভারতের সংস্কৃতি ও দর্শন সম্পর্কে বক্তৃতা দেওয়ার পাশাপাশি, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ইংল্যান্ডে থাকার সময় বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু বই, যেমন গ্লীমসেস অব বেঙল লাইফ (লন্ডন: লুজাক অ্যান্ড কোং, ১৯১৩), দা গার্ডেনার (লন্ডন: ম্যাকমিলান, ১৯১৩), সাধনা (১৯১৩), চিত্রা (ইন্ডিয়ান সোসাইটি, ১৯১৪), কবির ১০০টি কবিতা (ইন্ডিয়ান সোসাইটি, ১৯১৫), হান্ড্রেড স্টোন্স এন্ড আদার স্টরিজ (১৯১৬), মাসি এন্ড আদার স্টরিজ (১৯১৮), হোম এন্ড দা ওয়াল্ড (১৯১৯), গোরা (১৯২৩) ইত্যাদি। যা তাকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছিল সমগ্র ইউরোপের লোকেদের মধ্যে যারা তার কাজের গভীর প্রশংসা করেছিলেন। ইংল্যান্ড জুড়ে বেশ কয়েকবার ভ্রমণ করার পর, রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় ফিরে আসেন, কিন্তু তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে ব্রিটিশ মাটিতে একটি অমোঘ চিহ্ন রেখে গিয়েছিলেন যা আজও প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে। ঠাকুর ইংল্যান্ড সফরের সময় অনেক স্বনামধন্য ব্যাক্তিদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, জর্জ পঞ্চম, কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস এর মতো বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যক্তিত্বের সাথে দেখা করেছিলেন। এই সাক্ষাৎগুলি ঠাকুরের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ তারাই ভারতের বাইরের শ্রোতাদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে সাহায্য করেছিল ঠাকুরকে, যা সেই সময়ে তার আগে অন্য কোনো ভারতীয় লেখক বা চিন্তাবিদ অর্জন করেননি। পরবর্তীতে তার লেখার শৈলীকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করছে পাশ্চাত্য সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তার নতুন উপলব্ধির কারণে। উদাহরণস্বরূপ, ইয়েটসের সাথে সাক্ষাতের পরবর্তীতে লেখা ঠাকুরের গল্পগুলিতে আগের চেয়ে বেশি প্রতীকী ব্যবহার শুরু করেছিলেন। ইয়েটসের অনেক কবিতায় পৌরাণিক কাহিনী বা কিংবদন্তি জড়িত বিষয়বস্তু রয়েছে। সুতরাং, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য এই ভ্রমণগুলি কতটা উপকারী ছিল তা স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের বন্ধুত্ব ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত সাহিত্যিক বন্ধুত্ব। যদিও উভয় বিখ্যাত কবি বিভিন্ন ভাষায় লিখেছেন, সাহিত্যের প্রতি তাদের অভিন্ন প্রেম এবং পারস্পরিক প্রশংসা এক অনন্য বন্ধনের দিকে পরিচালিত করেছে যা বিশ্ব সংস্কৃতিতে তার ছাপ রেখে গেছে। ১৯১২ সালে ইংল্যান্ড সফরের সময় 'দ্য লেক আইল অফ ইনিসফ্রি' পড়ার সময় ঠাকুর প্রথম ইয়েটসের কাজের মুখোমুখি হন। তারপর তিনি 'ইনিসফ্রি' শিরোনামের নিজের কবিতা লেখেন, যা ইয়েটসের কাজ থেকে অনুপ্রাণিত বলে মনে করা হয়। ২৭ জুন, ১৯১২-এ ফটোগ্রাফার উইলিয়াম রোথেনস্টাইনের বাড়িতে ঠাকুর এবং ইয়েটস প্রথমবারের মতো দেখা করেছিলেন। রোথেনস্টাইন এর আগে ইয়েটসকে পাঠিয়েছিলেন ঠাকুরের গীতাঞ্জলির আংশিক অনুবাদের পাণ্ডুলিপি। দুই কবি একে অপরের বইয়ের কপি বিনিময় করেছিলেন। ঠাকুর ইয়েটসকে গীতাঞ্জলির একটি খোদাই করা কপি দিয়েছিলেন যখন ইয়েটস ঠাকুরকে কুল এ দ্য ওয়াইল্ড সোয়ান্সের একটি অটোগ্রাফযুক্ত কপি উপহার দিয়েছিলেন। একে অপরের থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসবাস করা সত্ত্বেও, তাদের বন্ধুত্ব ভৌগলিক সীমানা অতিক্রম করে হয়ে উঠে অটুট। সাহিত্যের প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং আবেগ তাঁদের সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করে তুলে।
ঠাকুরের জীবদ্দশায় তিঁনি পড়েছিলেন বিশ্ব জয়ের মুকুট, ভূষিত হয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী হিসেবে, হয়েছিলেন বিশ্ব নন্দিত, পেয়েছিলেন কোটি মানুষের সন্মান, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা, আরোহন করেছিলেন খ্যাতির শিখরে, এক জীবনে এতো কিছু পাওয়া কারো জন্য হয়তো সম্ভব নয় কিন্তু রবী ঠাকুর যেন ছিলেন একটু আলাদা। এতো কিছুর পরেও এই মহান কবির ভাগ্য যেন লেখা ছিলো অন্য কিছু। প্রচুর বেদনা, বিষণ্ণতা এবং উন্মাদনার বাতাবরনে বাঁধা ছিলো তাঁর জীবন। আর তাইতো দেখি ঠাকুরের জীবন ছিলো ট্র্যাজিডিতে ভরা। এটাই কি ছিল কোন বাঙালি অভিজাত পরিবারের বৈশিষ্ট্য? কবি, সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক দীপংকর গৌতম বলেন “দুঃখ কাকে বলে এর প্রায় সবই কবিগুরু পেয়েছিলেন এক জীবনে।“ সত্যিই তাই। স্ত্রী মারা গেলেন কবির ৪১ বছর বয়সে। কবির ছিলো তিন মেয়ে, দুই ছেলে। রথীন্দ্রনাথ, শমীন্দ্রনাথ আর বেলা, রেনুকা ও মীরা। স্ত্রী'র পর অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন রাণী (রেনুকা)। এরপর কলেরায় মারা গেলো ছোট ছেলে শমী। পুত্রশোকে কবি লেখলেন- "আজ জোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে।" কবি'র মনে হলো এই জোৎস্নায় কবি বনে গেলে হবে না। বরং তাঁকে জেগে থাকতে হবে, যদি বাবার কথা মনে পড়ে শমী'র! যদি এসে কবিকে না পায়? তিনি লেখলেন- "আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে যদি আমায় পড়ে তাহার মনে।' রাণীর জামাইকে পাঠিয়েছিলেন কবি বিলেতে ডাক্তারী পড়তে, না পড়েই ফেরত আসলো। বড় মেয়ের জামাইকে পাঠিয়েছিলেন বিলেতে, ব্যারিস্টারী পড়তে, না পড়েই ফেরত আসলো। ছোট মেয়ে মীরা (অতশীর) জামাইকেও আমেরিকায় পাঠান কৃষিবিদ্যার উপর পড়াশোনা করতে। লোভী এই লোক কবিকে বার বার টাকা চেয়ে চিঠি দিতো। কবি লেখলেন- "জমিদারী থেকে যে টাকা পাই, সবটাই তোমাকে পাঠাই।" দেশে ফেরার কিছুদিন পর ছোট মেয়েটাও মারা গেলো। সবচাইতে কষ্টের মৃত্যু হয় বড় মেয়ের। বড় জামাই বিলেত থেকে ফেরার পর ছোট জামাইর সাথে ঝগড়া করে কবির বাড়ী ছেড়ে চলে যায়। মেয়ে বেলা হয়ে পড়েন অসুস্থ। অসুস্থ এই মেয়েকে দেখতে কবিগুরু প্রতিদিন গাড়ী করে মেয়ের বাড়ী যেতেন। কবিকে যত রকম অপমান করার এই জামাই করতেন। কবির সামনে টেবিলে পা তুলে সিগারেট খেতেন। তবু কবি প্রতিদিনই যেতেন মেয়েকে দেখতে। একদিন কবি যাচ্ছেন, মাঝপথেই শুনলেন বেলা মারা গেছে। কবি শেষ দেখা দেখতে আর গেলেন না। মাঝপথ থেকেই ফেরত চলে আসলেন। হৈমন্তীর গল্প যেন কবির মেয়েরই গল্প! শোক কতটা গভীর হলে কবির কলম দিয়ে বের হলো - "আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।" কবির মৃত্যু হলো অতিমাত্রায় কষ্ট সহ্য করে, প্রশ্রাবের প্রদাহে। কী কারনে যেন কবির বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শেষ বিদায়টাও পাননি। দূর সম্পর্কের এক নাতনি ছিলো কবির শেষ বিদায়ের ক্ষণে। কবি জমিদার ছিলেন এইসব গল্প সবাই জানে। কবি'র দুঃখের এই জীবনের কথা ক'জন জানেন? প্রথম যৌবনে যে গান লেখলেন, এইটাই যেন কবির শেষ জীবনে সত্যি হয়ে গেলো- "আমিই শুধু রইনু বাকি। যা ছিল তা গেল চলে, রইল যা তা কেবল ফাঁকি”। কবির বিলেতের জীবন টেমসের তীরের নগরকে যেমন করেছিলো প্রজ্বলিত নক্ষত্রের মতো আলোকিত ঠিক তেমনি তাঁর জীবনের বিষাদের জলসিঁড়ি ধীরে বয়ে চলেছিলো টেমসের বুক দিয়ে। এ যেন নগর কাব্যের এক আলো আধারের গল্প।
(তথ্যসূত্র: ইংলিশ হেরিটেজ, ইউকে অপেন ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিয়ান সোসাইটি, উমা দাসগুপ্ত, দি টাইমস, লন্ডন, দি ফর্টনাইটলি রিভিউ, ইন্ডিয়া টাইমস)