লন্ডনের ব্রিক লেইন বা বাংলা টাউন সকলেরই খুব পরিচিত। নগরীর এই ব্যস্ততম এলাকাটি দীর্ঘকাল ধরে একটি বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক বৃত্তায়নে সময়ের হাত ধরে বিবর্তিত হয়েছে। যার রয়েছে বহ শতাব্দীর এক ঐতিহ্যময় ইতিহাস। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে ফরাসির হুগেনোট (Huguenot) সিল্ক তাঁতি থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের বাংলাদেশী অভিবাসীদের পদচারনায়, এই প্রাণবন্ত পূর্ব লন্ডনের পাড়াটি সময়ের সাথে সাথে তার পরিবর্তনের বৈচিত্রতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। হুগেনোট তাঁতিরা ছিলেন ক্যালভিনিস্ট বিশ্বাসের ফরাসি সিল্ক তাঁতি। তারা দক্ষিণ ফ্রান্সের প্রধান রেশম-বয়ন শহর যেমন লিয়ন থেকে এসেছে। হুগেনোটরা নিপীড়ন এবং সহিংসতার ভয়ে ফরাসি ক্যাথলিক সরকার থেকে পালিয়ে পাড়ি জমায় পৃথিবীর নানা দেশে। তার মধ্য একটি বড়ো অংশের গমন ঘটে বৃটেনে এবং এই এলাকাতেই বসতী স্থাপন করে। ১৭০৮ সালের একটি আইন, ফরেন প্রোটেস্ট্যান্ট ন্যাচারালাইজেশন অ্যাক্ট, যা ইউরোপীয় প্রোটেস্ট্যান্টদের ব্রিটেনে এসে বসতি স্থাপনের আমন্ত্রণ জানায়। আর এই সুযোগটিই ওরা নেয়। কালের বিবর্তনে টেমসের জলে ধীরে বয়ে চলেছে কতো না সভ্যতা, সংস্কৃতি আর মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-প্রেম আর ভালোবাসার গল্প। কখনো উত্তাল স্রোতে ভেসে এসেছে নতুন কোন স্বপ্নের মানুষেরা আবার মিশে গেছে ভাটীর টানে কালের গহব্বরে। যুগ যুগ ধরে আসা আর যাওয়ার মাঝেই টেমসের তীরের নগর হয়েছে সমৃদ্ধ, প্রসারিত এবং ঐতিহ্যময়। আর নগরীর নানা ঘটনায় নগর কাব্যের বিষয়গুলো হয়ে উঠেছে প্রাঞ্জল এবং অমলীন কমলীকার সুভাষিত উচ্ছ্বাস। কিন্তু ব্রিক লেইন বা বাংলা টাউনের এই বিবর্তন কিসের জন্য? আজকের নগর কাব্যে তুলে ধরবো বিলেতের পূর্ব লন্ডনের এই বাংলা টাউনটিকে নিয়ে যা ধীরে ধীর হয়ে উঠে বিলেত প্রবাসী বাংলাদেশীদের ঠিকানা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অতি পরিচিত ভুখন্ড।
গল্পটি সতেরশ শতাব্দীর প্রথম দিকে শুরু হয়েছিলো যখন ফরাসি হুগেনোট শরণার্থীরা পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হেমলেটস এলাকার স্পিটালফিল্ডস এবং হোয়াইটচ্যাপেলে বসতি স্থাপন শুরু করে যা আধুনিক দিনের ব্রিক লেইনের অংশ। এই তাঁতিরা সাথে করে রেশম বয়নে তাদের দক্ষতা নিয়ে এসেছিল। সেই সময়ে ব্রিটেনের বিকাশমান টেক্সটাইল শিল্পের জন্য তাদের এই দক্ষতার বিশেষ প্রয়োজন ছিলো। ধীরে ধীরে সমগ্র ইউরোপ থেকে আরও বেশি লোক আসার ফলে এলাকাটি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ১৮২০ সাল নাগাদ শুধুমাত্র ব্রিক লেইনের আশেপাশে ছয় হাজারেরও বেশি তাঁতি বসবাস করত। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দক্ষিণ এশিয়া থেকে বিপুল সংখ্যক লোক পূর্ব লন্ডনে আসতে শুরু করে। অনেকেই বাংলাদেশ (তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত) থেকে এসেছিলেন। অভিবাসীদের এই আগমন এই অঞ্চলে সংস্কৃতি ও প্রাণচাঞ্চল্যের একটি নতুন তরঙ্গ নিয়ে এসেছে, যা এক সময় একটি পুরানো শিল্প অঞ্চলকে বাংলাদেশী সংস্কৃতি সমৃদ্ধ একটি অঞ্চলে রূপান্তরিত করে। এর ফলে নতুন আগতদের জন্য বিশেষভাবে খাবার সরবরাহকারী স্থানীয় ব্যবসাগুলিও বেড়ে যায়। বিরিয়ানির মতো ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশনকারী রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে রঙিন শালওয়ার কামিজ (ঐতিহ্যবাহী পোশাক) পোশাকের দোকান দৃশ্যতঃ হতে থাকে এই এলাকাটিতে। আধুনিক ব্রিক লেইনে যা বাংলা টাউন নামে পরিচিত, বাংলার হাজারো বছরের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির প্রবাহকে খুঁজে পাওয়া যায়। এর কোলাহলপূর্ণ রাস্তার আশে পাশে অগণিত কারি হাউস থেকে শুরু করে সারা বছর ধরে বাঙালি সংস্কৃতি উদযাপন করে প্রাণবন্ত উৎসব। সংখ্যগরিষ্ঠ বাংলাদেশী অধ্যুষিত এই এলাকাটি সমগ্র ইংল্যান্ডের সবচেয়ে প্রাণবন্ত এবং বৈচিত্র্যময় স্থানগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠে। বেথনাল গ্রিন এবং শোরডিচের মধ্যে অবস্থিত, এই রাস্তাটি সংস্কৃতি, ইতিহাস, শিল্প, সঙ্গীত এবং বংলাদেশী এবং ভারতীয় আশ্চর্যজনক নানা স্বাদের খাবারে পূর্ণ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, এই অঞ্চলটি সারা বিশ্ব থেকে অভিবাসীদের আবাসস্থল ছিল যারা তাদের সাথে তাদের নিজস্ব অনন্য সংস্কৃতি নিয়ে এসেছিলো এবং নানা সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ায় শহরের এ অঞ্চলের স্বাদ এবং সাংস্কৃতিক চরিত্রে এসেছে ঋজুতা এবং বৈচিত্রতা।
ব্রিক লেইন হল প্রায় দুই মাইল দীর্ঘ প্রসারিত রাস্তা যা লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস বারার পূর্ব দিকে অবস্থিত। এক সময় এইটি প্রাচীর ঘেরা রাস্তা ছিল যা এখন অনেকগুলি ছোট ছোট অলি-গলিতে প্রসারিত হয়েছে, যেখানে বাজারের স্টলগুলি ভিনটেজ কাপড় থেকে শুরু করে প্রাচীন জিনিসপত্র পর্যন্ত বিক্রি হয়। রাস্তার আশে পাশে রয়েছে বেশ কিছু নামকরা পাব (মদের দোকান) এবং নাইটক্লাবের মতো কয়েকটি ট্রেন্ডি বার। প্রতি রবিবারে, একটি জমজমাট সানডে মার্কেটের জমায়েত হয় যেখানে হস্তনির্মিত গয়না থেকে শুরু করে আসবাবপত্র সহ নান ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র খুব অল্পদামে খুঁজে পাওয়া যায়। আমিও লন্ডনের প্রথম জীবনে যখন এই এলাকাটিতে বাস করতাম প্রায় প্রতি রবিবারেই এই খোল বাজারে চলে আসতাম। এলাকাটি তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্যও পরিচিত। হোয়াইটচ্যাপেল গ্যালারি বা ব্রিক লেইন গ্যালারির মতো জায়গায় সমসাময়িক শিল্পের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশী শিল্পকর্ম প্রদর্শন করে অসংখ্য গ্যালারী রয়েছে। এছাড়াও প্রচুর ঐতিহ্যবাহী কারি হাউস রয়েছে যেখানে সুস্বাদু ভারতীয় খাবার পরিবেশন করা হয়, যেমন আলাদিন ব্রিক লেন বা তৈয়বস রেস্তোরাঁ, উভয় প্রতিষ্ঠানই ষাটের দশকের পর থেকে চলে আসছে। বর্তমানে এই বাংলা টাউনটি এমন একটি বৈচিত্রময় স্থানে পরিনত হয়েছে যেখানে আসলে কেউ কখনো হতাশ হবে না, প্রত্যেকের জন্য কিছু না কিছু আকর্ষনীয় কিছু না কিছু রয়েছে। লন্ডনের ব্রিক লেইন এলাকাটি বহু প্রজন্ম ধরে বাঙালিদের কাছে জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল। এই এলাকা এবং তার আশেপাশে যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের আবাসস্থল, এবং অভিবাসীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য হিসাবে পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশীদের এ এলাকায় বসতি স্থাপনের ইতিহাস ১৯৫০ এর দশক থেকে শুরু হয়েছিল যখন দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলার অনেক মানুষ পাড়ি দিয়েছিলো বিলেতে নানা কারনে। সেই থেকে, এই এলাকাটি লন্ডনের সবচেয়ে প্রাণবন্ত এবং বৈচিত্র্যময় এলাকা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে বাংলাদেশীদের কাছে।
তবে এই বিখ্যাত ব্রিক লেইনটি আরো জনপ্রিয় এবং প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে মনিকা আলীর ২০০৩ সালের উপন্যাস ব্রিক লেনটি প্রকাশের পর থেকেই যা অনেক বিতর্কের সৃষ্টি করে। উপন্যাসটির মূল চরিত্রে আছে নাজনীন। একজন বাংলাদেশী মহিলা যিনি তার জন্মভূমি থেকে একজন বয়স্ক লোককে বিয়ে করার পর লন্ডনে চলে আসেন। নতুন দেশে, তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন সংস্কৃতি এবং জীবনধারার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সংগ্রাম করে চলেছেন। মানুষের সত্যিকারের পরিচয়, সংস্কৃতি , জীবনের সংগ্রাম এবং ধর্মের বিষয়গুলিকে নিয়েই উপন্যাসের চরিত্রগুলি বিবর্তিত হতে থাকে এবং জীবনের চলার পথের এক জানা-অজানা জটিল সামাজিক দর্শনকে অন্বেষণ করাই উপন্যাসটির মূল লক্ষ্য। নাজনীন তার নতুন জীবনকে বিলেতের এক নতুন পরিবেশে গড়তে গিয়ে শুধু নতুনত্বের বাধাগুলির মুখোমুখীই শুধু হননি সাথে সাথে তার পরিবার এবং সম্প্রদায়ের প্রত্যাশাগুলির মুখোমুখিও তাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হতে হচ্ছে। সতেরো বছর বয়সে নাজনীনের বিয়ে দিয়ে শুরু হয় আখ্যান। তাকে ইংল্যান্ডে একটি উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু লন্ডনে পৌঁছে তিনি বুঝতে পারেন যে এটি তার প্রত্যাশা পূরনের নয়। তার স্বামী চানুর শীতলতা এবং ব্রিটিশ সমাজে আত্তীকরণের প্রতি তার আবেশ থাকা সত্ত্বেও, নাজনীন ধীরে ধীরে নাইট স্কুলে ইংরেজি ক্লাস নেওয়ার মাধ্যমে তার নিজের পথ তৈরি করতে শুরু করে, যেখানে তার করিমের সাথে দেখা হয়। একজন উগ্র ইসলামবাদী কর্মী যিনি তার অনেক পূর্ব ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে বদ্ধপরিকর। উপন্যাসের নাজনিনের জীবনের গল্প এবং অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আমরা একটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি পেতে পারি যে কীভাবে অভিবাসীরা বিদেশী ভূমিতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করার সময় বিচ্ছিন্নতা এবং পরিচয় সংকটের সাথে লড়াই করতে বাধ্য হয়। জীবনের নানা শারিরীক, সামাজিক আর মনস্তাত্বিক চাওয়া-পাওয়ার আলো -ছায়ায় নাজনীনও আত্মসমর্পন করে ভবিতব্যের কাছে। করিমের কারনে, নাজনীন চানুর ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। এই যে সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শামিল। নাজনীনকে চানুর সাথে থাকার বা করিমের জন্য ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে একটি পছন্দ করতে হবে। এটাই সত্য। কিন্তু যার অর্থ হবে সমস্ত সামাজিক সম্মান এবং সেইসাথে যেকোন আর্থিক নিরাপত্তাকে বিসর্জন দেওয়া। একি শুধু বয়সের ব্যাবধান নাকি দুয়ের মধ্যকার সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণ?
যখন বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়, ব্রিক লেইন পাঠকদের কাছ থেকে প্রশংসা এবং সমালোচনা উভয়ই পেয়েছিলো। অনেকের মনে হয়েছিল যে মনিকা আলী সেই সময় ব্রিটেনে দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের অভিজ্ঞতার সঠিক চিত্র তুলে ধরেছিলেন। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে লিঙ্গ ভূমিকা এবং ধর্মীয় বিভাজনের মতো বিষয়গুলি তিনি যেভাবে অন্বেষণ করেছেন পাঠকরা তার প্রশংসা করেছেন। তবে অনেক বাংলাদেশী মনে করেন যে উপন্যাসটি তাদের সংস্কৃতিকে নেতিবাচক আলোকে চিত্রিত করেছে। তাদের যুক্তি মনিকা আলী এমন চরিত্রগুলিকে চিত্রিত করেছিলেন যারা খুব এক-মাত্রিক, যাদের মধ্যে বিশ্বাস বা সাংস্কৃতিক অনুশীলনের উপর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করার পরিবর্তে সমস্ত মুসলমানকে এক আদর্শে চিত্রিত করা হয়েছে। কিন্ত বড়ো ধরনের বিতর্কের ঝড় উঠে ২০০৭ সালে যখন উপন্যাসটিকে একটি ফিচার ফিল্মে রূপান্তরিত করা হয়। কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছিলেন যে কিছু দৃশ্য মুসলিম মহিলাদের সম্পর্কে অত্যধিক যৌনতামূলক বা চিরস্থায়ী স্টেরিওটাইপকে তুলে ধরা হয়েছিলো যা অনেকের মতে অন্যান্য জাতিসত্তার তুলনায় বাংলাদেশী সম্প্রদায়কে যথেষ্ট ইতিবাচক প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হয়নি বরং হেয় করা হয়েছে। এ যে ধর্ম এবং একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রতি চরম বমাননা। নাজনীনের গল্পের মাধ্যমে অভিবাসীদের অভিজ্ঞতা অন্বেষণ করার পাশাপাশি, ব্রিক লেন বর্ণবাদ, লিঙ্গবাদ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং শ্রেণী সংগ্রামের মতো বৃহত্তর বিষয়গুলিকেও স্পর্শ করেছেন। পাঠকদের এই সমস্যাগুলি ব্রিটেনের বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং সমাজের মধ্যে কীভাবে নিজেকে প্রকাশ করে তার একটি সৎ দৃষ্টি দেযওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। নানা সমালোচনা সত্ত্বেও, পরিচয়ের রাজনীতির চিন্তা-প্ররোচনামূলক অন্বেষণ এবং পূর্ব ও পশ্চিম সংস্কৃতির মধ্যে সাংস্কৃতিক সংঘর্ষের কারণে ব্রিক লেন আজও বিশ্বজুড়ে বুক ক্লাব এবং সাহিত্যে রসিকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এই ব্রিক লেইন রাস্তাটি আরো বেশী পরিচিতি লাভ করে এর নাম যখন বাংলা টাউন হিসেবে ঘোষনা করা হয়। ব্রিক লেন এবং এর আশেপাশে বাংলাদেশি জনসংখ্যা বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় ব্যবসা ও রাজনীতিতে আরও প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে যার পরিপ্রেক্ষীতে বাংলাটাউনের ধারণার উদ্ভব হয়। ব্রিক লেইনকে পুনর্বিন্যাস করার ধারণাটি বাঙালি রেস্তোরাঁর মালিক এবং বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের সংগঠকদের মধ্যে প্রথম উদ্ভূত হয়েছিল। এই উদ্যোগ্তাদের প্রস্তাবে ব্রিক লেইনে একটি 'বাংলাটাউন' যা বাংলাদেশীদের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের এলাকা হিসাবে দেখানো হয়েছে যেখানে জাতিগত খাবার এবং হস্তশিল্প,সামাজিক আবাসন সহ বাংলার সংস্কৃতিকে তোলে ধরার এক সার্বিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব প্রান্তে একটি সাংস্কৃতিক জেলা প্রতিষ্ঠা করা যা অন্তত আংশিকভাবে পশ্চিম প্রান্তে চায়নাটাউনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাফল্যের অনুকরণ করবে এবং বাংলাদেশীদের উপস্থিতির প্রতীক হিসেবেও কাজ করবে। ১৯৯০এর দশকের গোড়ার দিকে, লন্ডন বরো অফ টাওয়ার হ্যামলেটস, স্থানীয় কোম্পানি এবং তৃতীয় সেক্টর সংস্থাগুলির সহযোগিতায়, "উদীয়মান সাংস্কৃতিক এলাকা" হিসাবে ব্রিক লেইনকে পুনঃবিকাশের জন্য সরকারী ভর্তুকির জন্য সফলভাবে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করার সুযোগ পায়। শেষ পর্যন্ত অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ১৯৯৭ সালে, লন্ডন বরো অফ টাওয়ার হ্যামলেটস ব্রিক লেইনের দক্ষিণ প্রান্তে বাংলাদেশী রেস্তোরাঁর দীর্ঘ রাস্তাটিকে "বাংলাটাউন" নামকরণ করেন। বাংলাটাউন ডেভেলপমেন্ট 'ইস্টার্ন'-স্টাইলের প্রবেশদ্বার, আঁকা রাস্তার আলো, অতিরিক্ত জননিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিদ্যমান স্টোর এবং রেস্তোরাঁর সম্মুখভাগের উন্নতির জন্য অনুদান এবং তাদের মালিকদের জন্য ব্যবসায়িক নির্দেশিকা চালু করেন। বাংলাটাউন ব্রিক লেইনে তিনটি নতুন বার্ষিক স্ট্রিট ফেস্টিভ্যালের প্রচারের জন্য একটি প্রচারমূলক বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়: বৈশাখী মেলা, ব্রিক লেন ফেস্টিভ্যাল এবং কারি ফেস্টিভ্যাল। ১৯৯ সালে, ব্রিক লেইনের মূল অংশটিকে বরোর পরিকল্পনা বিভাগ দ্বারা একটি "রেস্তোরাঁ অঞ্চল" মনোনীত করা হয়েছিলো, যা দোকানগুলিকে ভোজনশালায় রূপান্তর করার অনুমোদন দেয়। ব্রিক লেইন জামে মসজিদ যা পূর্বে একটি উপাসনালয় এবং খ্রিস্টানদের একটি গির্জা ছিল, যা সময়ের বিবর্তনে পরিনত হয় ব্রিক লেইনের বহুমুখী অতীতের সবচেয়ে বিশিষ্ট ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন।
লন্ডন একটি ইতিহাস সমৃদ্ধ শহর এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির আবাসস্থল। আমি যখন প্রথম লন্ডনে আসি প্রায় ত্রিশ বছর আগে তখন এখানেই প্রথম আসি। সেই সময়ই আমি পূর্ব লন্ডনে বাঙালি সংস্কৃতির একটি প্রাঞ্জল বৈচিত্রময় অংশকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছি। এলাকাটি দুটি জিনিসের জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত: গ্রাফিতি এবং ভারতীয় কারি রেস্টুরেন্ট।যদিও নানা বিচিত্রের গ্রাফিতি শিল্পগুলি বাঙালিদের দ্বারা বিকশিত হয়নি, তবে প্রায় প্রতিটি কারি রেস্টুরেন্টই যেন তাদের মালিকানাধীন । ব্রিক লেইনের অফিসিয়াল সাইনেজও বাংলায় লেখা। এই রাস্তাটি দিয়ে হাঁটতে গেলে কখনোই মনে হবে না যে আমরা বিলেতের অতি সুন্দর লন্ডনের কোন এক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। মনে হবে বাংলার নদী-নালার শীতল হাওয়ায় বেড়ে উঠা বাংলার কোন চেনা-জানা শহরের গলি দিয়ে হেঁটে চলেছি। রেস্তোরা থেকে ভেসে আসা দেশ বাংলার কোন গান যেন সেই অনুভূতির জানান দিয়ে যায়। রাস্তার আশে-পাশের নানা বৈচিত্রময় চিহ্ন থেকে শুরু করে লাল-সবুজ ল্যাম্পপোস্ট পর্যন্ত প্রচুর বাংলাদেশি দেশপ্রেমের প্রদর্শন এখানে রয়েছে। এই পাড়াটি হয়ে উঠেছে বৃটিশ-বাঙালি পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু। প্রায় সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বাঙালিরা এই অঞ্চলে অভিবাসন শুরু করেছিলো একটি উন্নত জীবনের সন্ধানে। আজ এই আবাসস্থলটি হয়ে উঠেছে বাঙালী সংস্কৃতির পরিচয় বহনকারী টেমসের তীরের নগর কাব্যের বাংলা টাউন যেখানে বাঙালীরা খুঁজে পায় নিজের ঠিকানা, স্বীয় সংস্কৃতির বলয়ে বেড়ে উঠার নির্ভরতা, জীবনের পথ চলার এক অমলীন নির্লোভ সারথীকে।