একুশের চেতনায় তৈরী হোক শিক্ষা ব্যবস্থা

মা এই শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক স্বর্গীয় সুখ, পরম তৃপ্তি এবং জীবনের গতি, এক ভয়হীন নির্ভরতা। মায়ের নাড়ীর সাথে সন্তানের নাড়ীর যে সম্পর্ক মাতৃভাষার সাথে মানুষের সম্পর্ক সেই রকম। সেই ভাষায় কথা বলার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই আমাদের অস্তিত্ব, সমাজ, সংসার, প্রকৃতি, সংস্কৃতি, সভ্যতা, প্রেম-ভালোবাসা, মনের আবেগ। তাই মায়ের ভাষায় কথা বলা মানে নিজের অস্তিত্বেকে ধরে রাখা। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা হল সমস্ত আর্য ভাষার মধ্যে সবচেয়ে মধুর। এই ভাষাকে নিয়েই একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন "এটি সত্যিই বড় দুঃখের বিষয় যে এই ভাষাটি বাংলার বাইরে বেশি পরিচিত নয়”। কিন্তু তার চেয়ে বড়ো দুঃখর বিষয় হলো মায়ের সঙ্গে থেকেও বাংলার লক্ষ লক্ষ শিশু-কিশোর আর এ ভাষায় কথা বলে না বা বলতে পারে না। বাঙালীর গড়নে বেড়ে উঠা এই মানুষগুলোর মুখ দিয়ে নিঃসৃত হয় বেনিয়াদের ভাষা ইংরেজী। এতে অবশ্য আমাদের মায়েদের তেমন কিছু যায় আসে না। বৃদ্ধাশ্রমে থাকবো কিন্তু সমাজতো জানলো আমার সন্তান ইংরেজীতে বিলেতী সাহেবদের মতো কথা বলে। বাংলাদেশে এখন সর্বত্র ইংরেজী ভাষার বিশেষ রাজত্ব চলছে যা একদিন ভয়ানক রুপ নেবে তাতে সন্দেহ নেই। অথচ এই মায়ের ভাষাকে রক্ষার জন্য বাংলার ছেলেরা জীবন দিয়েছে। রচিত হয়েছিলো গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা সেই বিখ্যাত গান যা ২১শে ফেব্রুয়ারীতে বাজানো হয় প্রতিবছর –“আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারী” যা এখন বাংলাদেশে শুধুমাত্র একটি বিশেষ ছুটির দিনের আচরিক কার্যাদির বিশেষ সংগীত ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের চিন্তা, চেতনা আর মননে ২১শের কোন আত্মিক সম্পর্ক বর্তমানে তেমন আছে বলে আমার মনে হয় না। বিদেশী বাতাস আর ভোগবাদে বিশ্বাসী বাঙালীর অবয়ব ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে দিন দিন এটাই চরম সত্য।

 

আমাদের মাতৃভাষার সাংস্কৃতীক পরিমন্ডল এক বিস্ময়কর। হাজারো বছরের আমাদের এই সভ্যতা, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ইতিহাস বিভিন্ন উৎসব, বর্ণিল উদযাপন এবং ভাষার দ্বারা পরিবষ্টিত। বাংলা ভাষা এই সাংস্কৃতিক গৌরবের মধ্যে একটি যা সঙ্গীত, শিল্প, সাহিত্যে সমৃদ্ধ এবং পৃথিবীর মধুরতম ভাষাগুলোর মধ্যে একটি যা কবিতার মতো নান্দনিক শুনায়। আমি তোমাকে ভালোবাসির মধ্যে যে রোমান্টিক অভিব্যক্তি রয়েছে তা পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় খুঁজে পাওয়া যায় বলে আমার মনে হয় না। বাংলা বাঙালির ভাষা, সুজলা সুফলা আর নদীমাতৃকতার বাংলার শীতল হাওয়ায় বেড়ে উঠা বাংলাদেশীদের ভাষা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মধ্যপ্রাচ্য এবং যুক্তরাজ্য সহ এশিয়া জুড়ে যথেষ্ট বাংলাভাষী সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। ভারতে বেশ কিছু স্থানে যেখানে বিপুল সংখ্যক বাঙালি বাস করছে যেমন পশ্চিমবঙ্গে, আসামে, নিকোবর দ্বীপে, আন্দামান মহারাষ্ট্র, নাগপুর, উড়িষ্যা, বিহার, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মেঘালয় এবং ঝাড়খণ্ড। আনুমানিক ৩০০ মিলিয়ন ভাষাভাষী এবং ৩৭ মিলিয়ন দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে ব্যবহার করে। বাংলা হলো পঞ্চম সর্বাধিক কথ্য মাতৃভাষা এবং বিশ্বের মোট ভাষাভাষীদের সংখ্যার দিক থেকে সপ্তম সর্বাধিক কথ্য ভাষা। তাছাড়া বাংলা পঞ্চম সর্বাধিক কথ্য ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের মাতৃভাষা সবচেয়ে বেশী আদরের এবং মধুরতম। এই বিশ্বাস থাকাটাই স্বাভাবিক, উল্টোটা বরং অস্বাভাবিকতা। মাতৃভাষা হল একটি শৈল্পিক আত্মা, মায়ের নাড়ী এবং নিজকে প্রকাশ করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম।

 

১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের জনগন মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন করেছিল। এই কোমল এবং মনোমুগ্ধর ভাষাকে সমৃদ্ধ করে বিশ্বে বিশেষ পরিচতি নিয়ে এসেছিলেন নোবেল বিজয়ী বাংলার প্রবাদপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার লেখনীর বৈচিত্রতা, সমৃদ্ধ শব্দভান্ডার, দার্শনিক ভাবনার নান্দনিক বিশ্লেষন, জীবন থেকে নেয়া থরে থরে সাঁজানো মানুষের ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাসের শৈল্পীক বর্ননায় বাংলা একটি ভাষা হিসেবে হয়েছে ঋজু , নান্দনিক এবং সমৃদ্ধ। এনে দিয়েছিলো বিশ্ব মানবতার দোড়গোড়ায় স্বীকৃতির পশরা। আমরা বাংলা ভুখন্ডে বেড়ে উঠা মানুষেরা হলাম গর্বিত। উল্লেখযোগ্য বাঙালি লেখকদের মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিম চ্যাটার্জী, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কবি জসীম উদ্দিন, মোতাহার হোসেন প্রমুখ। বাংলাকে তাঁরা লালন, পালন করছিলেন চিন্তা, চেতনায়, মননে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। অক্ষর আর শব্দের গাঁথুনিতে সৃষ্টি করেছিলেন বিশ্ব নন্দিত সাহিত্য। বাংলার সংস্কৃতিতে নিয়ে এসেছিলেন এক নবজাগরন। আমাদের ভাষা পেল ঋদ্ধতার শক্তি এবং সংস্কৃত হলো সমৃদ্ধ। বাঙালী হিসেবে পেলাম নিজের সমস্ত অনুভূতিকে প্রকাশের এক বলিষ্ঠ মাধ্যম। বাঙালী এবং বাংলার মানুষেরা সত্যিই গর্বিত যে আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলি।

 

১৯৪৭ সালে, যখন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে, তখন বাংলাকে ধর্মীয় ধারায় হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানে বিভক্ত করা হয়। এর ফলে মানুষের বৃহৎ আকারে স্থানচ্যুতি ঘটে এবং বাংলায় ভাষাগত বৈচিত্র্য বেশী মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল একটি রাজনৈতিক প্রচারাভিযান যা ১৯৫২ -১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অধিরাজ্যের সরকারী ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে আন্দোলন চরমে পৌঁছে, এতে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী ছাত্র নেতা নিহত হয়। ভাষা আন্দোলনের এ রক্তাক্ত প্রেক্ষাপটকে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি প্রধান মাইল ফলক হিসাবে দেখা হয়, যা পরবর্তীতে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে। বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ভাষা শহীদ দিবস হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এই দিনে আমরা স্মরণ করি তাদের যারা আমাদের মাতৃভাষা বাংলার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এটি আমাদের ভাষার বীরদের সম্মান করার এবং বাংলাকে রক্ষা ও প্রচার করার জন্য আমাদের অঙ্গীকার পুনর্নিশ্চিত করার দিন। কিন্তু আমরা যদি জাতী হিসেবে সত্যি প্রশ্ন করি যে আমরা কি আমাদের অঙ্গিকারকে রক্ষা বা বাস্তবায়িত করতে পেড়েছি?  কিংবা আত্মোপলদ্ধি করি যে আমাদের ভাষা শহীদদের প্রতি আমাদের অঙ্গিকারের অবস্থানটা কোথায়। তা হলেই দেখতে পাবো দিন দিন আমরা অপসৃয়ায়নের দিকে হেঁটে চলেছি। আমরা যেন কেমন দূর্বল জাতীগোষ্ঠীতে পরিনত হচ্ছি অন্ততঃ সাংস্কৃতীক পরিমন্ডলে, ভাষাগত ভাবে। সাংস্কৃতির একটা দিকতো এখন একেবারে বিলুপ্তির পথে। আমি লোকসাহিত্যের কথাই বলছি। নতুন প্রজন্মের কাছে এই সাহিত্যটা একদিন ইতিহাস হয়ে থাকবে। অনেকেই  আবার এই ইতিহাসকে জানবেও না বা জানার কোন আগ্রহও দেখাবে না। আগের মতো গ্রামে গন্জে এখন আর বাউল, ভাটিয়ালী, কাওয়ালী, মুর্শিদী কিংবা কোন বৈষ্ণব বৈরাগীর কাঁসা আর শঙের তালে ধল প্রহরে ঘুম জাগানিয়ার গান শোনা যায় না। টিক টক আর বিশ্বায়নের রঙীন হাওয়ায় বেড়ে উঠা আমাদের  মা-দাদীরা এখন আর তাদের ছোট ছোট শিশুদের রাক্ষস-খোক্কসের কিংবা ঠাকুর মা ঝুলি থেকে নিয়ে আসা কোন রাজকুমারীর গল্প শোনায় না। মোবাইলে কোন ভিনদেশী অর্থহীন উচ্চ মার্গের কোন গানে মাতোয়ারা হয়ে আমাদের স্মার্ট শিশুরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। আধুনিক মায়েদের বা দাদীদের ব্যাস্প কন্ঠে আর আধুনিক শিশুরা ঘুম পাড়ানোর গান বা কিচ্ছা-কাহিনী শুনতে পায় না। কি অদ্ভুত আধুনিক যুগের আধুনিক মানুষের ক্রিয়া কলাপ। তবে এখন আর এসব নিয়ে ভাবলে অবাক হই না।

 

শুধু অবাক হই আমাদের আত্ম বিস্মৃতির কথা ভেবে। মাত্র সাত দশক আগেই বাংলার তরুনেরা জীবনকে বাজি রেখে পাকিস্থানীদের অস্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে হুংকার দিয়েছিলো “মায়ের ভাষাকে কাইড়া নেয়া যাবে না”। উত্তপ্ত হয়েছিলো বাংলার আকাশ বাতাস। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো সারা বিশ্ব বাংলার ছেলেদের সাহসিকতায়। পৃথিবী থেকে কতো ভাষাই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে এবং হারিয়ে যায়। পরিবর্তন আর বিবর্তনের ভিতর দিয়ে ভাষা হাঁটতে হাঁটতে হয় সমৃদ্ধ এবং কখনো সম্পূর্ন একটি নতুন ভাষায় রুপান্তরিত হয়। এটা যে ভাষার চিরায়ত নিয়ম। বর্তমানে, প্রায় ছয় শতাধিক পরিচিত বিলুপ্ত ভাষা রয়েছে। এই ভাষাগুলি নিয়ে আর কখনো কথ্য বা অধ্যয়ন করা হয় না। অনেকগুলি স্থানীয় উপভাষা ছিল যাদের আর বর্ণমালা বা শব্দের কোন রেকর্ড নেই, এবং তাই চিরতরে হারিয়ে গেছে। অনেক প্রধান ভাষাও সমাজ এবং পরিবর্তনশীল সংস্কৃতি কারনে দূর্বল থেকে দূর্বলতর হয়েছে। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে এমন ভাষাগুলির উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে যেগুলি একসময় প্রধান ভাষা ছিল এবং পরে ব্যবহারিক দিক থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। যেমন ল্যাটিন, হিব্রু, আইবেরিয়ান, সিন্ধু সভ্যতার ভাষা হরপ্পা, ডেসিয়া যা ডেসিয়ার ভূমিতে বসবাসরত মানুষেরা ভাষা ছিলো ( যা আধুনিক রোমানিয়া) সহ অনেক ভাষাই সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে।

 

ভাষা কেন বিলুপ্ত হয়? তার কারন আমরা হয়তো অনুধাবন করতে পারি। তার প্রধান কারন আমরা এবং আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। তবে একটি ভাষা এবং তার সাংস্কৃতিক বিবর্তনর প্রক্রিয়াটি একটি লম্ব প্রক্রিয়া যা কয়েকটি প্রজন্ম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পৃথিবীর নানা ভাষার সংমিশ্রনে যখন একটি নতুন প্রভাবশালী ভাষা তৈরি হয় তখনই পুরানো ভাষার ক্ষয় ঘটে। তবে বর্তমানে ভাষা বিবর্তনের প্র্রক্রিয়াটি চলে খুব দ্রুত গতিতে বিশেষ করে তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষ আর অপ্রতিরোধ্য পূঁজিবাদী বিশ্বায়নের কারনে। আর তার সাথে যুক্ত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী সোশ্যল মিডিয়ার ব্যাপক প্রচার এবং প্রসার। একই সঙ্গে অবশ্যই রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং ভাষা সংরক্ষণের অভাবের দিকে আঙুল তুলে ধরতে হবে। আমরা এখনো অনেক সময় পার করতে হবে। ভাষাগত ভাবে আমরা এখনো মচকে যাই নি। তবে বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে যদি সত্যিকারের ভাষা সংরক্ষনের জাতীয় নীতি প্রনয়ন না করা হয় অনতি বিলম্বে তা হলে জাতী হিসেবে আমরাও এক মহা সংকটে পড়বো। তাই ভাষা শহীদদের প্রতি আমাদের অঙ্গিকারকে বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এ ভাষাকে পৌঁছাতে হবে। সাথে সাথে উপজাতীদের ভাষাগুলোকেও সংরক্ষন করার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। তার জন্য চাই একটি জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতি যা হবে মাতৃভাষা ভিত্তিক।

Leave your review