বহু শতাব্দী ধরে, লোক-সংস্কৃতি বাংলাদেশের ইতিহাস ও পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি বিভিন্ন ধরনের রীতিনীতি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, গল্প, গান এবং নাচের বৈশিষ্ট্য যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে এসেছে। বছরের পর বছর ধরে লোক-সংস্কৃতি অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু এখনও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একটি প্রাণবন্ত অংশ হয়ে আছে এবং আমাদের জীবন ও সমাজকে প্রেরনা দিয়ে যাচ্ছে অনবরত নানা ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের লোককাহিনী ভিত্তিক সংস্কৃতিক পরিচয় প্রাচীনকাল থেকেই পাওয়া যায় যখন ভারতবর্ষ হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বাংলাদেশের প্রাচীন বাসিন্দাদের নিজস্ব মৌখিক ঐতিহ্য ছিল এই লোককাহিনী। অধিকাংশ লোকগল্পই দেব-দেবী, মিথ এবং কিংবদন্তি, নায়ক এবং খলনায়কদের সম্পর্কে। এই মৌখিক ঐতিহ্যগুলি পরে কবিরা লিখেছিলেন ভবিষৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য যারা রামায়ণ এবং মহাভারতের মতো মহাকাব্য রচনা করেছিলেন যা আজও জনপ্রিয় বিশেষকরে হিন্দু জনগোষ্ঠীর কাছে। এই গল্পগুলি সময়ের সাথে সাথে আধুনিক বাংলাদেশী সমাজকে প্রতিফলিত করার জন্য অভিযোজিত হয়েছে। প্রাচীনতম কিছু লোককাহিনী এবং গান ছিল হিন্দু পুরাণ নির্ভর যেমন রাম, শিব এবং নানা দেব-দেবী, রাজা এবং নায়কদের সম্পর্কে। এই গল্পগুলি ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উত্সবে, পূজা-পার্বনের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে মৌখিকভাবে প্রেরণ করা হয়েছিল। এই সময়কালে, লোকসংগীতও জনপ্রিয় ছিল এবং প্রায়শই ঢোল বা বাঁশির মতো যন্ত্রসংগীতের সাথে নানা ভাবে আকর্ষনীয় ভাবে মনোরন্জনের মাধ্যমে গ্রামের মানুষদেরকে শোনানো হতো। শৈশবে বড়দের সাথে নানা গ্রাম ঘুরে কতো না লোককাহিনী গাঁথা ধর্মীয় গল্প বা নাটক দেখেছি। বিভিন্ন সংগীতের দল গ্রামে গ্রামে ঘুরে নৌকা বিলাস, সীতার বনবাস, রাবন বধ, বেহুলা লংখীন্দরের কাহিনী নানা ভঙ্গিমায় পরিবেশন করতো।
মুঘল সাম্রাজ্যের সময় (১৫২৬-১৮৫৮), বাংলাদেশে মুসলিম প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে এবং লোককাহিনী ভিত্তিক সংস্কৃতি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। এই সময়কালে দরবেশদের (অতীন্দ্রিয় সুফিদের) মতো ঐতিহ্যবাহী গল্পে ইসলামিক উপাদানের সাথে কাওয়ালি (ধর্মীয় ভক্তিমূলক গান) এর মতো বিনোদনের সংযোজনের ফলে লোক-সংস্কৃতিতে এক নতুন রূপের প্রবর্তন দেখা যায়। মুঘলরা এই অঞ্চলে ফারসি সাহিত্যও নিয়ে আসে, যা এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশী সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। মুগল সাম্রাজ্যের পতনের পর বৃটিশরা ভারতবর্ষের ক্ষমতায় আসে। তখন আরেকটি পরির্তন দেখতে পাই আমাদের লোক-সংস্কৃতিতে। ব্রিটিশ রাজ (১৮৫৮-১৯৪৭) স্থানীয় সমাজে নিজস্ব রীতিনীতি চালু করতে শুরু করে ধীরে ধীরে। এই সময়ে বাংলাদেশ সহ পুরো ভরতবর্ষের লেখালেখিতে ইংরেজি সাহিত্যের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে পুতুল থিয়েটার এবং ঘোড়ার দৌড়ের মতো বিনোদনের কিছু ঐতিহ্যবাহী রূপও আবির্ভূত এবং সংযোজিত হয়েছিল। খ্রিস্টধর্মের প্রভাবে সারা দেশের গীর্জাগুলিতে ব্যবহারের জন্য বাংলা ভাষায় ধর্মীয় স্তবক রচনা করা হয়। ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে, বাংলাদেশী লোককাহিনী সংস্কৃতিতে একটি চলমান বিবর্তন শুরু হয়। যদিও প্রাক-ঔপনিবেশিক দিন থেকে অনেক কিছুই অপরিবর্তিত থাকে এবং শক্তিশালী মৌখিক ঐতিহ্যের কারণে লোকসংস্কৃতির অনেক কিছুই আজও চর্চা করা হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী উৎসব, যেমন পহেলা বৈশাখ, পৌষ সংক্রান্তির মেলা, নবান্নের উৎসব, বসন্ত উৎসব এখনও প্রতিবছর উদযাপিত হয়। এখনো লোকগীতি গ্রামীণ ও শহুরে উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়, যদিও বিশ্বায়ন, তথ্য-প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্মেষ আর সোশ্যাল মিডিয়ার দৌরাত্মের কারনে লোককাহিনী ভিত্তিক গল্প শোনা বা লোকগীতে আগ্রহী মানুষেরা সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
তবে তথ্য-প্রযুক্তির বেশ কিছু সুবিধাজনক দিকও আছে আমাদের লোকসংস্কৃতির প্রচার এবং প্রসারের ক্ষেত্রে। আধুনিক প্রযুক্তির কারনে এই ঐতিহ্যগুলিকে আগের চেয়ে আরও ব্যাপকভাবে দর্শকদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে, স্ট্রিমিং পরিষেবা সম্প্রচার এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে লোক সংস্কৃতি সংরক্ষণকে বৃদ্ধি করা এখন খুব সহজ। সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি মানুষকে তাদের নিজস্ব সৃষ্টিগুলিকে আশেপাশের সমমনা ব্যক্তিদের সাথে ভাগ করার সুযোগ করে দেয় অতি সহজে এবং যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এক নতুন তথ্য নির্ভর সমাজব্যাবস্থা। লোককাহিনী সংস্কৃতি আজও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী অনেক লোকের পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা তাদের চারপাশে ঘটে চলা দ্রুত আধুনিকায়নের মধ্যে স্থিতিশীলতার অনুভূতি প্রদান করে। যদিও এটি বছরের পর বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে আসছে, তদুপরি এর মূল বার্তাটি এখনো অনেকটাই অক্ষত রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে এবং এই একবিংশ শতাব্দীর নিরন্তর পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। বর্তমান ধারা চলতে থাকলে, এটি নিশ্চিত যে শতো বাধা বিপত্তি থাকা সত্বেও আগামী আরও বহু শতাব্দীর জন্য বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে এই লোকসংস্কৃতি। লোককাহিনী বাংলাদেশীদের জীবনে অনেকভাবে প্রভাব ফেলেছে। আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের সাথে বাংলার বাতাসের মতোই আষ্টে-পিষ্ঠে লেপ্টে আছে। আমাদের ভাবনায় এবং চেতনায়। আমাদের আত্মপরিচয়ে। বাঙলীত্বের অবয়বে। লোকসংস্কৃতি শিক্ষার পাশাপাশি বিনোদনের একটি প্রধান উৎসও বটে। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রতিকূলতার মুখে সাহস এবং নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্বের মতো মূল্যবোধগুলি শেখায়। এটি গল্পগাঁথায় এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সম্প্রদায়কে একত্রিত করতেও কাজ করে। লোকসংগীত সম্ভবত বাংলাদেশে পাওয়া লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রধান রূপ। এতে "লোকগীতি" নামক ঐতিহ্যবাহী বাংলা গান রয়েছে যা প্রেম এবং ভালোবাসার গল্প বলে। দারিদ্র্য বা অবিচারের মতো বিষয়গুলিতে সামাজিক মন্তব্য প্রদান করে। অন্যান্য ধারার মধ্যে রয়েছে লোকনৃত্যের শৈলী যেমন বাউল (বাংলার সাথে যুক্ত ভক্তিমূলক সঙ্গীতের একটি রূপ), যাত্রা (একটি থিয়েটার-শৈলীর পারফরম্যান্স), বা কীর্তন (ধর্মীয় গান)।