সোশ্যাল মিডিয়ার সামাজিক দর্শন

সক্রেটিস বা প্লেটো টুইটার, ফেইসবুক বা টিকটক ব্যবহার করার সুযোগ পাননি বা এই জাতীয় সোশ্যাল মিডিয়া যে একদিন সারা  পৃথিবীকে অক্টোপাসের মতো গ্রাস করবে এবং বিশ্ব মানবতার মনোজগতকে একেবারে ভূমিকম্পনের মতো এবরো থেবরো করে দেবে তা নিয়ে হয়তো কখনো কল্পনাও করেননি। কিন্তু নাথান ডুফোর ওগলসবি যেমন লিখেছেন, সোশ্যাল মিডিয়াকে কীভাবে আরও বিজ্ঞতার সাথে নেভিগেট করা যায়, সে সম্পর্কে তাদের অবশ্যই কিছু বলার ছিল। আজকের অনেক সামাজিক অসুস্থতার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকেই দায়ী করা হয়, কিন্তু এটি শুধুমাত্র আমাদেরকে এই রূঢ় বাস্তবতা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যে আমরাই আসলে সত্যিকারের দোষী। আমাদের ভোগবাদী মানষিকতা আর অসুস্থ আনন্দ পাওয়ার সন্মোহনী নেশা আমাদেরকে করে তুলেছে অসুস্থ সমাজের মানুষরুপী কীট। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের জনক হিসাবে পরিচিত সিক্স ডিগ্রির প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্ড্রু ওয়েইনরিচ, যিনি হারিয়ে যাওয়া লোকদেরকে খুঁজে পেতে কিংবা অপরিচিত লোকদের সাথে সংযোগ তৈরী করতে তার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিলেন ১৯৯৭ সালে। তিনি কি কখনো ভেবেছিলেন বিশ্বব্যাপী শতো কোটি মানুষের চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করে এক নতুন মনস্তাত্বিক পূঁজিবাদী বিপ্লব ঘটাবে এই সোশ্যাল মিডিয়া একদিন? কিংবা ব্রিটিশ বিজ্ঞানী টিম বার্নার্স-লি, যিনি ১৯৮৯ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আবিষ্কার করেন, কখনো কল্পনা করেছিলেন তার বিস্ময়কর উদ্ভাবনের কারনে বিশ্ব আজ এক নতুন প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বায়নের মুখোমুখি হবে? হয়তো না। আর তাইতো সম্প্রতি তিনি দুঃখ করে বলেন: অনলাইন বিশ্ব আজ বিপথে চলে গেছে। অত্যধিক ক্ষমতাধর আজ গুগল এবং ফেসবুকের মতো প্লাটফর্মগুলো এবং এরাই মানুষের ব্যক্তিগত ডাটা সংরক্ষন করছে।মানুষের প্রাইভেসী বলে আজ কিছুই নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে বিশ্ব মানবতা আজ বন্দী।

 

সোশ্যাল মিডিয়া আজ আমাদেরকে এক নতুন বাস্তবতায় ঠেলে দিচ্ছে। একদিকে অভূতপূর্ব প্রযুক্তির আর মুক্তবাজারের রমরমা ভোগবাদী বিলাসীতার অস্বাভাবিক প্রতিযোগীতা আর অন্যদিকে বেড়ে চলেছে এক মনস্তাত্বিক পূঁজিবাদের বিকাশ। বেড়ে চলেছে সামাজিক অসুস্থতা এবং মূল্যবোধের অপসৃয়ায়ন। এক অসহনীয় সোশ্যাল মিডিয়ার সামাজিক দর্শন। দার্শনিক চিন্তাভাবনার ব্যাপারটিই একটু অন্যরকম। এই জটিল বিশ্বায়নের ভোগবাদী সোশ্যাল মিডিয়ার দুর্বৃত্যায়নের মুক্ত বাজারে এক ভিন্ন মাত্রার প্রযুক্তি নির্ভর মুক্ত দার্শনিক চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ সর্বত্র। সব মানুষই এখন স্মার্ট, দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চিত্রকর, ডাক্তার, জ্যোতিষবিদ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি আর বক্তা। সব উচ্চমার্গের পেশাগুলির উপস্থিতি সেখানে। সবাই যেন বলতে চায় কিন্তু শোনার লোক নাই। বলাটাই মনে হয় একমাত্র বিনামূল্যের পন্য। সত্যিকারের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে লোকজন আর চিন্তিত নয়। জীবন নাকি এখন খুব জটিল এবং কখনো সখনো দূর্বোধ্য। তাই আনন্দ-উল্লাস নিয়ে থাকাটাই শ্রেয়। যতো পারো মাস্তি করে নাও। দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা করে কে কবে বড়লোক হতে পেরেছে। খাও-দাও-ফূর্তি করো-এই হোক জীবনের সারমর্ম। একেই বল টিক টক জীবন। হায়রে জীবনের দর্শন। তবে দর্শন নিয়ে আমার একটু মাথাব্যাথা আছে। আনন্দ না হোক অন্ততঃ জীবনের শান্তির জন্য হলেও প্রকৃত বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা উচিৎ পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে।

 

দর্শনটা কি সত্যি কোন সিরিয়াস ব্যাপার? "দর্শন" শব্দটি মূলতঃ দুটি ভিন্ন শব্দ থেকে এসেছে, "ফিলো" এবং "সোফিয়া", যার অর্থ "প্রেম" এবং "জ্ঞান"। সেই অর্থে দর্শন শব্দটির মানে হলো জ্ঞানের প্রতি প্রেম। বাস্তবিক অনুশীলনে, জ্ঞানের অন্বেষণ, অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান। দার্শনিকগন দর্শনকে চিন্তার শিল্প হিসেবে উল্লখ করেছেন; অনেকে আবার এটিকে মানুষের চিন্তা ও অনুভূতির পদ্ধতিগত অধ্যয়ন হিসাবে বর্ণনা করেছেন। কারো মতে জীবনের বাস্তব যে সব জিনিসগুলি নিয়ে মানুষ ভাবে, তাই দর্শনের চিন্তাভাবনা।  আর গভীর চিন্তা করার উপায় হলো বিশ্লেষণ এবং সংশ্লেষণ। এর মাধ্যমে সত্যকে আবিস্কার করা যায়। বিশ্লেষনের মাধ্যমে একটি কঠিন বিষয়কে ভেঙ্গে ভেঙ্গে আলাদা করা হয়; আর সংশ্লেষণ একটি নতুন ভাবনা গঠনের জন্য একগুচ্ছ ছোট ভাবনার অংশগুলিকে একত্রিত করার প্রয়াস। কোনো পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই বিশ্লেষণ এবং সংশ্লেষণ ব্যবহার করাকে দার্শনিক বৃত্তে বলা হয় "অনুসন্ধানের দার্শনিক মনোভাব।" এ জাতীয় দার্শনিক ব্যাপারগুলো সমাজের সবক্ষেত্রেই একসময় প্রচলিত ছিলো। কিন্তু এসব নিয়ে এখন আর মানুষ ভাবে না। এখনকার জীবন হলো বিশ্লেষন আর সংশ্লেষনের থেকে অনেক দূরে। আনন্দকে কোন রকমে হাতের মুঠোয় পাচ্ছি বটে ক্ষনিকের জন্য হলেও। কিন্তু নিজের অজান্তেই শান্তিগুলো হারিয়ে যায় চিরদিনের জন্য। তাই হয়তো আমরা আজ সাংঘাতিক বিপদগ্রস্থ।

 

সোশ্যাল মিডিয়ার আবির্ভাবের পিছনে কারন ছিল মানুষকে একে অপরের কাছাকাছি নিয়ে আসা। বছরের পর বছর ধরে আমরা বিশ্বকে গ্লোবাল ভিলেজ বলতে শুনেছি। এই বিশ্বায়নের যুগে সোশ্যাল মিডিয়াই আমাদের দীর্ঘদিনের হারানো বন্ধুত্ব পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করছে, নতুন বন্ধুত্ব তৈরি করেছে এবং সাধারণভাবে মানুষকে একে -অপরের খুব কাছাকাছি নিয়ে আসছে। যারা দীর্ঘদিন যাবৎ শৈশবের বন্ধুদের দেখেনি তারা তাদের বন্ধুত্বকে আবার জাগিয়ে তুলেছেন। পৃথিবীর সর্বত্র যোগাযোগ আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। অনলাইন যোগাযোগ সোশ্যাল মিডিয়ার সেরা অংশ। এইটাই আমাদের সামাজিক দর্শন হওয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু আমরা ভূলে গেছি যে আমাদের এই বিশ্ব ভোগবাদ আর আনন্দ-উল্লাসের, আমরা কোন আদর্শ বিশ্বে বাস করছি না। সময়ের সাথে সাথে, সামাজিক মিডিয়া ক্রমশ তার প্রকৃত অর্থের উদ্দেশ্য হারিয়েছে, অপ্রাসঙ্গিক (এবং অনেক সময় ভূয়া) তথ্য এবং অসুস্থকর বিষয়াদি ​​​​প্রচারের জন্য একটি সর্বজনীন স্থানে পরিণত হয়েছে। একদিকে এই প্লাটফর্মগুলো যেমন বিভিন্ন বাজারমূখী সংস্থাগুলির জন্য ব্যাবসা-বানিজ্যের বলয়কে প্রসস্থ করছে, নানাভাবে সামাজিক যোগাযোগে নিয়ে আসছে এক যুগান্তরকারী ইতিবাচক পরিবর্তন, তেমনি অন্যদিকে মানুষের মনোজগতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে অসুস্থতার বিষবাস্প।

 

মানুষকে একত্রিত করার পরিবর্তে এটি সংঘাতের নতুন পথ খুলে দিয়েছে। একটা সময় ছিল যখন মতানৈক্যকারী ব্যক্তিগন তাদের সমস্যাগুলি একান্তভাবে, নীরবে এবং অন্যকে না জানিয়েই নিজেদের মধ্যে বিবাদের মীমাংসা করতো। এখন এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। আমরা লন্ডন রায়টের কথা বা হংকং-এ  মাসব্যাপী শহর অবরোধের কথা ভুলে যাই নি কিংবা ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে ক্যাপিটল হিলের ভয়ানক সংঘাতের কথা। এই সবের পিছনে রয়েছে সোশ্যল মিডিয়ার লম্বা হাত। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার মানুষ কারা? নিয়মিত এমন কিছু লোক আছে যাদের মনে হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিত থাকা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই। তাদের কোন দার্শনিক ভাবনা (সবসময়ই অন্যের ভাবনা থেকে চুরি করা) বা একটি ছবি (অনেক সময়ই উগ্র মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ) পোস্ট না করে যেন এক ঘন্টাও কাটে না। নিজকে ছবির মাধ্যমে জাহির করার এ যেন একমাত্র উপায়। ছবির মাধ্যমে অন্যকে জানান দিচ্ছে যে তারা কোথায় গেছে বা কোথায় আছে, তারা কী খেয়েছে বা কী খাবে বা তারা কী রান্না করছে বা কী গাড়ী সম্প্রতি কিনেছে। অনেকে আবার সেলিব্রিটির স্টাইলে পোজ দিচ্ছে অহরহ। তাদের ধারনা যে তারা কীভাবে তাদের সময় কাটাচ্ছে তাতে প্রত্যেকেরই আগ্রহ রয়েছে। দিনে বেশ কিছু পোস্ট না করলে তাদের সম্ভবত ঘুম আসে না।  সোশ্যাল মিডিয়ার কারনে বরং মানুষের মধ্যে দিন দিন দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে, মানুষ হয়ে পড়ছে আত্মকেন্দ্রীক এবং বেশী মাত্রায় ভোগবাদী।

 

মাঝে মাঝে আমি ভাবি এই মানুষগুলো কি কখনো ঘুমায়? কারণ তারা সবসময়ই সোশ্যাল মিডিয়াতে উপস্থিত থাকে বলে মনে হয়, গভীর রাতে এবং ভোরে, অনেক সময় এমনকি যখন তাদের কর্মক্ষেত্রে বা স্কুলে থাকা উচিত। সমপ্রতি ডিমান্ড সেইজ (২০২৩) পরিসংখ্যান মতে বিশ্বে বর্তমানে ৪.৯ বিলিয়ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী রয়েছে এবং ২০২৭ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৫.৮৫ বিলিয়ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী হবে বলে আশা করছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে ফেসবুক সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এটির বর্তমানে ২.৯১ বিলিয়ন ব্যবহারকারী রয়েছে। সংখ্যার দিক থেকে পূর্ব এশিয়ায় সর্বাধিক সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারকারী (২৬ শতাংশ)। বিশ্বে গড়ে একজন মানুষ প্রতিদিন দুই ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাবহার কারীর সংখ্যা ২৫ মিলিয়ন এবং বিশ্বের বিশতম স্থানে অবস্থান করছে। সত্যি সত্যিই এক ভয়ানক চিত্র। এক ধরনের মনোজগতের সাম্রাজ্যবাদীতা। আগে ব্রেইন ওয়াশের কথা শুনতাম। এবার সোশ্যাল মিডিয়ার দৌড়াত্বে মানুষের ব্রেইনটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পাবে। দার্শনিকতার ভাবনা তো দূর ছাই! তবে নতুন এক উপদ্রপ দেখতে পাচ্ছি ইদানীং। সোশ্যাল মিডিয়ায় দার্শনিকতার ভূরিভোজ আর চর্বিত চর্বনের প্রতিযোগীতা। এজাতীয় দার্শনিকরা খুব সক্রিয় যারা তাদের প্রাচীরকে জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক সমস্ত কিছু উল্লেখ করে উদ্ধৃতি দিয়ে প্লাবিত করছে সারাক্ষন। তারা অন্যদের যে জ্ঞানের বানী শুনাচ্ছেন তা তারা অনুসরণ করেন কিনা তা জেনে রাখা ভাল। অথবা এটি শুধুমাত্র বুদ্ধিমান দেখানোর একটি অপ-প্রচেষ্টা কিনা। তারা কি সত্যিই বোঝে তারা কি পোস্ট করছে? সোশ্যাল মিডিয়া শুধুমাত্র পোস্ট করা লোকেদের জন্য নয়। এটি মন্তব্যকারী বা লাইক দেওয়া লোকদের জন্যও। আবার অনেকে সবজান্তা বিশেষজ্ঞ। তারা সর্বদা যে কোন পোষ্টে কমেন্ট করার জন্য প্রস্তুত থাকেন অতি আগ্রহে ।

 

সোশ্যাল মিডিয়া আজ একটি নতুন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যখন কোন মতবিরোধ হয় তখন সোশ্যাল মিডিয়াতে যে পরিমাণ ঘৃণা ছড়ায় তা অবিশ্বাস্য। সোশ্যাল মিডিয়া যতটা না নতুন বন্ধুত্ব তৈরি করেছে, তার চেয়ে বেশী সৃষ্টি করছে শত্রুতা। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্যের কারনে অনেক লোককেই আদালতে তোলা হয়েছে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে অশ্লীলতা, ঘৃনা, অপরাধ আর সামাজিক অবক্ষয়। বিশেষকরে তরুন সমাজ আজ বেশ ক্ষতিগ্রস্থ। এটাই বাস্তবতা যে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আমাদের জীবনকে যেমন উন্নত করছে এবং একই সাথে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাই এ অসুস্থ সামাজিক দর্শনকে সবাই সঠিক প্রাজ্ঞতার সাথে মোকাবেলা করবে এটাই হোক সকলের প্রচেষ্টা, কারন সোশ্যাল মিডিয়া আজ আমাদের জীবনেরই একটি অংশ।

Leave your review