চাই উবুন্টু দর্শনে আলোকিত উবন্টু শিক্ষার্থী

একটি সমৃদ্ধ এবং নৈতিক জাতি গঠনে মানবিক ও প্রায়োগিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষাগত পেশায় আছি বলে বর্তমান বিশ্ব শিক্ষা ব্যাবস্থায় একটি আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে সময়পোযোগী এবং নৈতিক নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটি বিশেষ তাগিদ অনুভব করছি। শিক্ষা সম্প্রদায়ের মধ্যে আমার গভীর সংপৃক্ততা এবং অধ্যায়ন আমাকে এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে যে, ভোগবাদীতা নয় বরং নৈতিকতা এবং আত্মউপলদ্ধি অন্বেষনে গুনগত মানের শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিকাশের জন্য মানবিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহান চিন্তাবিদ এবং তাদের প্রগতিশীল ধারণাগুলি অবশ্যই আজকের শিক্ষাবিদদের বোঝা উচিত যারা জ্ঞান এবং আত্ম-উপলব্ধির উন্মেষের প্রানকেন্দ্র। এই বিশ্বায়নের আর অভূতপূর্ব প্রযুক্তির উন্নয়নের সমসাময়িক অস্থির, জটিল এবং অনিশ্চিত বিশ্বে একটি সত্যিকারের সমৃদ্ধ এবং উন্নত জাতীগঠনে চাই উবুন্টু (ubuntu) দর্শনে আলোকিত উবুন্টু নাগরিক। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধটিতে শিক্ষা ব্যবস্থায় আফ্রিকার জনপ্রিয় উবুন্টু দর্শনকে অন্তর্ভুক্ত করার ইতিবাচক প্রভাবগুলি অনুসন্ধান করার চেষ্টা করবো, যা শিক্ষার্থীদের শুধু আত্মবিশ্বাসী নয় বরং আরও নৈতিক নাগরিক হতে সাহায্য করবে।
রেনে দেকার্তসকে সাধারণত অগ্রগামী সমসাময়িক দার্শনিক হিসেবে আক্ষ্যায়িত করা হয়। "আমি আছি, কারন অন্যেরা আছে বলে" তিনি এই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন। আমাদের আত্মবোধকে উপলদ্ধি করার এক বিস্ময়কর নান্দনিক দর্শন। উবুন্টু আত্মউপলদ্ধির এক সামাজিক মন্ত্র, সংক্ষেপে, যার অর্থ হল মানুষের বর্তমান পরিচয় এবং অস্তিত্বের মূলে রয়েছে  চারপাশের মানুষের অস্তিত্বের কারন। অন্যের অস্তিত্ব আছে বলেই আমরা আছি। সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং মানবিক চেতনায়ই সম্প্রদায়ের মানুষগুলোকে আলোকিত করে তুলে। তার ব্যর্ত্যয়ই বরং সামাজিক অবক্ষয় আর দূরাচার এবং পংকিল আত্মকেন্দ্রিক অসুস্থতা। অন্য লোকেদের সাথে আলাপচারিতা এবং সুষম বন্ধুত্বের কারনেই, একজন ব্যক্তি সত্যিকারের ব্যক্তি হয়ে ওঠে। আমাদের এই নশ্বর পৃথিবীতে কেউ যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সম্পূর্ণরূপে মানবিক কিংবা পূর্নাঙ্গরুপে জন্মায় না। আমরা সঠিকভাবে ভাবতে, চলতে, বা কথা বলতে জানি না। কিন্তু ধীরে ধীরে প্রকৃতির নিয়মেই আমরা ভাবতে শিখি, বলতে শুরু করি, চলতে পারি। আমাদের আচার-আচরনে আসে ঋজুতা। অন্যদের কাছ থেকে শিখে এবং জেনে আমরা প্রতিনিয়ত হই সমৃদ্ধ। তাই আমাদের মানবিক বিকাশের জন্য অন্য মানুষের সঙ্গ প্রয়োজন, সামাজিক সুসম্পর্কেই বেঁচে থাকার প্রেরনা।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, জাতির উন্নতির জন্য শিক্ষার ক্ষেত্রে উবুন্টুর উপর বেশ জোর দেওয়া হচ্ছে পৃথিবীর নানা দেশে। উবুন্টু দর্শন সম্প্রদায় এবং সামাজিক সংযোগের মূল্যকে জোর দেয়। উবুন্টুর মূল কথা "আমি আছি কারণ আমরা আছি"। এর মানে হল আমরা সকলেই সংযুক্ত এবং একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এই দর্শন শিক্ষাসহ জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শিক্ষার ক্ষেত্রে উবুন্টু আমাদের শিক্ষার্থীদের অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বিনয়ী, সহানুভূতিশীল হতে এবং বৃহত্তর ভালোর জন্য সহযোগিতা করতে শেখানোর মাধ্যমে একটি উন্নত জাতি গঠনে সাহায্য করতে পারে। আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় উবুন্টু প্রয়োগ করে বা উবুন্টু-মনস্ক মানুষের একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি উন্নত দেশ তৈরি করতে পারি। শিক্ষাকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করার জন্য উবুন্টুকে অবশ্যই পাঠ্যক্রমে সংযুক্ত করা উচিত এবং শেখানো উচিত যাতে শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে একটি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের অংশ হিসাবে দেখতে পায়। উবুন্টু শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি সহনশীল হতে এবং অন্যের প্রতি নমনীয় হতে শেখায়। উবুন্টু একটি যত্নশীল, সহানুভূতিশীল, ন্যায়সঙ্গত এবং শান্তিপূর্ন সমাজ তৈরি সহ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সহায়ক। একটি টেকসই সম্প্রদায় গড়ে তুলতে উবন্টু মূল্যবোধের প্রভাব অনস্বিকার্য। এই দার্শনিক বার্তা আমাদের তরুণ মনকে আত্মবিশ্বাসের সাথে বেড়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে।
সারা বিশ্ব আজ হিংসা, বিদ্বেষ, অনাচর, দূর্বিত্যায়ন আর ঘৃণায় লিপ্ত। এটি মূলত জনসংখ্যার মধ্যে সম্প্রদায়ের অনুভূতির অভাবের কারণে। ফলস্বরূপ, উবুন্টুর দর্শনকে আরও ভালভাবে বোঝার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ, যা একটি ইতিবাচক মানসিকতার সাথে একটি সমৃদ্ধ ও নৈতিক জাতি গঠনের জন্য স্কুলগুলিতে শেখানো উচিত। উবুন্টু এমন একটি দর্শন যা মানুষকে প্রথমে অন্যের কথা ভাবতে শেখায়। উবন্টু হলো সকলের জীবনকে আরও ভালো করার জন্য একসাথে কাজ করার প্রাসঙ্গিকতা। শিক্ষার ক্ষেত্রে, উবুন্টু হল সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে একসাথে কাজ করার জন্য নিবেদিত শিক্ষার্থীদের একটি সম্প্রদায় গঠন করার প্রয়াস। এটি সম্প্রদায়, সহযোগিতা এবং সম্মানকে মূল্যবোধ হিসাবে প্রচার করে। যখন আমরা আমাদের সন্তানদের এই মূল্যবোধগুলি শেখাই, তখন তারা উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয় যে সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সহযোগিতার বিকল্প নেই। নেলসন ম্যান্ডেলা ২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সাংবাদিক টিম মোডিসেকে উবুন্টুর আফ্রিকান আধ্যাত্মিক নীতি ব্যাখ্যা করেছিলেন এই ভাবে: "একটি দেশের মধ্য দিয়ে একজন ভ্রমণকারী যখন কোন একটি গ্রামে প্রবেশ করে, তখন তাকে খাবার বা জলের জন্য জিজ্ঞাসা করতে হবে না। বরং গ্রামের লোকেরা তাকে খাওয়া এবং আপ্যায়ন করে মনের সুখে”। এটি উবুন্টুর দার্শনিক চেতনা, যা দক্ষিন আফ্রিকার একটি উন্নত দার্শনিক ধারনা। 
আমি নিশ্চিত যে শিক্ষার ক্ষেত্রে উবুন্টুর দার্শনিক চেতনা আমাদের সন্তানদের নৈতিক বিকাশের পরিপূরক এবং একটি ন্যায়সঙ্গত উন্নত জাতী  গঠনে সাহায্য করবে। সম্প্রদায়, মানবতাবাদ এবং সমষ্টিবাদের মূল্যবোধকে আলোকিত করাই এ দর্শনের মূল ভিত্তি। এই মূল্যবোধগুলি একটি জাতির উন্নয়নে অপরিহার্য কারণ তারা ঐক্যবদ্ধতা এবং সাধারণ ভালোর ধারণাকে প্রচার করে। শিক্ষা যে কোনো সমাজেরই ভিত্তি, এবং শিক্ষার মাধ্যমেই আমরা একটি উন্নত ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারি। শিক্ষার শেষ লক্ষ্য হওয়া উচিৎ মানবিক চরিত্রের বিকাশ সহ সফল জীবন।  উবুন্টু দর্শন বর্ণবাদ, কুসংস্কার এবং বৈষম্যের দ্বারা সৃষ্ট বাধাগুলি ভেঙে দিয়ে একটি মানবিক জীবন বিকাশে সাহায্য করতে পারে। আমরা একে অপরকে সমান হিসাবে দেখতে ও শিখতে পারি এবং সমাজের উন্নতির জন্য একসাথে কাজ করার প্রেরনা পেতে পারি। শিক্ষায় উবুন্টু এমন একটি তরুণ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে পারে যারা বাকি বিশ্বের সাথে তাদের আন্তঃসংযোগের সমন্বয়কে বেগবান করতে পারবে। আমাদের সন্তানেরা আমাদের দেশের ভবিষ্যত, এবং তাদের সাফল্যের পথকে প্রসারিত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় উবুন্টুকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি সুষম সহনশীল সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যা অন্তর্ভুক্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা বোধকে জাগ্রত করবে এবং শিক্ষার্থীরা তাদের স্বীয় সম্প্রদায়ের কর্মের জন্য দায়বদ্ধতা গ্রহণ করতে উত্সাহিত হবে। উবুন্টু শিক্ষার্থীদের সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রচারে সাহায্য করতে পারে এবং একসাথে কাজ করার মাধ্যমে সাধারণ লক্ষ্য অর্জন সহ সাফল্যের জন্য সহযোগিতার অপরিহার্যতা অনুধাবন করতে শেখে।
উবুন্টুর সম্ভাবনা অনস্বীকার্য এবং শিক্ষায় এই দার্শনিক ধারনাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার মাধ্যমে একটি সুস্থ জনগোষ্ঠী তৈরি করা সম্ভব। "আমি আছি কারণ আমরা আছি," উবুন্টু দর্শনের প্রথম নীতি। এর মানে হল আমরা সবাই আন্তঃসংযুক্ত, এবং আমাদের সাফল্য সম্প্রদায়ের সাফল্যের উপর নির্ভরশীল। আমাদের সম্প্রদায়ের উন্নতি না হলে আমরা সত্যিকারের সুখী বা পরিপূর্ণ হতে পারি না। উবুন্টুর দর্শনের দ্বিতীয় নীতি হলো মানুষের বৃহত্তর ভালোর জন্য একসঙ্গে কাজ করা নীতি। উবুন্টু দর্শন মানুষকে উৎসাহিত করে অন্যদেরকে নিজেদের থেকে বেশী গুরুত্ব দিতে এবং সহযোগিতা করতে। উবুন্টুকে প্রায়শই "মানবতার দর্শন" হিসাবে দেখা হয়। উবুন্টু দর্শন যে সব মৌলিক নীতিগুলির উপর প্রতিষ্ঠিত: মানবতা হলো অন্যদের সাথে মর্যাদা এবং সহানুভূতির সাথে আচরণ করা। আমাদেরকে সৎ এবং সত্যবাদী হওয়া প্রয়োজন। ন্যায়বিচারের প্রয়োজনে আমরা যেন অন্যদের সাথে ন্যায্য এবং ন্যায়সঙ্গত আচরণ করি। আমাদের উচিত অন্যদের প্রতি সদয়, সহানুভূতিশীল এবং শ্রদ্ধাশীল হওয়া। আমরা সবাই সম্মানের যোগ্য, তাই মর্যাদার সাথে আচরণ করা উচিত। আমাদের উচিত অন্যদের প্রতি দয়া দেখানো। 
উবুন্টু দর্শনের তিনটি মৌলিক নীতি: সত্য, ন্যায়, এবং প্রেম একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য। এই মূল্যবোধগুলির প্রত্যেকটিই তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু সবগুলির সমন্বয়ে হয়ে উঠে আরো মহৎ এবং শক্তিশালী যা একটি সত্যিকারের সহানুভূতিশীল এবং শ্রদ্ধাশীল সম্প্রদায় তৈরি করতে সম্পূরক। উবুন্টু হল সম্প্রদায়কেন্দ্রিক ভালোবাসা এবং সহযোগিতায় পূর্ন মর্যাদার সাথে বসবাসকরার মন্ত্র। সমাজের সবাইকে নিয়েই বেঁচে থাকার প্রেরনা। অন্যকে বাদ দিয়ে শুধু নিজকে নিয়ে ভাবনাই অমানবিক এবং অগ্রহনযোগ্য। আমরা কখনোই সত্যিকারের সুখী বা পরিপূর্ণ হতে পারি না যদি না আমরা একটি সহায়ক, যত্নশীল এবং শান্তিপূর্ণ সম্প্রদায় গড়ে তোলার জন্য কাজ করি। সমবেদনা, নম্রতা, সম্মান এবং সেবার প্রতিশ্রুতি উবুন্টুর দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সমবেদনা হলো উলদ্ধিরবিষয় যে আমরা সবাই একসাথে আছি এবং আমরা একে অপরের উপর নির্ভর করি। আমরা সবাই পরস্পর সংযুক্ত এবং আমাদের কর্ম অন্যদের প্রভাবিত করে। সমবেদনা হলো অন্যদের সাহায্য করার এবং তাদের ব্যথা উপশম করার ইচ্ছা। নম্রতা হলো বাস্তবতার স্বীকৃতি এবং গ্রহণ। সুখ এবং পরিপূর্ণতা শুধুমাত্র একসাথে কাজ করার মাধ্যমে পাওয়া যেতে পারে। উবুন্টু সম্প্রদায়ের মূল্য এবং সম্প্রীতির সাথে বসবাসের উপরও জোর দেয়। উবুন্টু বিশ্বাস করে যে আমরা যখন একসাথে কাজ করি তখন আমরা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠি। এটি একটি সম্প্রদায় এবং সহযোগিতা ভিত্তিক দর্শন। এই দর্শনের আলোকিত বীজ রোপন করার মাধ্যমেই আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে করতে পারি সমৃদ্ধ এবং মানবিক। তাই শিক্ষায় উবন্টু দর্শনের সংযোজনা অতীব প্রয়োজন। আমাদের প্রতিটি সন্তানের চেতনায় প্রস্ফুটিত হোক উবন্টুর নান্দনিকতা। হয়ে উঠুক এক নয়, লক্ষ নয়, অগনিত অযুত উবন্টু।

Leave your review