ইউক্রেন – রাশিয়ার যুদ্ধের কারন ও প্রেক্ষাপট-পর্ব দুই

গত লেখায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে রুশ প্রেসিডেন্টের ন্যাটো কতৃক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগের বিষয়ে একটি বিস্তারিত আলোচনা অন্য কোন লেখায় আলোকপাত করবো। তাই আজকের লেখায় এই বিষয়ে বিশেষ করে পুতিনের দাবীর সত্যতা এবং আজকের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট নিয়ে কয়েকটি বিষয়ে মূল্যায়নমূলক বিশ্লেষন করার চেষ্টা করবো যা থেকে অন্তত এইটাই প্রতীয়মান হবে যে ন্যাটো এবং বিশেষ করে মার্কিন প্রশাসন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য ইউক্রেইন আক্রমন করা ছাড়া কোন বিকল্প রাখেনি। পৃথিবীর কোন শান্তিকামী মানুষ যুদ্ধ চায় না। যুদ্ধ মানেই ধ্বংশ, বিভীষিকা, মৃত্যু আর ঘর ছাড়া মানুষের কান্না, শিশু আর বৃদ্ধের অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা পান্ডূর মুখ। পৃথিবী দুই দুইটি বিশ্ব যুদ্ধ দেখেছে, যুদ্ধের বিভীষিকায় প্রায় ধ্বংশ হয়ে গেছে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান। আনুমানিক ১০ মিলিয়ন সামরিক জোয়ান সহ প্রায় সাত মিলিয়ন বেসামরিক মৃত্যু ঘটেছে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে। একুশ মিলিয়ন মানুষ আহত হয়েছিলো এবং অজানা অগনিত মানুষ হয়েছিলো নিঁখোজ কিংবা কারারুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ষাট মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলো তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী মারা যায় রাশিয়ান, বিশ মিলিয়নেরও বেশী। আজ চলছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডঙ্কা। কোন ভূল সিদ্ধান্তের কারনে যদি এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে তবে তার পরিনতি হবে ভয়াবহ। এ হবে পারমানবিক যুদ্ধ যার অশনি সংকেত আমরা শুনতে পারছি। সাড়া পৃথিবী এক লহমায় থমকে যাবে। এখনো সময় আছে সমস্ত অহম আর আগ্রাসন ছেড়ে কুটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো এবং যুদ্ধ থামানোর সক্রিয় প্রচেষ্টা চালানোর। কিন্তু চালাবে কে? পশ্চিমা বিশ্বের ধারনা সাড়া পৃথিবী মানে ন্যাটো ভুক্ত দেশ সহ তার পশ্চিমা মিত্ররা। যুদ্ধ চালানোর অধিকার শুধু পশ্চিমাদের। সুতরাং রুশ প্রেসিডেন্ট যা করেছে তা অগ্রহনযোগ্য, গর্হিত এবং হিটলারীয়। প্রতিশোধ আর রাশিয়াকে চরমভাবে কোনঠাসা এবং অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু আর অস্পৃশ্য দেশে পরিনত করার উন্মাত্ততায় মেতে আছে পশ্চিমা দেশগুলি। কিন্তু কেন? বিশ্ববাসীকে প্রশ্ন করতে হবে জোরে সোরে। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে?

এই লেখাটি যখন লিখছি স্কাই নিওজে শুনছি ইউরোপের সর্ববৃহৎ পারমানবিক বিদুৎ কেন্দ্র আক্রান্ত এবং রাশিয়ান সৈন্যদের দখলে। আতংকে গোটা বিশ্ব। আর এই সময়েই বার বার মনে পড়ছে আমার এক অগ্রজ অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র একজন দক্ষ প্রকৌশলী যিনি দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশে পল্লীবিদুৎ সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাবস্থাপনার পদে নিয়োজিত ছিলেন এবং বর্তমানে অনেকদিন যাবৎ যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন তার কয়েকটি কথা। খুব বিষন্নভাবেই বলছিলেন-যুদ্ধ মানেই মানুষের প্রাণহানি, মানুষের দুর্ভোগ, রোগের বিস্তার, মানুষের বাস্তুচ্যুতি এবং পরিবেশের ধ্বংসের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি। ১৯৭১-এ আমি যুদ্ধের বিভীষিকা দেখেছি, এখনো বুলেটের শব্দ কানে বাজে। তাই আর যুদ্ধ নয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একটা নিয়ম ছিলো। এখনকার যুদ্ধে কোন নিয়ম নেই শুধু ধ্বংশযজ্ঞ আর জীবন কেড়ে নেওয়া ছাড়া। সত্যেই তাই। সুস্থ মানুষ কখনো ধ্বংশ চায় না। ছোটবেলা থেকেই কবিগুরর লেখা “নৈবদ্য” কাব্যগ্রন্থের “ন্যায়দন্ড” কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন দুটো শুনে আসছি।  “অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে; তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে”। কি চমৎকার অন্তর্নিহিত ভাব! আজ রবীঠাকুরের মতো মানুষের বড়ো প্রয়োজন এই পৃথিবীর। কোথাও কোন স্বস্তির বার্তা নেই। শুধুই হুংকার আর ষড়যন্ত্রের পায়তারা। শুধু রুশ প্রসিডেন্টকে দোষারুপ করলেই চলবেনা সাথে সাথে যারা আজকের এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্যে দায়ী তাদের দিকেও অঙ্গুলী হেলন করতে হবে। প্রয়োজনে চোখে চোখ রেখে বলতে হবে যে কোন অন্যায় এই পৃথিবী মেনে নিবে না। এখানে আমি আর তুমি বলে কিছুই নেই। এখানে শুধু আমরা, বিশ্ববাসী।

দীর্ঘ দু দশক ধরে রুশ প্রেসিডেন্ট যে দাবীগুলো করে আসছিলো সেই দাবিগুলির মধ্যে রয়েছে ইউক্রেনের ন্যাটোতে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং ন্যাটোর পূর্ব দিকে সৈন্য ও অস্ত্র মোতায়েনের সীমাবদ্ধতা, কার্যত ন্যাটো বাহিনীকে পূর্ব দিকে সম্প্রসারণের আগে ১৯৯৭ সালে যেখানে তারা অবস্থান করেছিলো সেখানে ফিরিয়ে নেওয়া। ভ্লাদিমির পুতিন আরো দাবি করেছেন যে পশ্চিমারা রাশিয়াকে তার নিরাপত্তার "আইনি গ্যারান্টি" প্রদান করবে এবং ন্যাটো ইউক্রেন সহ পূর্ব ইউরোপ, জর্জিয়া বা মধ্য এশিয়ার মতো ককেশাস দেশগুলিতে রাশিয়ার কাছ থেকে পূর্ববর্তী চুক্তি বা অনুমতি  ছাড়া কোন ধরনের সামরিক মহড়া করবে না। কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের ষাট বছর পর, ইউক্রেনের যুদ্ধ বিশ্বকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছে যেখানে পারমাণবিক অস্ত্রের বিনিময় একটি সত্যিকারের বিপদ। পশ্চিমা বিশ্বের আর্কাইভ থেকে নতুন আবিস্কৃত নথি এবং তথ্য রুশ সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করে। কমসোমলস্কায়া প্রাবদার বলীষ্ট, জনন্দিত এবং জনপ্রিয় কলামিষ্ট ভিকটর বারোনেজ সম্প্রতি তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন যে ন্যাটো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং ন্যাটোকে কখনো বিশ্বাস করা যায় না। পূর্ব ইউরোপের দিকে সম্প্রসারন করতে করতে ন্যাটো আমাদের জাতীয় সীমানা পর্যন্ত তার পথ ঠেলে দিয়েছে এবং জার্মান পূনর্মিলনের সময় দেয়া প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করেছে। স্পাইগেল ইন্টারনেশনালের (Spiegal International) এক প্রবন্ধে (২৯.১১.২০০৯) লেখা হয়েছে যে মস্কোতে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত (১৯৮৭-১৯৯১) জ্যাক মাটলক অতীতে বলেছিলেন যে “মস্কোকে একটি স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিলো”।

৯ই ফেব্রুয়ারী  ১৯৯০ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী বেকার এবং রুশ প্রসিডেন্ট গর্বাচেভের মধ্যে কোন এক বৈঠকের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি এসেছিল। কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুনর্মিলিত জার্মানিকে ন্যাটোর কাঠামোর মধ্যে রাখতে চায় তা ব্যাখ্যা করার জন্য বেকার গর্বাচেভকে বলেছিলেন যে "আমরা যদি জার্মানিকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তি করি, তাহলে ন্যাটোর বাহিনী পূর্বে এক ইঞ্চিও সম্প্রসারন করবে না।" জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কোহলকে লেখা একটি চিঠিতে বেকার এইকথা স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন যে "'আপনি কি ন্যাটোর বাইরে একটি অখন্ড জার্মানি দেখতে পছন্দ করবেন, নাকি এক ইঞ্চিও  পূর্ব দিকে ন্যাটো বাহিনিকে সম্প্রসারন করবেন না এমন আশ্বাস দিয়ে ন্যাটোর সাথে ঐক্যবদ্ধ জার্মানিকে দেখতে পছন্দ করবেন”?  ২৯শে নভেম্বর ২০০৯ সালে স্পাইগেল ইন্টারন্যাশনালে প্রকাশিত “পশ্চিমা বিশ্ব  কি মস্কোর কাছে তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে”? শিরোনাম এক প্রবন্ধের উপসংহারে যা বলেছেন তার মোদ্দাকথা হলো -সেই সময়কার জড়িতদের অনেকের উক্তি, বক্তব্য এবং পচ্চিমা আর্কাইভের নথিপত্র থেকে স্পাইগেল ইন্টারন্যাশনালে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে এতে কোন সন্দেহ নেই যে পশ্চিমারা সোভিয়েতদের এই ধারনা দেওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলো যে ন্যাটোর সদস্যপদ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী, চেকোস্লোভাকিয়া সহ অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির জন্য প্রশ্নের বাইরে।

স্পাইগেল ইন্টারন্যাশনালের সূত্রমতে (২৬.১১.২০০৯) ফেব্রুয়ারীর ১০তারিখ ১৯৯০ বিকাল চারটা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে, জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রী হ্যান্স ডিয়েট্রিস গেনসার এবং তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র মন্ত্রী শেভার্ডনাডজের সাথে কথা বলেছিলেন। কথোপকথনের জার্মান রেকর্ড অনুসারে, যা সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে, গেনসার বলেছেন: "আমরা সচেতন যে একটি ঐক্যবদ্ধ জার্মানির জন্য ন্যাটো সদস্যপদের বিষয়টি কটু জটিলতার সৃষ্টি করছে, তবে আমাদের জন্য একটি বিষয় নিশ্চিত: ন্যাটো পূর্বে প্রসারিত হবে না৷ " শেভার্ডনাদজে উত্তর দিয়েছিলেন যে তিনি গেনসারের কথায় একমত এবং দৃঢ়ভাবে  তা বিশ্বাস করেন।" ১৯৯০  সালটা  ছিলো একট গুরুত্বপূর্ন বিষয় এবং জার্মান একত্রীকরনের ব্যাপারটা ছিলো প্রধান আলোচনার একটি। ওয়াশিংটন, মস্কো, লন্ডন, বন, প্যারিস, ওয়ারশো, পূর্ব বার্লিন এবং আরও অনেকে জার্মান ঐক্য, ইউরোপীয় নিরস্ত্রীকরণ এবং ইউরোপে নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সম্মেলনের একটি নতুন চার্টার নিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে মতবিরোধে ছিলো। সেই সময়  সোভিয়েতরা জোর দিয়েছিলো যেন সবকিছু লিখিতভাবে নথিভুক্ত করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেদিনের অসংখ্য চুক্তিতে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো সম্প্রসারণ সম্পর্কে একটি শব্দও ছিল না। ইচ্ছে করেই তা চুক্তি থেকে বাদ দেওয়া হয়। এ ছিলো পশ্চিমাদের এক সুদূরপসারী পরিকল্পনার রোডম্যাপ। এ কারণেই পশ্চিমাদের যুক্তি, মস্কোর আজ অভিযোগের কোনো কারণ নেই। সর্বোপরি, পশ্চিম পূর্বে ন্যাটো সম্প্রসারণের বিষয়ে কিছু স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু সেই কঠোর অবস্থান কি ন্যায্য? বিভিন্ন পশ্চিমা আর্কাইভ থেকে পাওয়া নানা প্রতিশ্রুতি সবই কি মিথ্যা? নাকি যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ন্যাটো দেশভুক্ত পশ্চিমাদের কাছে মুখের প্রতিশ্রুতির কোন মূল্য নেই? তাই বটে! নৈতিক ভাবে বিপর্যস্থ পশ্চিমা যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক এবং তাদের দোষরদের কাছে প্রতিশ্রুতির যে কোন মূল্য নেই! কিন্তু এইটা অন্তত ঠিক রুশ প্রেসিডেন্ট যে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কথা বার বার বলেছেন তা একেবারেই সঠিক।

সম্প্রতি চীনা আ্যামবাসী মস্কো (২৮.০২.২০২২) এক ট্যুইটে লিখেছেন -১৯৪৫ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিশ্বর ১৫৩টি অঞ্চলে সংঘটিত ২৪৮ সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে ২০১টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা শুরু হয় যা মোট সংখ্যার ৮১ শতাংশ ছিলো। আজ ইউক্রেইনে যা ঘটে চলছে, এক রক্তক্ষয়ী বিভীষিকাময় যুদ্ধের তান্ডবতা, মরছে মানুষ এবং উদ্বাস্তু হচ্ছে লক্ষ লক্ষ ইউক্রেইনবাসী, কি এক ভয়ানক মানবিক ক্ষয়ক্ষতি। তার সবই কিন্তু অতি সহজেই থামানো যেতো। ছোট্ট একটি চুক্তি যেখানে ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্র একমত থাকবে যে ইউক্রেইকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া হবে না এবং একটি নিরপেক্ষ দেশ হিসাবে রাখা হবে এবং বাকী শর্তগুলির প্রশ্নে কুটনৈতিক আলোচনা চালিয় যাবে, তা হলেই আজকের এই পরিস্থিতি কাউকেই দেখতে হতো না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে ন্যাটো পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারন অব্যহত থাকে। ১৯৪৯ সালে ১২টি দেশ নিয়ে শুরু করা নাটোর সদস্য সংখ্যা আজ ত্রিশটি দেশ এবং ২০২১ সাল পর্যন্ত, ন্যাটো আনুষ্ঠানিকভাবে আরো তিনটি দেশকে সদস্যপদ দেওয়ার আশ্বাস দেয়: বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, জর্জিয়া এবং ইউক্রেন। অথচ আজ আর ঠান্ডা যুদ্ধ কিংবা ষ্টার ওয়ারের কোন আতংক নেই, ওয়ারশো প্যক্টকে বিলুপ্ত ঘোষনা করা হয়েছে পহেলা জুলাই ১৯৯১ সালে। তা হলে ন্যাটোর এতো সম্প্রসারন কেন?

Leave your review