ইউক্রেন – রাশিয়ার যুদ্ধের কারন ও প্রেক্ষাপট-পর্ব এক

সারা বিশ্ব আজ স্তম্ভিত, হতবাক আর বিস্ময়ভরে তাকিয়ে আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অসংখ্য প্রানহানী, অর্থনৈতিক আর সামাজিক ধংশযজ্ঞের ভয়াবহতার পর কেউ ভাবতেও পারেনি চাকচিক্যময়, শান্তি, গনতন্ত্রের পুরোধা, তথাকথিত ন্যায্যতা আর সমতার প্রানকেন্দ্র, বাকস্বাধীনতার  প্রবর্তক এবং রক্ষক ইউরোপ আবার যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় মেতে উঠবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পর গত ৭৫ বছরে প্রায় অনেকগুলো যুদ্ধের বিভিষীকা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। বিংশ শতাব্দীতে কম পক্ষে ১০৮ মিলিয়ন মানুষ ভয়াবহ যুদ্ধে প্রান দিয়েছে। গত পাঁচ দশকের যুদ্ধের নিশংসতায় দুই পরাশক্তি হারিয়েছে অসংখ্য সৈন্য। ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রায় ষাট হাজার আমেরিকান জোয়ানরা প্রান হারায়। আফগানিস্থানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় পনের হাজার সৈন্য মারা যয় এবং ত্রিশ হাজারেরও বেশী সৈন্য যখম হয়। কমপক্ষে দশটি যুদ্ধ সংঘঠিত হয় ২০১৭সালে। ফেব্রুয়ারীর ২৬ তারিখ চীনা কুটনৈতিকরা সম্প্রতি মার্কিন সামরিক অভিযানের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে যেখানে চীনা কুটনৈতিকরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে আমেরিকা পৃথিবীর শান্তির অন্তরায় ও প্রধান হুমকি এবং ন্যাটো সহ ইইউ, যুক্তরাজ্য এই হুমকির সক্রিয় সহযোগী। অথচ আজ ইউরোপের বৃহত্তম দেশ পূর্ব ইউরপের ইউক্রেনে যা ঘটছে তাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপ, ন্যাটো ও অন্যান্য মিত্র দেশগুলি সকলেই রাশিয়াকে দোষারুপ করছে। চলছে তীব্র নিন্দা আর ঘৃনার প্রচন্ড ঝড় এবং উত্তাপ। রাশিয়া নাকি বীনা প্ররোচনায় ইউক্রেনের উপর পাশবিক হামলা চালায় যা আন্তর্জাতীক আইনের লঙ্ঘন। এই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? কেনই বা আমরা আজ সকলেই এক বিভিষীকাময় অজানা আশংকা আর ভয়াবহতার মুখোমুখী দাড়িয়ে। তার একটি সহজ এবং বিশ্লেষনধর্মী ব্যাখ্যার আলোকপাত  করার চেষ্টা করবো এই লেখায়।

মনরোর সে বিখ্যাত উক্তিটি একটু স্মরণ করতে চাই। আমার উঠোনে কে? আমার শ্রদ্ধাভাজন এক বন্ধু যিনি দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশের বামধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন বর্তমানে বসবাস করছেন যুক্তরাজ্যে, এই প্রসঙ্গে একটি গল্প বলেছিলেন আমাদের রবিবারের এক গপসফ আড্ডায়। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে যে গ্রামে উনারা বসবাস করতেন সেইগ্রামে এইটা প্রচলন ছিলো যে গ্রামের কেউ যদি কোন জায়গা জমি বিক্রি করতে চায় তা হলে সেই গ্রামের কেউ না কেউ তা ক্রয় করতো যেন অন্য কোন গ্রামের কেউ কিনতে না পারে। কোন অনাকাঙ্খিত ঝামেলা এড়াতে এবং প্রকৃতপক্ষে গ্রামের শান্তি বজায় রাখার জন্যই এই কাজটা করা হতো। সত্যেইতো তাই। নিজের ঘরের কাছে কেইবা অশান্তি বাড়াতে চায়। আর তা যদি কোন প্রতিপক্ষ গ্রামের মধ্যে ঘটে তা হলেতো কথাই নেই। অশান্তি অবশ্যম্ভাবী!  রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের ঐতিহ্যগত এলাকা, বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকার ক্ষেত্রে এই বিশেষ উক্তিটি ব্যবহার করা হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই রাশিয়া তার জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সহ ন্যাটোকে জানিয়ে আসছিলো এবং ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারনের ব্যাপারে পশ্চিমাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথাও স্মরণ করে দিচ্ছিলো। কিন্তু এ ব্যাপারো ন্যাটো কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের কোন সঠিক সাড়াশব্দ নেই বরং ব্যাপারটা মনে হচ্ছিলো “তুই কে হনুরে ভাই” এর মতোই। এদিকে ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি মদদে ময়দান বিপ্লবের মাধ্যমে তৎকালীন ইউক্রেনের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ভিকটর ইয়োকোনভিচকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে একটি পাপেট সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয় এবং তার পরবর্তি ঘটনা প্রবাহ সকলেরই কম বেশী জানা। যেমন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তি করন এবং দনবাসের (দানিয়েস্ক এবং লুগান্সকের ) একটা অংশ প্রো-রাশিয়ান বিপ্লবীদের দখল নেওয়া এবং সেই থেকে চলে আসা এক রক্তাক্ত ভয়ানক যুদ্ধ যেখানে প্রায় পনের হাজার লোক প্রান হারিয়েছে। সে থেকে আজ পর্যন্ত মিনস্ক চুক্তিকে বাস্তবায়নের ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলি কোন প্রকার উদ্যেগ নেয়া তো দুরের কথা বরং তা যেন বাস্তবায়িত না হয় সেই ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সহ তার মিত্ররা সক্রিয় ছিলো। সেই প্রক্ষাপটে গত ১৭ই ডিসেম্বর ২০২১ সালে রাশিয়া “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে নিরাপত্তা গ্যারান্টি সংক্রান্ত চুক্তি” নামে একটি খচরা চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে পাঠায়। আটটি প্রস্তাবনা রাখা হয় সে খচরা চুক্তিটিতে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো প্রধান কয়েকটি প্রস্তাবনার কোন তোয়াক্কা না করেই নিজেদের পছন্দ মতো কয়েকটি প্রস্তাবনার ব্যাপারে কুটনৈতিক আলোচনার প্রস্তাব দেয়। স্বভাবতই রাশিয়া তাতে সন্তুষ্ট হয় নি বরং ক্ষুদ্ধ  হয়েছে এবং ন্যাটোকে সময় বেঁধে দেয় রুশ প্রস্তাবকে মেনে নেওয়ায় জন্য। পাঠকের সুবিধার্থে এখন একটু প্রস্তাবনাগুলির দিকে আলোকপাত করবো।

প্রস্তাবনাগুলি হলো: (১) সকল পক্ষই অবিভাজ্য, সমান এবং অপরিমীত নিরাপত্তার নীতির ভিত্তিতে সহযোগিতা করবে: অন্য পক্ষের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে এমন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ বা অংশগ্রহণ বা সমর্থন করবে না;  কোন পক্ষের দ্বারা পৃথকভাবে বা কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা, সামরিক জোট বা জোটের কাঠামোতে গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলি বাস্তবায়ন করবে না যা অন্য পক্ষের মূল নিরাপত্তা স্বার্থকে ক্ষুন্ন করতে পারে; (২)দলগুলি নিশ্চিত করতে হইবে যে, কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা, এবং সামরিক জোট যেখানে অন্তত একটি পক্ষ অংশ নিচ্ছে সেখানে জাতিসংঘের সনদে অন্তর্ভুক্ত নীতিগুলি মেনে চলে; (৩) পক্ষগুলি অন্য রাষ্ট্রের অঞ্চলগুলিকে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ বা অন্য পক্ষের মূল নিরাপত্তা স্বার্থকে প্রভাবিত করে এমন কোন পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুত বা পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে না; (৪)মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রোধ করতে এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রাক্তন ইউনিয়নের রাজ্যগুলিতে জোটে যোগদানকে অস্বীকার করার দায়িত্ব নেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাক্তন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ইউনিয়নের রাজ্যগুলির ভূখণ্ডে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করবে না যেগুলি ন্যাটোর সদস্য নয়, কোনও সামরিক কার্যকলাপের জন্য তাদের অবকাঠামো ব্যবহার করবে না বা তাদের সাথে দ্বিপাক্ষিক সামরিক সহযোগিতা বিকাশ করবে না; (৫)দলগুলি তাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং অস্ত্র মোতায়েন করা থেকে বিরত থাকবে। দলগুলি পরমাণু বা অ-পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য সজ্জিত ভারী বোমারু বিমান উড্ডয়ন করা থেকে বিরত থাকবে বা আন্তর্জাতিক সংস্থা, সামরিক জোট বা জোটের কাঠামো সহ, জাতীয় আকাশসীমা এবং জলসীমার বাইরের অঞ্চলে যে কোনও ধরণের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা থেকে বিরত থাকবে। (৬)দলগুলি তাদের জাতীয় অঞ্চলের বাইরে স্থল থেকে উৎক্ষেপণ করা মধ্যবর্তী এবং স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন না করার অঙ্গীকার করবে, সেইসাথে তাদের জাতীয় অঞ্চলগুলির ভিতর, যেখান থেকে এই জাতীয় অস্ত্রগুলি অন্য পক্ষের জাতীয় অঞ্চলের লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ করতে পারে: (৭)দলগুলি তাদের জাতীয় অঞ্চলগুলির বাইরে পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপন করা থেকে বিরত থাকবে এবং তাদের জাতীয় অঞ্চলগুলির বাইরে পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপনের জন্য বিদ্যমান সমস্ত অবকাঠামো নির্মূল করতে হবে। দলগুলি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য অ-পারমাণবিক দেশগুলির সামরিক এবং বেসামরিক কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেবে না; (৮)চুক্তিটি শেষ লিখিত বিজ্ঞপ্তি প্রাপ্তির তারিখ থেকে কার্যকর হবে।

এই খচরা চুক্তিগুলো কি কোন অযোক্তিক ছিলো? কিংবা রাশিয়া বা ট্রান্স-আটলান্টিক নিরাপত্তার প্রশ্নে একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো কিছু? মোটেই না। তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সহ ন্যটোভুক্ত দেশগুলো কেন রুশ প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে আজকের এই ভয়াবহ যুদ্ধের পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো? এট কি শুধুই আত্মনিয়ন্ত্রণ, আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা বা গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সরকারকে উদ্ধার করার পশ্চিমাদের আন্তরিক অঙ্গীকার? নাকি রাশিয়ার নিরাপত্তাকে অস্থিতিশীল করার জন্য ইউক্রেনকে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহার করে রাশিয়াকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার এক সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা। ব্যাপারটিকে একটু স্পষ্ট করার জন্য কয়েকটি বিষয়ের দিকে এবার একটু নজর দেয়া যাক।

রুশ প্রেসিডেন্ট গত দুই দশক ধরে বার বার যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধ পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারন না করার যে প্রতিশ্রুতি ১৯৯০ সালে দুই জার্মানীর একত্রীকরনের সময় দিয়েছিলো তা ভঙ্গ করার অভিযোগ করে আসছিলো। কিন্তু কেউ রুশ প্রসিডেন্টের এই অভিযোগকে কোন আমলেই নেয় নি বরং বার বার অবমূল্যায়ন করেছে। কেউ কেউ আবার পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। রাশিয়াকেই বার বার আগ্রাসন না করেও আগ্রাসীর ভুমিকায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অনেকে হয়তো ভাববেন আগ্রাসীইতো বটে! এক লহমায় ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছে কিংবা দনবাসে একটা অনাকাঙ্খিত যুদ্ধ বাঁধিয়ে প্রো-রাশিয়ান সরকার বসিয়ে রেখেছে। চিন্তার কারন নেই। পরবর্তী লেখায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখবো। তা হলে পুটিন কি সত্যেই অযৌক্তিক কিছু বলছে?

গত তিন দশক ধরে ন্যাটো সহ মার্কিনীদের সশস্ত্র বর্বরতা সাড়া পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান সব জায়গায় চলেছে ন্যাটো বাহিনীর তান্ডব লীলা। গনতান্ত্রীক ভাবে নির্বাচিত সরকারের প্রতি পাশবিক বর্বরতা। সাড়া বিশ্বতো সেই জন্য কোন প্রতিবাদ করে নি? পশ্চিমা মিডিয়াতো ন্যাটোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়নি কিংবা কারো দ্বারা কোন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসেনি? তা হলে আজ রাশিয়ার কর্মকান্ডে সকলের এতো মাথা ব্যাথা কেন? কেনই বা এই পরিস্থিতিকে থামানোর কোন পশ্চিমা দেশ কোন সঠিক উদ্যেগ নেয়নি? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যাদের একটিই উদ্দেশ্য রাশিয়াকে দূর্বল করা, কোন ঠাসা করা, যাতে করে তাদের তৈরী নিয়মগুলিকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায়। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের আজ যুদ্ধে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত পশ্চিমাদেরই অহং আর আগ্রাসনের বহিঃপ্রকাশ। পৃথিবীর কোন শান্তপ্রিয় মানুষ কোন যুদ্ধ চায় না।

Leave your review