'এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে'

উনবিংশ শতাব্দী ছিলো বাঙালী সাহিত্য এবং সংস্কৃতির এক অভাবনীয় সমৃদ্ধি এবং নবজাগরনের স্বর্নময় অধ্যায়। বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিলো পৃথিবীর কিছু শ্রেষ্ট মানব সন্তান, যাদের চিন্তা-চেতনা আর দার্শনিক ভাবনার আলোকবর্তিকায় আলোকিত হয়েছিলো বাংলা এবং বাঙালীর আত্মপরিচয়ের শৈল্পীক ঠিকানা। বাংলার শীতল উর্বরা মাটিতে কি নিবির মমতায় শুয়ে আছেন আমাদের সেই পূর্বসূরী বাংলা রেঁনেসার প্রবাদপুরুষেরা, যাদের প্রেরনার গন্ডোলায় আর এই ভুখন্ডের নদ-নদী আর জল-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছি আমরা এবং কয়েক প্রজন্মের মানুষেরা। আমরা এখনো কোন না কোন ভাবে ধারন, লালন এবং পালন করি এই মনিষীদের দার্শনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক ভাবনাগুলিকে। নিজকে করি সমৃদ্ধ এবং ঋজু। আর যারা করতে পারি না তারা হয়তো হেঁটে চলি এই পান্ডুর অসুস্থ সময়ের বুকে কীট পতঙ্গের মতো অন্ধত্বের অভিশাপের বোঝা নিয়ে। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রাজনারায়ন বসু, দীনবন্ধু মিত্র, বংকিম চট্টোপাধ্যায়, মীর মোশারফ হোসেন, হাসন রাজা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দক্ষিনারন্জন মজুমদার সহ আরো অনেকে বাংলাকে দিয়েছেন এক বিশাল সাহিত্য ভান্ডার এবং আমাদেরকে শিখিয়েছেন নান্দনিক পথে চলার উচ্ছ্বাস আর অমীয় প্রেরনা। তাঁদের একজন যিনি ঐতিহ্যের অনুবর্তিতা অমান্য করে নতুন ধ্যান ধারনায়  নিজকে উৎসর্গ করেছিলেন এক বিশাল স্বপ্নকে সামনে রেখে, কেড়ে নিয়েছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবির খেতাব, বাংলা নবজাগরনের পুরোধা, বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক, উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ট বাঙালী কবি, নাট্যকার এবং চিন্তাবিদ মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কোন বৃত্তে যেন বাঁধা তাঁর জীবন নয়। স্থিততা যেন অস্থিরতার সামিল।  তাই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন নানা জায়গায়, খুঁজে ফিরেছেন নতুনের

 

'এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে'- কে না শুনেছে এই কাব্যপংক্তিটি। প্রতিটি বাঙালীর মননে ধারন করে এই কয়েকটি শব্দ। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি এই কবিতাটি। মেঘনাদ বধ কাব্যে থেকে নেয়া। এই কাব্যপঙ্‌ক্তি বাঙালি সমাজের জনপরিসরে বহুল উচ্চারিত।  মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিরচিত মহাকাব্য 'মেঘনাদবধ' । রাবনপুত্রের হাহাকার মিশ্রিত এই উপলদ্ধি বাঙালী সমাজের আনাচে-কানাচে, ঘর-গেরস্থালীতে কিংবা সামাজিক পরিমন্ডলে এক প্রাঞ্জল প্রবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোন কঠিন পরিস্থিতি কিংবা দূর্বোধ্য বিষয়কে বুঝতে না পারার শেষ অন্তে যখন বোধগম্য হয় বা ভ্রম কেটে যায় তখন আমরা অনেকেই এই কাব্যপঙ্‌ক্তিটি উচ্চারণ করে থাকি। এই মহাকাব্যের রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত। রামায়ন উপাখ্যান অবলম্বনে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত মেঘনাদবধ কাব্যটি ছিলো মধুসূদন দত্তের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। তিনি ১৮২৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি বৃটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত বাংলা প্রদেশে (বর্তমানে বাংলাদেশ) যশোর জেলার কেশবপুরের কাছে সাগরদাঁড়ি নামক ছোট্ট গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত তার পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। তার পিতা রামনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানী আদলতের একজন খ্যাতনামা উকিল। ছোটবেলা থেকেই তিনি সাহিত্য ও কবিতা লেখার প্রতি গভীর আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে মাইকেল 'বীরাঙ্গনা' নামে তার প্রথম কবিতাটি লেখেন। পনের বছর বয়সে এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল, যা তাকে অনেক খ্যাতি ও স্বীকৃতি এনে দেয়। তার পর থেকেই শুরু হলো তার সাহিত্যে পদচারনা।

সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্ম হলেও ছোট কাল থেকেই পাশ্চাত্য সাহিত্যে ছিলো দূর্নিবার আকর্ষন মধুসূদন দত্তের। তাই ইংরেজী সাহিত্যে বেশ ভালোভাবেই মনোনিবেশ করেন। নিজের গ্রামের বাড়ী সাগরদাড়িতে মাত্র পনের বছর বয়সে স্কুলের শিক্ষা শেষ করার পর পিতা রাজনারায়ন দত্ত ছেলেকে ব্যারিষ্টার হওয়ার আশায় কলকাতার হিন্দু কলেজে ভর্তি করান। ইংরেজী পাঠ্যক্রমে মধুসূদন অধ্যায়ন শুরু করেন এবং খুব অল্প দিনের মধ্যেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় মধুসূদনের আগ্রহ বেড়ে যায়।  ১৯৭৩ সালে কলকাতা সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পরই বাঙালী এলিট হিন্দুদের মধ্যে ইংরেজী ভাষা শেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। আর সেই কারনেই নেটিভদের উন্নয়নের জন্য শিক্ষাবিদ ডেভিড হেয়ার এবং রাজা রাধাকান্ত দেবের সার্বিক সহযোগীতায় কলকাতায় ইংরেজীতে শিক্ষাদানের প্রচলন শুরু হয়। কলেজটি আনুষ্ঠানিকভাবে  ১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারী খোলা হয়েছিল। রাজা রাম মোহন রায়ের নেতৃত্বে কলেজের ফাউন্ডেশন কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। এখানে পড়াকালীন সময়ে থেকেই বিদেশী বা আ্যংলো-ইন্ডিয়ানদের সাথেই ছিলো তার বেশী উঠা-বসা। এই প্রতিষ্ঠানটি চলতো বিলেতের মতো পরিবেশেই। পশ্চিমা পোশাক পড়া থেকে শুরু করে, খাবারের সময় ইংরেজী কায়দায় কাটলারি ব্যাবহার করা, ইউরোপীয়ান খাবার খাওয়া, পাশ্চাত। সাহিত্য-সংগীত এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠা, চলনে-বলনে প্রায় সব কিছুতেই দৃশ্যতঃ হতো পশ্চিমা শৈলী। লক্ষ্য ছিলো একটি উন্নতমানের ভারতীয় ইরেজী জানা মধ্যবিত্ত শ্রেনী তৈরী করা যারা ঔপনিবেশিক প্রশাসনে কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করবে। এই হিন্দু কলেজে পড়াকালীন সময় থেকেই মধুসূদনের মধ্যে ভারতীয় এবং বাংলা সংস্কৃতির প্রতি অনিহা  দেখা দেয় এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ তৈরি করেন। যা পরবর্তীতে তার জীবনকে চালিত করে এক অপ্রীতিকর গন্তব্যের দিকে যার অসহ্য প্রবাহের দাবদাহে তার শেষ বয়সের দিনগুলো এক বিষাদ আর ট্র্যাজিডীর বাতাবরনে অতিবাহীত হতে থাকে। এ যেন জীবনের প্রাপ্যতা, তাকে খন্ডাবে কি করে?

বৃটিশ লাইব্রেরীর তথ্যমতে ১৮৩৩ সালের দিকে, মধুসূদন দত্ত এবং তার পিতামাতা কলকাতায় চলে আসেন যেখানে তার পিতার সাফল্য তার ছেলেকে ভাল শিক্ষা দিতে সক্ষম করে তুলে। ১৮৪২ সালে পিতা রাজনারায়ন যখন ছেলের বিবাহের বন্দোবস্থ করেন তখনই মধুসূদন বাঁধ সাধেন। শেষ পর্যন্ত স্ব্প্ন আর প্রাশ্চাত্যের নতুন নতুন চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের ধর্মকে ত্যাগ করে যৌবনেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহন করে মাইকেল মধুসূদন নামটি গ্রহন করেন। বাংলা ভাষায় আর না লেখে ইংরেজীতে লেখার প্রতি মনোযোগ দেন। পাশ্চাত্বের মোহে চোখে তুলে নেন স্বপ্নের ঘন মেঘমালা। চলতে থাকেন এক নতুন খ্যাতির সন্ধানে। মাত্র উনিশ বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট মধুসূদন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তার কিছুদিন পর ৯ই ফে্রুয়ারী ১৮৪৩ ওল্ড মিশন চার্চ নামে কলকাতার মিশন রো-তে অবস্থিত এক আ্যংলিকান চার্চে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহন করেন। সেই চার্চের পাদ্রী মধুসূদন দত্তকে দীক্ষিত করেন এবং তার নামের আগে মাইকেল যুক্ত করেন। হয়ে যান মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কিন্তু তার এই ধর্মান্তরনের কারনে সাথে সাথে নেমে আসলো সামাজিক, পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়। সমাজে সৃষ্টি হলো ব্যাপক আলোড়ন। রাগে, ক্ষোভে এবং কষ্টে পিতা রাজনারায়ন একমাত্র সন্তানকে অস্বীকার করে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষনা করেন। মমতাময়ী মা ভীষন কষ্ট পেলেন। বিষাদে ভেঙ্গে পড়লেন। কিন্তু স্বামীর আজ্ঞাকেই ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিলেন। হঠাৎ করেই যেন এক বজ্রাঘাতে পরিবারের সবকছু লন্ডভন্ড হয়ে গেলো। মধুসূদনের জীবন যেন বিচ্যুত নক্ষত্রের মতো ছিটকে পড়লো আকাশ থেকে। কিন্তু পাশ্চাত্যের হাওয়ায় ভেসে চলা  টগবগে যুবকের উদ্বেলিত প্রান সেইদিনের বিপর্যয়ে রাগ করেছিলো তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু তাঁর ভয়াবহ পরিনতিকে উপলদ্ধি করার দূরদর্শিতা এবং প্রাজ্ঞতা হয়তো ছিলো না। আর তাইতো জীবনের এক প্রান্তে এসে বেঁজে উঠে কপোতাক্ষ্যের বন্দনা এবং ফেলে আসা জীবনের আহাজারি:“সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে, সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে। শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে, জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে। বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলেদুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।“

 

বাঙালীর বাঙালীত্বকে পরিহার করে স্বপ্ন বিভোর কবি পরে নিলেন প্রাশ্চাত্যের পোশাক আর রীতি নীতি। ত্যাগ করলেন পিতা, প্র-পিতামহের সামাজিক পরম্পরা। খ্রীষ্টধর্ম গ্রহনের পরও শিবপুরের বিশপস কলেজে পড়াশুনা চালিয়ে যান। পুত্রকে ত্যাজ্য করলেও পিতা রাজনারায়ন দত্ত কলেজে পড়াশুনার খরচ বহন করতে থাকেন। চার বছর পর্যন্ত সে খরচ বহন করেন। মধুসূদন এর মধ্যে বিশপস কলেজ থেকে অধ্যায়নের পাঠ সফলতার সাথে শেষ করেন। বিশপস কলেজে থাকাকালিন সময়ে মধুসূদন দত্ত সংস্কৃত সহ ল্যাতিন এবং গ্রীক ভাষা শিক্ষা লাভ করেন।  কলেজ বন্ধুদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলো মাদ্রাজি। তারাই পরবর্তীতে মধুসূদনকে নানাভাবে সহযোগীতা করে। কলেজের ডিগ্রী পাওয়ার পর অনেক চেষ্টা করেও যখন চাকরির কোন সুবিধা করতে পারলে না তখন মাদ্রাজি বন্ধুদের সহযোীতায় মধুসূদন ১৮ই জানুয়ারী ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজে চলে যান। শুরু হলো তার জীবনের নতুন এক অধ্যায়। তবে পরিবারের কাছ থেকে অর্থনৈতিক ভাবে আর কোন সাহায্য পাননি কলেজ শেষ করার পর। অনুমান করা হয় নিজের পাঠ্যপুস্তক বিক্রি করে নাকি মধুসূদন মাদ্রাজে আসার খরচ যোগান। হায়রে ভাগ্য! জীবনে দুঃখের পাত্র এতোটাই উপচানো থাকে যে প্রত্যেককেই কিছু না কিছু দুঃখ বহন করতে হয়। কি চমৎকার এবং বাস্তব উপলব্ধি কবি শেলীর। কিন্তু এই দুঃখ আর বিষাদের সাগরে এ যেন সুচনার দিক মধুসূদনের জন্য। পেছনে ফেরার যেন আর কোন উপায় নেই।

 

এখানে এসেও তেমন কোন সুবিধা হলো না মধুসূদনের। অনেক চেষ্টা করেও একটি চাকুরি জোগার করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত মাদ্রাজে ইংরেজ এবং খ্রীষ্টান বন্ধুদের সহযোগীতায় কোন রকম চলার মতো একটি স্থানীয় ইংরেজি স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরি পান। কম বেতন থাকায় সংসারের ব্যায় সংকুলান হতো না। খুব কষ্টেই চলতো দিন। তাই একটু বাড়তি রোজগারর আশায় লিখতে শুরু করলেন ইংরেজী পত্র পত্রিকায়। সেই সময়ে লিখলেন তার প্রথম ইংরেজী কাব্যগ্রন্থ দ্য ক্যাপটিভ লেডি । আশি পৃষ্ঠার এ বইটি প্রকাশ করেন মাদ্রাজের বিজ্ঞাপনদাতা প্রেস এবং প্রকাশকাল ১৮৪৯। বইটি প্রকাশের পরপরই ইংরেজি কবি ও লেখক হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। মাদ্রাজে আসার কিছুকাল পরেই ২৪ বছর বয়সে, জুলাই মাসের ৩১ তারিখ ১৮৪৮ সালে মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে মাদ্রাজের এক মহিলা অরফান অ্যাসাইলামের ১৭ বছরের এক ইংরেজ যুবতীকে বিবাহ করেন। আজকের প্রেক্ষাপটে একজন শিক্ষক এবং একজন ছাত্রীর মধ্যেকার সম্পর্ককে কলঙ্কজনক বলে মনে করা হবে, কিন্তু বাল্যবিবাহ তখন রেবেকার মতো যুবতী মহিলাদের জন্য সম্পূর্ণ সম্মানজনক বলে বিবেচিত হত। এই প্রথম বিয়ের যবনিকাপাত হয় আট বছর পর। মধুসূদন দত্ত এবং রেবেকার চারটি সন্তান ছিল। ১৮৫৫ সালে বাবার মৃত্যুর পর যখন মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন, মাদ্রাজে রয়ে যান রেবেকা। তবে তাদের  বিবাহ বিচ্ছেদের কোন সঠিক তথ্য মেলেনি কিন্তু তার কিছুদিন পরেই আরেক ইউরোপীয় মহিলা হেনরিয়েটা সোফিয়া হোয়াইটের সাথে মধুসূদন নতুন জীবন শুরু করেন। হেনরিয়েটাই মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন।

স্বদেশে থাকাকালীন সময়ে মধুসূদন দত্ত বেশ খ্যাতি এবং যশ লাভ করেছিলেন। কিন্তু পাশ্চাত্যের ধ্যান ধারনায় নিমগ্ন উচ্চাকাঙ্ক্ষী কবি পরিতৃপ্ত হতে পারেননি। বড়ো ধরনের স্বপ্নের পসরা নিয়ে এগিয়ে চলার এক অদম্য স্পৃহায় ভাসমান ছিলেন। দূর্বার উচ্চকাঙ্খা ও অপরিতৃপ্ত বাসনা তাকে তার শৈল্পিক স্বত্ত্বাকে স্বদেশের মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলো, বেঁধেছিলো পাশ্চাত্য রীতি-নীতির বেড়াজালে। আর তাইতো কবি ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ দেশান্তরে। মাদ্রাজেও মধুসূদন তেমন কোন সুবিধা করতে পারেননি। পদে পদে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়েই চলছিলো তার মাদ্রাজী জীবন। পাননি দুদন্ড শান্তি। আবারো অন্যপথে হাঁটার পরিকল্পনায় কবি যাত্রা শুরু করলেন বিলেতের উদ্দেশ্যে। তার বাবার ইচ্ছে ছিলো মধুসূদন একদিন ব্যারিষ্টার হবে। তাই ১৮৬২ সালে জুন মাসের ৯ তারিখে মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়ার মনোবাসনায় বিলেতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। কিন্তু তিনি কি কখনো ভেবেছিলেন মা-মাটি-মানুষ আর স্বদেশীয় প্রেম-ভালোবাসা আর গুরুজনদের আশির্বাদের করস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়ে ভীনদেশী  আলো-বাতাসে তার পথচলা কখনোই মসৃন হবে না, বরং দুখ-কষ্ট আর বেদনায় পর্যবসিত হবে তার জীবন। সব যেনো বিধি বাম! সব কষ্টের ঢেউগুলো যেন এক সাথেই আসে এবং সব কিছুকে লন্ড ভন্ড করে দিয়ে যায়। তাই ঘটলো মধুসূদনের জীবনে। যে যশ, খ্যাতি আর আর্থিক নিরাপত্তার আশ্বাসে তিনি বিলেত যাত্রা করেন তা অচিরেই ভেঙ্গে গেলো। পরিবার এবং আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের দুয়ার বন্ধ হয়েছে অনেক আগেই। কলকাতায় তার স্ত্রী হেনরিয়েটা দুই শিশু সন্তানদেরকে নিয়ে সংসারটাকে আর সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছিলেন না। অর্থনৈতীক ভাবে একেবারে দুর্দশায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত  নিত্যন্ত নিরুপায় হয়েই ১৮৬৩ সালের ২রা মে হেনরিয়েটা সন্তানদেরকে নিয়ে কলকাতা ছেড়ে বিলেতে স্বামীর কাছে এসে পৌঁছান। তার পরের ঘটনাগুলো আরো কষ্টদায়ক।

 

অপেন ইউনিভার্সিটির আর্খাইভের তথ্যানুসারে প্রাথমিকভাবে তিনি লন্ডনে মনোমোহন ঘোষ এবং সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে থাকতেন এবং গ্রে'স ইনে ভর্তি হন ব্যারিষ্টারি পড়ার জন্য। আর্থিক সমস্যা এবং জাতিগত কুসংস্কারের কারনে তিনি বেশীদিন বিলেতে থাকতে পারেননি। কম টাকায় সংসার চালিয়ে লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে পারবেন বলে তিনি সপরিবারে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চলে যান ফ্রান্সের ভার্সাইতে। সময়টা ছিলো ১৮৬৩ সালের ১৭ জুন। তবে মাঝে মাঝে ব্যারিষ্টারি পড়াশুনার জন্য বার আয়োজিত নৈশভোজে যোগদানের জন্য লন্ডনে আসতেন এবং শেফার্ডস বুশে বসবাস করতেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদারতার কারণেই তিনি শেষপর্যন্ত বারের জন্য পড়াশোনা করতে সক্ষম হন। এ জন্য কবি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন বিদ্যাসাগরকে দয়ার সাগর হিসাবে বিবেচনা করতেন। নানা বাধা-বিপত্তি আর অর্থনৈতিক দূরাবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবন যুদ্ধের সংপৃক্ততা তাকে ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতি মোহভঙ্গ করে ফেলেছিল। তিনি ফ্রান্সে থাকাকালীন সময়ে এক চিঠিতে তার উপলব্ধির কথাই বন্ধু বসাককে লিখেছিলেন:“যদি আমাদের মধ্যে কেউ থাকে যে তার পিছনে একটি নাম রেখে যাওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন, এবং পাশবিকের মতো বিস্মৃতিতে চলে না যায়, সে যেন তার মাতৃভাষার জন্য নিজেকে উত্সর্গ করে। এটাই তার শেকড়,পরম বৈধ ক্ষেত্র এবং জীবন চলার সারথী” (উৎস: বৃটিশ লাইব্রেরী)

যুক্তরাজ্যে বসবাসের সময়কালে, তিনি দর্শন এবং রাজনীতি সহ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন যা লন্ডন টাইমস এবং দ্য এডিনবার্গ রিভিউ-এর মতো সংবাদপত্রে  প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি চার্লস ডিকেন্সের মতো বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীর সাথেও বন্ধুত্ব করেছিলেন যারা তার কাজের প্রচারে সহায়তা করেছিলেন। ইংল্যান্ডে থাকার সময়, মাইকেল 'কৃষ্ণ কান্তের উইল', 'দুর্গেশানন্দিনী'  এর মতো কিছু অবিশ্বরনীয় নাটক লিখেছেন, সেইসাথে ঈশপের রূপকথা এবং উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা সংকলন সহ ইংরেজি থেকে বাংলায় বেশ কিছু অনুবাদ করেছেন। রচনা করেছিলেন লিরিক্যাল ব্যালাডস, যা তাকে ভারতে স্বদেশী সাহিত্যিকদের মধ্যে বেশ বিখ্যাত করে তুলেছিল। ১৮৫৮ থেকে ১৮৬২ সময়কালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কবি এবং নাট্যকার হিসেবে ছিলেন খ্যাতির শীর্ষে। একের পর এক লিখেছেন শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯), পদ্মাবতী (১৮৬০), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০), একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০), কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১)। এছাড়া মৃত্যুর পূর্বে মায়াকানন (১৮৭৪) নামে একটি অসমাপ্ত নাটকেও হাত দিয়েছিলেন। ১৮৬৫ সালে তিনি ভার্সাই থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং দুঃখ কষ্টের উত্তাল বৈতরনী পার হয়ে শেষ পর্যন্ত ১৮৬৬ সালে ব্যারিস্টার হন। ৫ই জানুয়ারী তিনি আইন অনুশীলনের জন্য কলকাতায় ফিরে আসেন, কিন্তু ব্যারিস্টার হিসাবে তিনি ভালভাবে গৃহীত হননি। তার কয়েক বছর পর ১৮৭০ সালে তিনি অনুশীলন ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সৌভাগ্যক্রমে, মধুসূদন কখনই লেখা ছেড়ে দেননি।

এতো দুঃখ কষ্টের মধ্যেও মধুসূদন ভেঙ্গে পড়েননি। ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে অবস্থানকালে তিঁনি ইতালীয় কবি পেত্রার্কের সনেট থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রথম বাংলা সনেটের দিগন্ত উন্মোচন করেন। প্রকাশ করেন তার চতুর্দশপদী কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে ১৮৬৬ সালে। এই কবিতাগুলোর লাইনে লাইনে, শব্দ আর অক্ষরের অলি-গলিতে কবি প্রকাশ করেছেন তার কবি চিত্তের ব্যাকুলতা, হাহাকার, বিষাদগ্রস্থতা, স্বদেশ প্রেম আর নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি পরম শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। ভারসাই নগরীতে বসে কবি লিখলেন:

 

“সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।
 সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-মন্ত্র ধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে !
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে ?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে !”

 

শেষ পর্যন্ত পারলেন না পাশ্চাত্যের জল-হাওয়ায় নিজকে ধরে রাখতে। বুঝতে পারলেন বিদেশী সংস্কৃতি-শিক্ষা, রীতি-নীতি গ্রহন করা যতো সহজ তাকে ধারন করে বেঁচে থাকা যায় না। নিজের শেকড়ের মধ্যে বিরাজিত তার স্বীয় স্বত্তা, আত্ম পরিচয়, নান্দনিক উৎকর্ষতা এবং পরম শান্তিতে বেঁচে থাকার নির্ভরতা। এই উপলব্ধি আর দুঃখ-কষ্টের বঞ্চনা থেকে নিজকে মুক্ত করার জন্য পাঁচ বছর বিদেশে থাকার পর মাইকেল মধুসূদন দত্ত অবশেষে স্বদেশে ফিরে আসেন। এই সময়ের মধ্যে বংলার সাহিত্য আকাশে কতো মেঘমালার পরিবর্তন হয়েছে। এসেছে এক ভিন্ন মাত্রার ঋজুতা। শেষ পর্যন্ত ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে এলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বেঁচে থাকবেন বাঙালীর মাঝে যুগ যুগ ধরে, শুধু মাত্র তার সাহিত্যিক অবদানের জন্যই নয়, ধ্রুপদী ভারতীয় কবিতায় এক নব জাগরন সৃষ্টি করার জন্য, বংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দে চতুর্দশপদ কবিতার জনক হিসেবে যা শতো প্রজন্মের বাঙালীর সাহিত্য মনকে প্রভাবিত করবে।

“মানুষ যাহা চায় তা পায় না, আর যাহা পায় তাহা চায় না”। কবি গুরুর এই দর্শন তত্বটি কবি মধুসূদনের জীবনের এক সার্থক প্রতিফলক। কি চেয়েছিলেন, আর কি পেলেন। তার শেষ জীবনটা যেন গ্রীক নাটকের ট্র্যাজিডির মতো। খুব দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে থাকে তার দৈনন্দিন জীবন। আইন ব্যবসায়ে তিনি তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। স্বভাবে ছিলেন অমিতব্যায়ী যা এক সময় তাকে চরম ঋনগ্রস্থতার মধ্যে ঠেলে দেয়। এই প্রবাদপুরুষের এমন করুন মৃত্যুর কেউ হয়তো কল্পনা করেননি। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে কলকাতার সার্কুলার রোডে সমাধিস্থ করা হয়। মহাকবি জীবনের অন্তিম পর্যায়ে জন্মভূমির প্রতি তার সুগভীর ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় পংক্তিমালায়। তার সমাধিস্থলে লেখা রয়েছে সেই বিখ্যাত কবিতাটি যেখানে কবি মাইকেল নামটিকে কর্তন করে শুধু লিখলেন শ্রীমধুসূদন। এই যেন তাঁর আত্মপরিচয়, জীবন দর্শনের শেকড় :

'দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে

(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী'

তিনি আবারো সদর্পে ঘোষনা করলেন পরিবার, সমাজ, স্বদেশ আর জন্মভূমির শীতল জল-হাওয়ায় বেড়ে উঠা জীবনই সবচেয়ে অমৃত। দুঃখ-কষ্ট, যশ-খ্যাতি আর বৈচিত্রতার অলি-গলিতে চলতে চলতে একদিন এই মহান কবি চলে গেলেন এই জাগতীক পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু পেছনে রেখে গেছেন মেঘনাদ বধ মহাকাব্যের মতো বিশাল এক সাহিত্য ভান্ডার। তাই তিনি বেঁচে থাকবেন হাজার বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার সৃষ্টির জন্য সমগ্র বাঙালী এবং ভারতীয়দের হৃদয়ে। অম্লান হয়ে থাকবেন আমাদের চিন্তা চেতনায় আর ভাবনায়।

 

 

Leave your review