টেমসের তীরের নগর কাব্য -বৃটিশ রাজার অভিষেকে জননেত্রী শেখ হাসিনা

৬ই মে ২০২৩ বৃটিশ ইতিহাসে যুক্ত হলো আরেকটি নতুন অধ্যায়। অত্যন্ত জমকালো অনুষ্ঠানাদি এবং রাজকীয় আরম্ভরনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে বৃটিশ রাজ পরিবারের চল্লিশতম রাজ্যাভিষেকটি। এই দিনে রাজা চার্লস এবং তার স্ত্রী রানী ক্যামিলার রাজ্যাভিষেকটি অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন সারা বৃটেন জুড়ে ছিলো সাঁজ সাঁজ রব, নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা ছিলো সারা শহর, মাতোয়ারা ছিলো সারা দেশ, উল্লাসের উন্মাদনায় ব্যাস্ত নগরী আর গ্রাম-গন্জের পথ জনপদ, প্রকৃতিও ছিলো খুব শান্ত। তবে এই দ্বীপের আবহাওয়ার কথা কে না জানে? সারাটা দিন জুড়েই ছিলো হালকা বৃষ্টি আর মেঘলা আকাশ। তবে তাতে আনন্দের কোন ভাটা নেই আর টেমসের জলেও হিল্লোলিত হচ্ছিল আনন্দের মৃদু সমীরন। সব কিছু মিলে একটি উৎসব মূখর পরিবেশে বৃটিশ জনগন দিনটিকে উপভোগ করতে পেরে খুবই উচ্ছ্বসিত। এই রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে জনগন পেয়েছে একটি বাড়তি দিনের ছুটিও। দীর্ঘ প্রতিক্ষীত সত্তর বয়সী রাজা তৃতীয় চার্লসের এই রাজ্যাভিষেকটি স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় শুরু হয় এক গুরু গম্ভীর পরিবেশে হাজারো আমন্ত্রিত বিশেষ অতিথিবৃন্দের উপস্থিতিতে। সরাসরি দেখানো হয় বিশ্ববাসীকে টেলিভিশনের আর তথ্যপ্রযুক্তির সুবাদে। সারা পৃথিবী সাক্ষী হলো এই বিশেষ অনুষ্ঠানটির। বাকিংহাম প্যালেস থেকে যাত্রাশুরু করে সামনের সোজা রাস্তাটি অতিক্রম করে ডায়মন্ড জুবিলিতে ব্যাবহৃত গোল্ড স্টেট কোচের আরোহী হয়ে, অ্যাডমিরালটি আর্চ এবং ট্রাফালগার স্কোয়ার হয়ে, হোয়াইটহলের নিচে এবং পার্লামেন্ট স্ট্রিট ধরে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে এসে শেষ হয় ১.৩ মাইলের রুটটি। দ্বিতীয় রানী এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের সময় পাঁচ মাইলের রুট ব্যাবহৃত হয়েছিলো। রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের পর, রাজা এবং রানী আবার বাকিংহাম প্রাসাদে ফিরে আসেন। অগনিত জনগন অপেক্ষা করছিলো প্রাসাদের সামনে।

 

এই রাজ্যাভিষেকে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনিই প্রথম কোন বাংলাদেশী প্রধানমন্ত্রী বৃটিশ রাজপরিবারের রাজ্যাভিষেকে যোগ দিয়েছেন। এই উপলক্ষে শেখ হাসিনার এবারের লন্ডন সফর বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সুদৃঢ় সম্পর্কের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব জোরদারে তাদের পারস্পরিক আগ্রহের প্রতিফলন ঘটাবে তাতে সন্দেহ নেই। এই সফরটি প্রধানমন্ত্রীর জন্য কমনওয়েলথ নেতাদের সাথে যুক্ত হওয়ার এবং অভিন্ন স্বার্থের বিষয়ে মত বিনিময়েরও একটি সুবর্ন সুযোগ। বৃটিশ রাজপরিবারের সাথে বিলেতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সুসম্পর্ক দীর্ঘদিনের আর বাঙালী সংস্কৃতির সাথে রাজ পরিবারের যেন নাড়ীর সম্পর্ক কয়েক শতাব্দীর। রাজা রামমোহন রায়ই প্রথম বাঙালী ১৮৩১ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর উইলিয়াম ৪-এর রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে যোগদান করারও সুযোগ পান। তারপর থেকে আরো সাতটি রাজ্যাভিষক হয়ে গেলেো রানী ভিক্টোরিয়ার রাজ্যাভিষেকের সময় থেকে (১৮৩৭)। পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে সময়ের বিবর্তনে। বদলেছে জীবন, দর্শন, সামাজিকতা এবং সামনে এগিয়ে চলার মাধ্যম। এই প্রথম রাজ্যাভিষেকটি হলো বিশ্বায়ন আর তথ্য প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের সময় যখন সারা বিশ্ব এক ভয়াবহ উন্মাদনায় পর্যবসিত। আর এই কারনেই এই রাজ্যাভিষকটি টেমসের তীরের নগর কাব্যে সংযোজিত করবে এক নতুন মাত্রা।

 

এই একবিংশ শতাব্দীর এক মহা দুর্যোগের সময় যখন বিশ্বের কোটি কোটি উদ্বাস্তু বাস্তুহারা, যুদ্ধের ভয়ানক আঘাতে বিধ্বস্থ ইউক্রেইন সহ পৃথিবীর নানা প্রান্ত, অর্থনৈতিক মন্দা আর মূল্য স্ফীতিতে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাধারন বিশ্ববাসী, গনতন্ত্র কামী মানুষেরা যখন সকল রাজনৈতিক তন্ত্রের বিরুদ্ধে মাথাচারা দিয়ে উঠছে তখন বৃটেনে এই রাজপরিবারের রাজ্যাভিষেক নিয়ে অনেকেই ভালো বোধ করছেন না। অনুমান করা হচ্ছে ৭০ থেকে ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ হয়েছে। যদিও সঠিক তথ্যটি এখনো প্রকাশিত হয়নি। আমরা সকলেই জানি প্রায় কয়েক শতাব্দী ধরে, রাজারা ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণের প্রতীক। তারাই সরকারের লাগাম ধরেছে জনগনের ভাগ্য নিয়ন্তা এবং সমাজের ইতিহাসের গতিপথ তৈরী করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলিতে, গনতন্ত্র, মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতা আর বিশ্বায়নের প্রভাবে রাজতন্ত্রের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলিতে। ইতিহাসের দিকে একটু তাকালেই দেখতে পাবো ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সাথে শুরু হয়েছিল রাজতন্ত্রের পতন যখন রাজা ষোড়শ লুইকে উৎখাত করা হয়েছিল এবং সৃষ্টি হলো প্রজাতন্ত্রের। এই ঘটনার পর থেকেই  প্রজাতন্ত্রের মতো মতাদর্শের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো তরঙ্গের সূচনা করে সারা ইউরোপের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল, যার ফলে রাজকীয় কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতার ক্ষয়প্রাপ্তি শুরু হয়। এই সময়ের মধ্যে, অনেক জাতি তাদের রাজতন্ত্র পুরোপুরি বিলুপ্ত করে বা রাজতন্ত্রকে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ভূমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। এই প্রবণতা আধুনিক সময়ে অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানের ইউরোপীয় দেশগুলি গণতন্ত্র বা সাংবিধানিক রাজতন্ত্র মুখী যেখানে সরকারগুলি রাজা বা রাণীদের দ্বারা শাসিত না হয়ে নাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত হয়। কিন্তু যতোই আধুনিকতা আর গনতন্ত্রের প্লাবনই আসুক না কেন যুক্তরাজ্যের রাজপরিবার এখনও বহাল তবিয়তে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের সাথে এগিয়ে চলেছে এবং সমাজে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করছে। যদিও তাদের কর্তৃত্ব আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে এবং বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনায় কোন ধরনের ভূমিকা নেই। এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সমস্ত ব্রিটিশ জনগণের মাত্র এক চতুর্থাংশ (২৫%) নিজেদেরকে রাজপরিবারের প্রতি 'খুব অনুগত' বলে মনে করে, যেখানে প্রায় অর্ধেক (৪৭%) জনগন মনে করে যে তারা একেবারেই ' অনুগত নয়'। তবে এটা সত্য রাজা তৃতীয় চার্লস এবং তার বড়ো ছেলে প্রিন্স উইলিয়ামের পক্ষে এখনও শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে সারা বৃটেন জুড়ে।

 

বৃটিশরা যখন ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ থেকে চলে আসে তখন থেকেই বেশিরভাগ ভারতীয় রাজ্যগুলি ব্রিটেন বা আমেরিকার মতো পশ্চিমা গণতন্ত্রের অনুকরণে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গ্রহণ করে। ভারতে রাজতন্ত্রের ইতিহাস দীর্ঘদিনের, যার প্রসারন ঘটেছিলো সভ্যতার শুরু থেকেই, যখন প্রাচীন রাজা ও সম্রাটরা উপমহাদেশের বিশাল অংশ শাসন করতো। মুঘল সাম্রাজ্য থেকে ব্রিটিশ রাজ পর্যন্ত, রাজারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করেছে। ভারতে প্রাচীনতম রাজতন্ত্রগুলি সিন্ধু সভ্যতার সাথে যুক্ত যা প্রায় ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। এই সময়কালে, মহেঞ্জো-দারো এবং হরপ্পার মতো শহরগুলি বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতার সাথে সরকার ও বাণিজ্যের উন্নত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে এই আদি রাজ্যগুলিতে মূলত মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থা ছিল যাদের নেতৃত্বে ছিল মহারানী নামক শক্তিশালী পুরোহিত। সময়ের সাথে সাথে, এই প্রাথমিক রাজ্যগুলি মগধ এবং মৌর্য এর মতো বৃহত্তর সাম্রাজ্যে রূপ নিতে শুরু করে। সেই যুগে রাজাদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ছিলো এবং নাগরিকদের জীবনের উপর উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ ছিল। ভারতীয় রাজতন্ত্র ব্যবস্থার উল্লখযোগ্য উদাহরণগুলির মধ্যে একটি হলো মুগল সাম্রাজ্য। ১৮৫৮ সালে ব্রিটেন আনুষ্ঠানিকভাবে মুঘলদের কাছ থেকে ভারতের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এবং ব্রিটিশ রাজ কায়েম করে যা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় পর্যন্ত। এই সময়কালে, রাজারা নির্দিষ্ট কিছু রাজ্যের মধ্যে বিদ্যমান ছিল, যদিও ব্রিটিশ আইন দ্বারা তাদের ক্ষমতা এবং কার্যক্রমকে  উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত করা হয়েছিলো। রাজতন্ত্র একসময় ভারতের মধ্যে জীবনের বিভিন্ন দিকগুলির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, তবে সাম্প্রতিক দশকগুলিতে সমাজ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, যার ফলে শাসনের ঐতিহ্যগত ধরনগুলি থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে দূরে সরে গেছে রাজ ব্যাবস্থা।  এই আধুনিক সময়ের অভাবনীয় সামাজিক এবং জাতীগত বিকাশের কারনে মানুষ বেশী মাত্রায় শিক্ষা, চাকরি, এবং জীবন বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে, আর তাই সম্ভবত আমরা বংশানুক্রমিক ব্যবস্থা থেকে মেধাতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে নেতৃত্বের দিকে সরে যাচ্ছি দিন দিন এবং এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থায় ব্যক্তিদের শুধুমাত্র জন্মগত অধিকারের পরিবর্তে তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে বিচার করা হয়।

 

তবে যে প্রসঙ্গটা এখানে টানার চেষ্টা করছি সেটা হলো বিলেতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভূমিকা নিয়ে যা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। নানাভাবে বাংলাদেশীরা এই সমাজের সর্বস্তরে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। বাঙালী অধ্যুষিত এলাকার মেয়র একজন বাংলাদেশী। অসংখ্য বাংলাদেশী স্থানীয় কাউন্সিলর সারা বৃটেন জুড়ে। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের প্রথম বাংলাদেশি নারী স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন, লেবার পার্টির প্রতিনিধিত্বকারী চার ব্রিটিশ-বাংলাদেশি নারী সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন, প্রায় ৮০০০ বেশী বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্ট যা প্রতিবছর বৃটেনের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রায় চার বিলিয়ন পাউন্ডের অবদান রাখছে। শুধু কি তাই? সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বংলাদেশীরা এখন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করছে এবং এই প্রজন্মের বিলেতের বংলাদেশীরা শিক্ষায়-দীক্ষায় অনেক এগিয়ে আছে। সার্বিকভাবে বিলেতে বাংলাদেশীরা গত ৬-৭ দশকের মধ্যে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের তিলক বৃটিশ সমাজে পড়াতে পেরেছে। আজ তাই আমরা যখন দেখি বৃটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেকে বংলাদেশী প্রতিনিধিরাও আমন্ত্রিত হন এবং কমিউনিটিকে সংপৃক্ত করার জন্য চলে যথার্থ প্রয়াস তাতে আমরা সকলেই গর্বিত হই। রাজ্যাভিষেকের কয়েকদিন আগেও  রাজা চার্লসকে নগরীর বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের প্রাণকেন্দ্র লন্ডনের ব্রিক লেন পরিদর্শনে হাজারেরও বেশি মানুষের ভিড় স্বাগত জানায়। রাজা- রানীকে বাংলাদেশীরা সাদরে গ্রহন করেন ফুল আর ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে, রাজা-রানীও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে করমর্দন করেছিলেন অতি আগ্রহের সাথে। ব্রিক লেনের একমাত্র মসজিদটি পরিদর্শন করেন এবং ১৯৭৮ সালে বর্ণবাদী হামলায় নিহত বাংলাদেশি ব্যক্তি আলতাব আলীর স্মরণে একটি গাছ রোপণ করেন।  কিং চার্লস গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ সফর করার কথা ছিল কিন্তু রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর কারণে সফর বাতিল করেন। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথও ১৪ই নভেম্বর, ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। এর আগে, ১৯৬১ সালে, তিনি ঢাকায় আসেন, যা তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ছিল। ব্রিক লেইন সফরে রাজা-রানী বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং কুশল বিনিময় করেন।

 

ব্রিটিশ রাজকীয় রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানি একটি শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য। ইতিহাস জুড়ে, অনুষ্ঠানটি আড়ম্বরপূর্ন পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই দিনটি রাজতন্ত্র এবং এর জনগণ উভয়ের জন্য একটি বিশেষ দিন হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মুকুট দেওয়ার অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে গ্র্যান্ড ফিস্ট পর্যন্ত, প্রথম রাজ্যাভিষেকটি অনুষ্ঠিত হয় ১০৬৬ সালে এবং সেই থেকে এটি ব্রিটিশ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখা হয়। বৃটিশ রাজ পরিবারের প্রথম রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানটি ৬ই জানুয়ারী, ১০৬৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়, যখন উইলিয়াম দ্য কনকাররকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে রাজার মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তারপর থেকে, তিনজন ব্রিটিশ রাজা ছাড়া বাকি সবাইকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে বা সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে মুকুট পরানো হয়েছে। তবে যে দুই রাজার কোনো রাজ্যাভিষেক হয়নি তারা হলেন এডওয়ার্ড পঞ্চম (বালক রাজা), যাকে মুকুট পরানোর আগেই লন্ডন টাওয়ারে হত্যা করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়, এবং এডওয়ার্ড অষ্টম যিনি তার পিতার উত্তরাধিকারী হওয়ার ১১ মাস পরে রাজ্যভার থেকে পদত্যাগ করেন। তার পরিত্যক্ত রাজ্যাভিষেকটি ১২ মে ১৯৩৭ তারিখে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ১২ শতকে রাজ্যাভিষেকের সময় প্রথাগত নিয়মে অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়। হেনরি প্রথম তার পিতার স্যাক্সন আচারটিকে নরম্যান আচরিক নিয়মে প্রতিস্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীতে হেনরি দ্বিতীয় তার নিজের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের সময় পবিত্র তেল দিয়ে অভিষেক প্রবর্তন করে এটিকে আবার পরিবর্তন করেছিলেন। ১২২০ সালে, রাজা জন ঘোষণা করেছিলেন যে সমস্ত ভবিষ্যতের রাজাদের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে মুকুট দেওয়া হবে। ১৬৬০ সালে, অলিভার ক্রোমওয়েলের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় চার্লস রাজা হন এবং রাজকীয় রাজ্যাভিষেকের আরও আধুনিক শৈলী প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৮২১ সাল পর্যন্ত প্রথা হয়ে ওঠে। চতুর্থ জর্জ তার নিজের রুচির সাথে মানানসই করার জন্য রাজ্যাভিষেকটিকে আরও সামঞ্জস্য করেন। তার পরে, শুধুমাত্র ছোটখাটো পরিবর্তন করা হয়েছিল, যেমন ১৮৩৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়ার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে হ্যান্ডেলের মেসিয়া থেকে সঙ্গীত যোগ করা, বা রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তার ১৯৫৩ সালের মুকুট অনুষ্ঠানে কমনওয়েলথ প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত।

 

আজকের রাজকীয় রাজ্যাভিষেকগুলি এখনও শতাব্দী আগে অনুষ্ঠিত হওয়া আচারগুলির মতোই উল্লেখযোগ্য। সবচেয়ে স্পষ্ট পার্থক্য হল যে আজকের পরিষেবাটি ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে বা সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালের মধ্যে শুধুমাত্র নির্বাচিত কয়েকজন আমন্ত্রিত অতিথির পরিবর্তে সারা বিশ্ব থেকে আগত শতো শতো বিশিষ্ট অথিতীবৃন্দের উপস্থিতিতে জমকালো পদ্ধতিতে আয়োজন করা হয়। ভাবগম্ভীর ধর্মীয় স্তব গাওয়া হয় পাদরিদের দ্বারা। আর্চবিশপ তারপরে মঞ্চে অভিষেক এবং মুকুট দেওয়ার আচার-অনুষ্ঠানের সাথে এগিয়ে যাওয়ার আগে ধর্মগ্রন্থ থেকে বিশেষ অনুচ্ছেদগুলি পড়বেন। সাধারণত রাজার মাথায় পবিত্র তেল ঢেলে দেওয়া হয়। মূল অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর শুরু হয় অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলি। যেমন লন্ডনের রাস্তায় একটি জমকলো মিছিলে অংশ নেওয়া, সরকারের সিনিয়র সদস্যদের এবং অভিজাতদের সাথে আয়োজিত একটি ভোজসভায় যোগ দেওয়া ইত্যাদি। সামগ্রিকভাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই যে ব্রিটেনের রাজকীয় রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান শুধুমাত্র রাজতন্ত্রই নয়, এর নাগরিকদের জন্যও বিশাল ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে। সারা বিশ্ব থেকে যখন সময়ের সাথে সাথে রাজতন্ত্র বা রাজ পরিবারের দাপট্যের ভাটা পড়ছে সেখানে এই একবিংশ শতাব্দীর অভূতপূর্ব সামাজিক নবজাগরনের যুগেও বৃটিশ রাজতন্ত্র এখনো বহাল তবিয়তে সকলের কাছেই সমাদৃত। তবে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে মুকুট পরার পর থেকে একটি নতুন যুগের এবং একটি নতুন রাজতন্ত্রের সূচনা হয়েছে। কারণ তিনি ছিলেন টেলিভিশনের যুগের প্রথম রানী যার রাজ্যাভিষেক সারা বিশ্বে সম্প্রচারিত হয়েছিল। রাজা ষষ্ঠ জর্জ ৬ইফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে স্যান্ড্রিংহাম হাউসে মারা যাওয়ার পর তার কন্যা, প্রিন্সেস এলিজাবেথ  সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ হন। সেই থেকে, মহামান্য ব্রিটেনের দীর্ঘতম রাজত্বকারী রাজাদের একজন হয়ে উঠেছেন। ৭০ বছর ২১৪ দিন সিংহাসনে থাকার পর ২০২২ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ পরলোক গমন করে দীর্ঘ প্রতিক্ষীত তার বড় ছেলে ৭৪ বয়সী রাজা তৃতীয় চার্লসকে সিংহাসনে আরোহন করে বৃটিশ রাজতন্ত্রের রাজা হওয়ার সুযোগটি করে দিলেন।

 

এক নতুন রাজার রাজ্যাভিষেক সবসময়ই একটি উচ্ছ্বাসপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ। তবে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকটি ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ন ছিল। ১৯৫২ সালের দ্বিতীয় রানী এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশীয় পটভূমি থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের এই ঐতিহাসিক দিনটকে উদযাপন এবং স্বচক্ষে উপভোগ করার জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। অনেক ব্রিটিশ বাংলাদেশির জন্য সেই দিনের রাজ্যাভিষেকটি তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উদযাপন করার সুযোগ দিয়েছিলো। রাজ্যাভিষেকের সময় ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের উপস্থিতি একটি শক্তিশালী সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করেছিলো বৈষম্যহীন এবং গনতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থার। তবে বৃটিশ আধুনিকায়নের মূলে ছিলেন রানি এলিজাবেথ নিজেই। তিনি ১৯৫৩ সালের ২রা জুন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ব্রিটেনের বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর জন্য অখন্ডতার প্রতীক হয়ে উঠেন। তার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে তিনি প্রিন্স ফিলিপকে তার রাজকীয় স্বামী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। প্রিন্স ফিলিপ ছিলেন প্রথম নন-ইংলিশ ডিউক অফ এডিনবার্গ। সেই সময় অনকেই প্রিন্স ফিলিপের এই পদবীকে মিশ্র ঐতিহ্যের স্বীকৃতি হিসাবে দেখেছিলেন। ফিলিপের জন্ম গ্রীসে গ্রীক এবং ডেনিশ রাজকীয় পরিবারে। আঠারো মাস বয়সে তার পরিবার দেশ থেকে নির্বাসিত হয়। ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যে শিক্ষিত হওয়ার পর, তিনি ১৯৩৯ সালে রয়্যাল নেভিতে যোগ দেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর।

 

দ্বিতীয় এলিজাবেথের সেই ঐতিহাসিক রাজ্যাভিষেকের ঘটনাকে স্মরণ করার জন্য, ব্রিটেনের বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের লোকজন অভিষেকের দিনে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে পতাকা নেড়ে এবং আতশবাজি দিয়ে রাতের আকাশে আলোকিত করার জন্য একত্রিত হয়েছিলো। এটা শুধু বাংলাদেশের (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্থান) মানুষ নয়, ভারতীয় এবং পাকিস্তানিরাও এই উত্সবে যোগ দিয়ে ব্রিটেন জুড়ে বৃহত্তর জাতিগত সম্প্রীতির অগ্রগতির জন্য তাদের সমর্থন প্রদর্শন করেছিল। সেইদিন দক্ষিন এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম জনসংখ্যার আবাসস্থল ম্যানচেস্টারের রাস্তায় মিছিলে ছিল হাজার হাজার জনতা, তন্ময় হয়ে দেখেছিল যখন পৌরাণিক কাহিনীর দৃশ্যের মতো চিত্রিত ফ্লোটগুলি ব্রিটেনের বহু-সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম, হিন্দুধর্ম, শিখ ধর্ম এবং ইসলাম সহ বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিরা শহর জুড়ে প্যারেড করেছিল। সেই দিনের সেই রাজ্যাভিষেকটি ছিলো ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের জন্য ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে। একই সাথে সমাজের সাথে সংহতি প্রকাশ করার পাশাপাশি সাংস্কৃতিকভাবে নিজেদেরকে অমলীন ভাবে প্রকাশ করার একটি সুবর্ন সুযোগ। সামগ্রিকভাবে, রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের দিনটি উদযাপন ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের জন্য ছিলো একটি অর্থবহ দিন কারন এই দিনটিই ছিলো নিজেকে তুলে ধরার উত্তম মুহুর্ত এবং প্রদর্শন করার যে তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাপকভাবে এখানে আসার পর থেকে ঠিক কতদূর সামাজিক-রাজনৈতীক এবং অর্থনৈতিকভাবে এগুতে পেরেছিল।

 

২রা জুন, ১৯৫৩-এ, লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এই ইভেন্টটি ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করে এবং বিশ্বের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। রাজ্যাভিষেকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ভারতের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালিও। রাজ্যাভিষেকে অংশগ্রহণকারী সবচেয়ে বিশিষ্ট বাঙালিদের মধ্যে একজন ছিলেন ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, যিনি ১৯৫০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণে, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে বাংলার বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় নাগরিকও উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখার্জি (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য), স্যার সুবোধ চন্দ্র মল্লিক (পশ্চিমবঙ্গের শিল্পমন্ত্রী) এবং শ্রী বীরেন্দ্র চন্দ্র সেন (ভূমি মালিক)। এই ছাড়াও, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও ছিলেন; শিল্পপতি যেমন গোকুলচন্দ্র নন্দী; গুরু শ্রী হর্ষানন্দ মহারাজের মতো ধর্মীয় নেতা; কালিদাস নাগের মতো সমাজ সংস্কারক; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কবি; অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো শিল্পী; ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের মতো সঙ্গীতজ্ঞ; আইনজীবী যেমন শরৎ চন্দ্র সিনহা; স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী সহ বেসামরিক কর্মচারীরা; জামসেটজি টাটার মতো সমাজসেবীরা। সেই প্রথম রাজা রামমোহন রায়ের বৃটিশ রাজার রাজ্যাভিষেকে অংশগ্রহনের পর থেকে ২০২৩ সালের ৬ই মে অনুষ্ঠিত রাজা চার্লসের রাজ্যাভিষেকে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি ছিলো বাংলা এবং বাঙালীর আত্মপরিচয়কে তুলে ধরার এক মাহেন্দ্রক্ষন। এই সময়কালে কতো না জল গড়ালো টেমসের বুকে আর নানা ভাবে সমৃদ্ধ হলো বিলেত প্রবাসী বাঙালীদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতীক এবং সংস্কৃতিক ঐতিহ্যে।

Leave your review