টেমসের তীরের নগর কাব্য বিলেতে বাঙালীর লোকায়ত সংস্কৃতি

সংস্কৃতির মোড়কেই যেন আচ্ছাদিত বাঙালীর অবয়ব, শরীর, চলন-বলন, কথা-বার্তা আর চিন্তা-চেতনা। কিন্তু নগর কাব্যের সব গল্পই যেন একই সমীকরনে চলে না। কোথাও আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের ছান্দিক বৈচিত্রতার বিস্ময়, কোথাও আবার বেদনার কোষে কোষে শূন্যতার হাহাকার। আর তাইতো জীবনের চঞ্চলতা এগিয়ে চলার। ইতিহাসের পাতা থেকে আমরা জেনেছি বাঙালীর শৌর্য-বীর্যের প্রত্যয়ী দ্রোহের গল্প, দেখেছি মা-মাটি মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রামি বহ্নি শিখা আর গীরি শৃঙ্গের মতো উদ্ধত দর্পিত শীর। আবার সময়ের বিবর্তনে বিশ্বায়ন আর তথ্য-প্রযুক্তির নগ্ন থাবায় এবং ভোগবাদী পূঁজিবাদের অপ্রতিরোধ্য প্রভাবে এই মানুষগুলোই ভূলে যায় আমাদের আত্মপরিচয়ের নান্দনিক মূল্যবোধগুলিকে। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় আমাদের অতীত। আমাদের আশারা ভবিতব্যের অজানা স্বপ্নের বলাকা হয়ে ভেসে বেড়ায় দূরাকাশে। কিন্তু তার মাঝেও কেউ কেউ অদম্য ইচ্ছায় দ্বীপ্ততায় হেঁটে চলে সুন্দর রুপালী কোন এক প্রত্যুষের আশায়। আর এদের জন্যই নগর কাব্যের গল্পগুলি কিংবা ছোট ছোট অনুভূতিগুলি হয়ে উঠে বড়োই মধুময়, প্রাঞ্জল। আজকের নগর কাব্যে বিলেতে বাঙালীর লোকায়ত সংস্কৃতিকে নিয়েই কিছু চর্বিত-চর্বন করার প্রয়াস রাখছি।

 

লোকায়ত সংস্কৃতি আমাদের আষ্টে-পৃষ্ঠে সংপৃক্ত, আমাদের আত্মা এবং উদ্যম সন্জীবনী, যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় জীবনের উচ্ছ্বাস আর  পরম আদরের অনুভূতিগুলিকে, যা আমাদেরকে শিক্ষা দেয় নৈতিকতার মন্ত্র। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিশ্বের মানুষেরা নীতিবিদ্যা আর নান্দনিক অনুভূতির স্মৃতিগুলিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে ভোগবাদী আর প্রাপ্তির নেশায়। প্রবাসী বংলাদেশীরা বরং এই চলার পথে সবচেয়ে বেশী সক্রিয়। কারন লন্ডন যে পুঁজিবাদের জঠরে বেড়ে উঠা ভোগবাদী দর্শনের রাজধানী। এখানেই হাত বাড়ালেই সব মেলে। উত্তর-দক্ষিন-পূর্ব -পশ্চিম যেদিকেই চোখ যায় শুধু বিলাসীতার সৌন্দর্য আর বিচিত্র সামিয়ানার ঢেউ লক্ষনীয়। এই প্রাপ্তির সৌন্দর্যের বৃত্তায়নে পথ চলায় কখনো কখনো মনে হয় এক গভীর আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছি আমরা। বিলেতে থেকেও পারিনি পুরোপুরি বিলেতী আদব-কায়দায় সংপৃক্ত হতে, অন্যদিকে ধীরে ধীরে অপসৃয়মানের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের চিন্তায়-চেতনায়-ভাবনায় লালিত-পালিত বহু চেনা-জানা সংস্কৃতি। বিলেতের লন্ডন ৬০-৭০ বছরের ব্যাবধানে হয়ে উঠেছে বাংলাদেশীদের মিলন কেন্দ্র। বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনের বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো লোকায়ত সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, এই প্রাণবন্ত এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে এসেছে, যার ফলশ্রুতিতে ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সংস্কৃতির অনেক দিক আজও ইংল্যান্ডের এই অংশে জীবিত ও ভালোভাবে মানুষের জীবনের সাথে গ্রথিত হয়ে আছে। শুধুমাত্র কিছু উদ্যমী সুন্দরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ মনুষের সামাজিক দায়বদ্ধতার তাগিদে তা সম্ভব হয়েছে। যারা অসুন্দরের কদর্যকে অস্বীকার করে বুকে আলিঙ্গন করেছে সুন্দরের প্রতিমাকে, ধারন করছে এই বিশ্বাস এইতো সময় পৃথিবীর জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, আমাদের সমাজের জন্য কিছু করার। তাই সমাজকে মানবায়িত করার জন্য, নৈতিকতার মূল্যবোধকে উৎসাহিত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে লোক সংস্কৃতিকে করেছেন সুন্দরের পথে চলার এবং জীবনকে মানবায়িত করার হাতিয়ার। নানা মাধ্যমে লোকায়ত সংস্কৃতির মূল বানীকে সমাজের কাছে পৌঁছানোর এক দৃঢ় অঙ্গীকার যেন বুকে ধারন করেছেন। তাদের কঠোর পরিশ্রমের কারনেই এই লোকায়ত সংস্কৃতির সমৃদ্ধ সঙ্গীত, নৃত্য এবং রন্ধনপ্রণালী থেকে শুরু করে এর বৈচিত্রময় ভাষা ও সাহিত্য, লোককাহিনী পূর্ব লন্ডনের বাঙালি পাড়া সহ বিলেতে বসবাসকারীদের জীবনকে এক নতুন রূপ দিতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে।

 

পূর্ব লন্ডনের বাংলা লোককাহিনীর উত্স মূলতঃ বেশিরভাগ অভিবাসীদের অনুপ্রবেশের কারনেই ঘটেছে যারা ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই অঞ্চলে চলে এসেছিল উন্নত জীবনের আশায়। বেঁধেছিলো স্বপ্নের আস্তানা। সেই সময়ে, বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) বিপুল সংখ্যক মানুষেরা তাদের জন্মভূমিতে দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের কারণে ব্রিটেনের শিল্প শহর লন্ডনে চাকরির জন্য পাড়ি জমায়। এই নতুন পরিস্থিতে এসেও নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও  তারা নিজের অতীতকে ভূলে যায় নি। নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতিকে ভূলে যায়নি। মা-বাবা কিংবা দাদা-দিদি বা বয়োজৈষ্ঠদের কাছ থেকে শুনা নানা কল্প-কাহিনীকে এখনো বুকে ধারন করে এগিয়ে চলেছে অনেকেই। তাদের সাথে নিয়ে আসা অনেক রীতিনীতি যা সময়ের সাথে সাথে ব্রিটিশ-বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠে। তার একটি অনন্য উদাহরণ হল সঙ্গীত এবং ভাষা। বৈদ্যুতিক গিটার বা ইলেকট্রনিক কীবোর্ডের মতো আধুনিক পাশ্চাত্য যন্ত্রের সাথে মিশ্রিত শাস্ত্রীয় ভারতীয় ছন্দের অনন্য সমন্বয়ে বাউল নামে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী লোকগীতিগুলি পূর্ব লন্ডন জুড়ে বাঙালি এবং অবাঙালিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এমনকি আজও, স্থানীয় শিল্পীরা প্রায়শই পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশী এলাকা জুড়ে বিবাহ বা অন্যান্য বিশেষ অনুষ্ঠানে এই নিরবধি সুর পরিবেশন করে চলেছে। তাছাড়া ভাষা পূর্ব লন্ডনের বাঙালিদের মধ্যে লোকসাহিত্যের সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য অংশ হিসাবে রয়ে গেছে,। পূর্ব লন্ডনের বাঙালিদের মধ্যে লোককাহিনী সংস্কৃতির বেশ দৃঢ় সংপৃক্ততা এখনো দৃশ্যতঃ এবং বেশ শক্তিশালীই বলে মনে হয়, যা সময়ের সাথে সাথে সামাজিক পরিবর্তন সত্ত্বেও টিকে আছে, সেইসাথে এত বছর আগে এখানে আসার পর থেকে অর্জিত নতুন ধারণা এবং অভিজ্ঞতা দ্বারা সমৃদ্ধও হয়েছে।

 

নতুন প্রজন্ম সহ বাংলাদেশী ও বৃটেনে বসবাসরত নানা সম্প্রদায়কে লোকায়ত সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগের মাত্রাটাকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি বংলাদেশী সংগঠন। এক ঝাঁক শৈল্পিক ভাবনা আর সুস্থ নান্দনিক চেতনায় সমৃদ্ধ তরুন তরুনী এই লোক সংস্কৃতিকে সকলের সামনে বিশেষভাবে তুলে ধরার জন্য যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শুধু লোক সংস্কৃতিকে তুলে ধরাই মূল কাজ নয়, বরং লোকায়ত সংস্কৃতি কিভাবে আমাদেরকে শিক্ষায়, ঘর-গেরস্থলীতে, অফিস-আদালতে, নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নে, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং সামাজিক, অর্থনৈতীক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্য দূর করে একটি মূল্যবোধে সমৃদ্ধ নৈতিকতাপূর্ন সমাজ তৈরী করতে পারে সে প্রায়োগিক দিকেই বরং বেশী জোর দিচ্ছে। আর সেই কারনে এ প্রজন্মর ছেলে মেয়েদের  মধ্যে এই লোকায়ত সংস্কৃতির গ্রহন যোগ্যতা বেশ লক্ষনীয়। এই সংগঠনগুলো বিলেতে লোক-সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ ও প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। স্থানীয় শিল্পীদের মাধ্যমে তাদের কাজ প্রদর্শন করা সহ গান, নাচ এবং গল্প বলার মতো ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের প্রচার এবং প্রসারে দ্বীপ্ত ভূমিকা রাখছে। তবে লোক-সংস্কৃতিকে বিলেত সহ আন্তর্জাতীক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সংগঠন নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিলেতে বাংলাদেশী সম্প্রদায় সহ বৃটেন এবং ইউরোপের নানা জাতী গোষ্ঠীর কাছে প্রাচ্যের লোকসংস্কৃতিকে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য গত তের বছর যাবৎ পালিত হয়ে আসছে রাধা রমন সোসাইটি আয়োজিত লোক উত্সব।

 

রাধা রমন লোক উত্সব হল ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের একটি অনন্য উদযাপন যা যুক্তরাজ্যে ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর সংঘটিত হয়ে আসছে। লোকসংস্কৃতির বৃত্তাবরনে রঙ, সঙ্গীত এবং নৃত্যের প্রাণবন্ত দৃশ্য দেখার জন্য বিশ্বজুড়ে দর্শকদের আকৃষ্ট করে আসছে লোকসংস্কৃতি ভিত্তিক এই বাৎসরিক উৎসবটি। যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো লোকসংগীত ও নৃত্যের মাধ্যমে জীবনের আনন্দ, নান্দনিকতা, চরিত্র গঠনের শিক্ষা, লোকায়ত সামাজিক মূল্যবোধ ও বিশ্ব শান্তিকে প্রচার করা। নানা জাতীর সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরীতে এই রাধা রমন ফোক উৎসবটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। রাধারমণ লোক উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হল এর ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য। ভাংড়া থেকে গরবা পর্যন্ত, এই নৃত্যগুলি পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের দ্বারাই অত্যন্ত উত্সাহের সাথে পরিবেশিত হয়। ঝুমার, কথাকলি এবং ডান্ডিয়া রাসের মুগ্ধতায় উদ্বেলিত হয় উৎসবে আগত সকলের মন। এছাড়াও দিনব্যাপী বিভিন্ন গানের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপগুলি ছাড়াও, অনুষ্ঠানস্থলের চারপাশে বিভিন্ন ধরণের স্যুভেনির বিক্রির স্টল থাকে, যার মধ্যে হস্তনির্মিত গয়না, হিন্দু দেব-দেবীর ছবি এবং অন্যান্য আইটেম থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, রাধা রমন লোক উত্সব ক্রমবর্ধমানভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সঙ্গীত, নৃত্যের মাধ্যমে ভারত থেকে আসা এবং বিলেতের প্রখ্যাত শিল্পীদের সমন্বিত শিল্প প্রদর্শনীর মাধ্যমে উদযাপন করা হয়। রাধারমণ আন্তর্জাতিক নৃত্য উত্সব, বাউল এবং বৈষ্ণব সঙ্গীত উৎসব, গ্রন্থী কবিতা উত্সব, বিশ্ব কবিতা এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উত্সবের মাধ্যমে ভারতীয় লোকয়িত সংস্কৃতিকে শিক্ষা, শান্তি, সম্প্রীতি, নারীর ক্ষমতায়ন সহ প্রাচ্য ও প্রাচ্যাত্যের সাংস্কৃতিক সংপৃক্ততায় রাধারমন সোসাইটি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

 

২০১৬ সালে ইয়র্কশায়ার পোস্ট পত্রিকা রাধা রমনকে এই এলাকার সেরা ১০টি গ্রীষ্মকালীন উত্সবের একটি হিসাবে ঘোষণা করে। রাধারমন সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সাংস্কৃতিক পলিম্যাথ, কবি, গায়ক, কথাসাহিত্যিক, চলচ্চিত্র ও সাহিত্য সমালোচক আহমেদ কায়সার। যদিও প্রারম্ভে বাংলাদেশী এবং ভারতীয় সম্প্রদায়ের কাছে লোক উত্সব হিসাবে শুরু হয়েছিল, কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে এটি একটি আন্তর্জাতিক ফেষ্টিভলে পরিনত হয়েছে। প্রতিবছর আগষ্টে লিডস শহরে অনুষ্ঠিত হয়  বিনামূল্যের এই লোকসংগীত উৎসবটি। লিডসে রাধারমন ফোক ফেস্টিভ্যালটি হলো ঐতিহ্যবাহী লোক সংস্কৃতির উদযাপন। এই উত্সবটি কেবল নৃত্য বা সঙ্গীতই নয়, গল্প, কারুশিল্প এবং সামাজিক রীতিনীতিগুলিও উদযাপন করে। বিশিষ্ট শিল্পী, কলাকৌশলী, যন্ত্রবাদক সহ বিদগ্ধ সুধীজনদের মিলনমেলায় পরিনত হয় এই রাধারমন উৎসবটি। গত বছরগুলির আগত শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন ভজন রাজা অনুপ জালোটা, ভারতীয় তবলা গুণী পিটি কুমার বোস, বাউল গায়ক, পার্বতী দাস বাউল এবং সুপরিচিত কণ্ঠশিল্পী জয়তি চক্রবর্তী এবং বেহালাবাদক বিদুষী কালা রামনাথ। স্কটল্যান্ড থেকে, সুপরিচিত সংগীতশিল্পী এবং ফিউশন আইকন, সাইমন থ্যাকার, ইরানী তাম্বুরা এবং সেতার বাদক নিকনাজ মিরঘলামি, মিশরীয় নৃত্যশিল্পী লিলি নেলোফার, লেবানিজ-কানাডিয়ান সঙ্গীতশিল্পী লারা ইদি, মরক্কোর নাই, ওউদ মায়েস্ট্রো হাসান ইরাজি এবং শুবার্ট কণ্ঠশিল্পী এরিক শেলেন্ডার সহ বিলেতের সুপরিচিত বাংলাদেশী এবং ভারতীয় শিল্পীগন।

 

লন্ডন একটি বৈচিত্র্যময় এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ শহর, যেখানে সারা বিশ্বের মানুষ তাদের সংস্কৃতিকে একে অপরের সাথে বিনিময়ের মাধ্যমে আরো সমৃদ্ধ করে তুলছে। বিশ্বায়ন আর তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ওই সংস্কৃতিক যোগাযোগকে আরো বেগবান করে তুলেছে। লন্ডনে বাঙালী সংস্কৃতির ধারা, প্রভাব এবং বিস্তার এই শহরের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতায় আরো মাত্রা সংযোজন করেছে এবং সমৃদ্ধ হয়েছে এই বৈচিত্র। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী এই শহরে নতুন করে বসতী স্থাপন করছে। বাঙালি সংস্কৃতি বিলেতের সাংস্কৃতিক বলয়ে প্রভাব ফেলেছে জোড়ালোভাবে যা বৃটেনের নিজস্ব রীতিনীতি, রন্ধনপ্রণালী, ভাষা এবং সঙ্গীত সহ নানা ক্ষেত্রে বিশেষ মাত্রা নিয়ে এসেছে। বাংলা অধ্যুষিত এলাকা টাওয়ার হ্যামলেটসের যে কোন রাস্তা দিয়ে হাঁটলেই বা ঘোরাফেরা করলেই এই সংস্কৃতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, খাঁটি বাঙালি খাবার পরিবেশনকারী রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং আনুষাঙ্গিক বিক্রির দোকানে। এমনকি লন্ডনে আসা পর্যটকদের জন্যও এটি একটি জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে যারা একটি ভিন্ন ধরনের সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা লাভ করতে চায় ।  আবেগপ্রবন বাংলাদেশীরা পৃথিবীর যে প্রান্তে যে অবস্থায় থাকুক না কেন এ জাতী কখনো নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভূলে যেতে দেয় না। অতীতের অমলীন গন্ডোলার স্মৃতিকে নিয়েই যেন আমাদের ঘর গেরস্থালী, চিন্তা-চেতনার উদ্যামতায় সামনে এগিয়ে চলা। লোকজ সংস্কৃতির ধারা ধীরে বয়ে চলেছে আমাদের ধমনীতে শিরা উপশিরায়। যদিও মনস্তাত্বিক সাম্রাজ্যবাদ আর ভোগবাদী প্রাপ্যতার এক ভয়ানক ভাইরাস আমাদের অনেককেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অসহ্য সামাজিক পরিনতির দিকে। অপ্রয়োজনীয় চাহিদাই যখন আমাদের বিবেক, বুদ্ধি, নৈতিকতার এবং সততার মূল্যবোধকে গলাটিপে ধরছে ঠিক তখনই উদিয়মান সূর্যের মতো প্রকাশিত হয় এক ঝাঁক তারুন্যের মানবিক প্রয়াস। সমাজকে মানবায়িত করার অঙ্গীকার। সমস্ত বন্যতাকে ছাড়িয়ে বুনতে থাকে সভ্যতার নতুন কুঁড়ি।

 

বিলেতে বাংলাদেশী লোকসংস্কৃতির ধারা ধীরে প্রবাহমান। প্রথম প্রজন্মের বাংলাদেশীদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম থেকে যে বাস্তবিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটেছিলো বিলেতের সামাজিক পরিসরে তা দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের মধ্যদিয়ে রুপ নিয়েছে এক সাফল্যের নগর কাব্যের চিরায়ত গল্পে। বাংলাদেশীসহ অন্যান্য জাতীগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের যে ঐতিহ্যবাহী রীতির প্রচলন করেছিলো বাংলাদেশী কিছু নান্দনিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ, সময়ের ব্যাবধানে তা পেয়েছে এক অবিশ্বাস্য সমৃদ্ধি এবং ঋজুতা। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনেক বাংলাদেশি-ব্রিটেনের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা বাঙালী জাতীর আত্ম-পরিচয়ের গভীরে প্রোথিত। বাংলাদেশী লোকসাহিত্যের সংস্কৃতিতে নাচ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লোকনৃত্য বাউল ঐতিহ্যগত গানগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে যা প্রেম, জীবন এবং আধ্যাত্মিকতার গল্প বলার সাথে সাথে কথাকলির মতো শাস্ত্রীয় ভারতীয় নৃত্য শৈলীর উপাদানগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করে। বিলেতে বাংলাদেশীদের পথ চলায় রাধারমন লোক উৎসবের মতো নানা ধরনের মেলা, সাংস্কৃতিক উৎসব, বুদ্ধিবৃত্তিক দার্শনিক চর্চা  আরো বেগবান হোক, ছড়িয়ে পড়ুক লোকায়ত সংস্কৃতির মূল্যবোধ সমাজের নানাস্তরে। মানুষের চেতনায়, মননে উদ্ভাসিত হোক টেমস তীরের নগর কাব্যের এক অনন্য সাংস্কৃতিক জলসিঁড়ি। বাংলা এবং বাঙালীর আত্মপরিচয়ের অহংকার।

Leave your review