টেমসের তীরের নগর কাব্য - বিলেতে বাংলাদেশী রেস্তোরাঁর বিবর্তন

এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে ভারতীয় রন্ধনপ্রণালী বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। এর জলযুক্ত সুস্বাদু মাছের চরচরি, ডালসুপ এবং নানা ধরনের তরকারি থেকে শুরু করে এর সুগন্ধযুক্ত মশলা পর্যন্ত, ভারতীয় রন্ধনপ্রণালী বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষের হৃদয় এবং স্বাদের কুঁড়ি জয় করেছে। যারা ভারতীয় খাবারের সাথে পরিচিত তারাই জানেন তৃপ্তি দায়ক রসনা বিলাসী খাবারের জন্য ভারতীয় খাবারের মতো আর কিছুই নেই। কিন্তু সেই ভারতীয় খাবারের মধ্যে বাঙালী খাবারের কথা যখন আসে তখন তার বিশেষত্বই একটু অন্যরকম। মাছে-ভাতে বাঙালীর খাবারে থাকে জিহ্বা পাগল করা মসল্লার সাত্বিক প্রয়োগ। বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্য, খাঁটি ভারতীয় খাবার খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল এক সময় যা সত্যিকার অর্থে তাদের বাড়িতে রান্না করা খাবারের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে। পশ্চিমারা যখন বাইরের খাবারে বেশ সাচ্ছন্দবোধ করে ঘরের রান্না বান্নার ঝামেলা থেকে দূরে থাকার জন্য, ঠিক তার উল্টোটাই লক্ষনীয় ভারতীয়দের মধ্যে। ঘরের মায়ের কিংবা বধুর বা অন্য কারোর বানানো খাবারেই অভ্যস্থ খাদ্য রসিক ভারতীয়রা। ভারতীয় রন্ধনপ্রণালী তার অনন্য স্বাদ এবং মশলার জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত। ভারতীয় রান্নায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের মশলা সুস্বাদু এবং সুগন্ধযুক্ত রান্নায় পরিণত করে, যার মধ্যে হালকা, সুগন্ধি স্বাদ থেকে শুরু করে খুব ঝাঁঝালো গাঢ় মশলাদার স্বাদ, যা প্রত্যেকের স্বাদের অনুসারে তৈরী করা যায়। মশলা শুধুমাত্র খাবারের স্বাদকে বৃ্দ্ধি করার একটি উপায় নয়, বরং এগুলি ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ইতিহাসেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বহু রেসিপি শতাব্দী ধরে প্রজন্মের মধ্য দিয়ে চলে এসেছে।  প্রাথমিকভাবে খাদ্য সংরক্ষণের একটি উপায় হিসাবে মসলাগুলিকে তৈরি করা হতো যখন তাজা পণ্য সারা বছর পাওয়া যেত না। বর্তমানে মশলাগুলি সংরক্ষণের গুণাবলীর চেয়ে বরং খাবারের স্বাদের জন্যই বেশি ব্যবহৃত হয়। সাধারণভাবে ব্যবহৃত ভারতীয় মশলাগুলির মধ্যে রয়েছে হলুদ, এলাচ, জিরা, ধনে, আদা, মরিচের গুঁড়া এবং গরম মসলা যা অনন্য স্বাদের সমন্বয় তৈরি করতে সক্ষম। কালের বিবর্তনে এই রন্ধনশীল্প ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠে। ভারতীয় অভিবাসীদের পথচলায় এই রন্ধন সংস্কৃতিও হয়ে উঠে একসময় বিলেতের জাতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। চিকেন টিক্কা মশালা এখন সত্যিকারের ব্রিটিশ জাতীয় খাবারে পরিনত হয়েছে। এটি কেবল একটি সর্বাধিক জনপ্রিয় খাবারই নয় বরং এটি ব্রিটেন যেভাবে বহিবিশ্বের সাংস্কৃতির প্রভাবগুলিকে স্বীয় সংস্কৃতির ধারায় অভিযোজন করছে তারই একটি নিখুঁত চিত্র। এইবারের নগরকাব্যে তুলে ধরবো বিলেতে বাংলাদেশী রেস্তোরাঁর সাফল্য গাঁথা বিবর্তনের গল্প।

 

লন্ডনের বাংলা অধ্যুষিত এলাকা পূর্ব লন্ডন যেন একটা ছোট খাটো বাংলাদেশ যা বাংলা টাউন নামে সবার কাছে পরিচিত। পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলিতে চায়না টাউনের উপস্থিতি লক্ষনীয় কিন্তু বাংলা টাউন সম্ভবত একমাত্র লন্ডনেই দৃশ্যতঃ। বাংলাদেশের নদ-নদী আর জলহাওয়ায় বেড়ে উঠা মানুষগুলোর দৈনন্দিন জীবনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস আর আচরিক ব্যাপারগুলিই যেন কার্যতঃ এই ছোট্ট বাংলা টাউনে দেখা যায়। বাংলাদেশেরই মতো  বেশ চেনা পরিচিত একটা গন্ধ লাগে নাকে, কোলাহল মূখর ব্যাস্ত কোন বাংলা শহরের আওয়াজ ভেসে আসে কানে, বাজে বাংলা সুরের মূর্ছনা। প্রধান সড়ক ব্রিক লেইন, হেনবারী ষ্ট্রীট সহ বিখ্যাত প্রিন্সলেট ষ্ট্রীট, বাকস্টন রোড, কোয়াকার ষ্ট্রীট যেকোন অলি গলি দিয়েই চলতে চলতে মনে হবে বাংলাদেশের কোন শহরের পরিবেশের সান্নিধ্যে আছি। রাস্তার দুপাশের সব দোকানগুলিই বাংলাদেশী মালিকানাধীন। বড় বড় মাছবাজার, ছোট ছোট মুদি আর মনোহারী দোকান, গ্রোসারী, হেয়ার সেলুন, বুক ষ্টল, মিউজিক সপ থেকে শুরু করে মিষ্টির দোকানগুলি দেখলে বাংলাদেশ ছাড়া যে কিছুই ভাবা যায়না। প্রায় ১০০টির ও বেশী রেস্তোরাঁ রয়েছে শুধু এই ব্রিক লেইনে। বাংলাদেশীদের বাংলায় কথাবার্তা আর রাস্তার পাশের কোন মিউজিক সপ বা রেস্তোরাঁ থেকে ভেসে আসা পল্লীগান বা বাংলা গানে মুখরিত থাকে এলাকাটি। কি পাওয়া যায় না এখানে? সারা বছর ধরেই বাংলাদেশের শাকশব্জী থেকে শুরু করে, সিলেট থেকে আসা সাতকড়ি সহ পাটের শাক, হালাল মাছ মাংস সব কিছু মেলে এই বাংলা টাউনে। কেমন করে শুরু হলো বিলেতে বাংলাদেশীদের রন্ধনশীল্পের এক বিশাল সাম্রাজ্য। এখানে একটা তথ্য দিয়ে রাখা সংগত হবে যে বিলেতে বাংলাদেশীদের প্রায় নব্বই শতাংশের উপরেই বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের।

 

গল্পটি শুরু হয়েছিল ১৮১০ সালে। যদিও অনেকের ধারনা যে লন্ডনের বা বিলেতের ভারতীয় রেস্তোরাঁগুলি ১৯৬০ এবং ৭০ এর দশকে বাংলাদেশী অভিবাসীদের দ্বারা স্থাপন করা হয়েছিল,তবে প্রকৃতপক্ষে, ব্রিটেনে প্রথম কারি হাউস বা ভারতীয় রেষ্টুরেন্টের দরজা উন্মোচন করা হয় প্রায় ২১৩ বছের আগে। শেখ দীন মোহাম্মদ সেন্ট্রাল লন্ডনের পোর্টম্যান স্কোয়ারের কাছে জর্জ স্ট্রিটে প্রথম কারি হাউস প্রতিষ্ঠা করেন। দীন মোহাম্মদ ছিলেন একজন প্রথিতযশা সার্জন, বাঙালী ভ্রমনকারী, উদ্যোক্তা এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ইংরেজিতে বই প্রকাশ করেছিলেন। যদিও অনেক রেস্তোরাঁতে ভারতীয় খাবার পরিবেশন করা হতো কিন্তু দীন মোহাম্মদের কারি হাউসটিই প্রথম ভারতীয় বাঙালী মালিকানাধীন প্রথম রেস্তোরা। সেজল সুখাদওয়ালা রচিত” লন্ডনের প্রথম ভারতীয় রেস্তোরাঁর গল্প” প্রবন্ধ থেকে জানা যায় ১৭৫৯ সালে ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অংশভুক্ত বিহার রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন শেখ দীন মোহাম্মদ। বিলেতে তিনিই রেস্তোরাঁয় বাংলাদেশী খাবারের প্রচলন করেন। এই কফি হাউসটি ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনকারী ব্রিটিশ রাজন্যবর্গদের মধ্যে মশলার লোভ মেটাবে, এই আশা করেই তিনি এইটি প্রতিষ্ঠা করেন। একটি খাঁটি ভারতীয় খাবারের শেষে অতিরিক্ত স্বাদ এবং তৃপ্তির জন্য হুক্কাও চালু করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যবসাটি দীর্ঘদিন টিকে থাকেনি। মাত্র দুই বছরের ব্যাবধানে ১৮১২ সালে  রেস্তোরাঁটি বন্ধ হয়ে যায় যখন ডিন মোহাম্মদ নিজকে দেউলিয়া ঘোষনা করেন।  তার পর ১৯ শতকের শেষের দিকে শুরু হয়েছিল ভারতীয় রন্ধনশীল্পের সত্যিকারের অগ্রযাত্রা যখন একদল পাঞ্জাবি এবং বাঙালি অভিবাসী লন্ডনে এসে প্রথম ভোজনশালা খোলেন যেখানে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় খাবার যেমন তরকারি, ঝাল, পরাঠা এবং পাকোড়া পরিবেশন করা হতো। ভোজনশালায় পরিবেশিত খাবারটি এতই সুস্বাদু এবং  জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে  প্রতিদিন অনেকেই এই খাবারের জন্য ভীড় করতে থাকন। বৃটিশ ভোজন রসিকদের ভারতীয় খাবারের প্রতি চরম আগ্রহ দেখে ১৯২৬ সালে বীরস্বামী নামে আরেকটি ভারতীয় রেস্তোরাঁ ৯৯-১০১ রিজেন্ট স্ট্রিটে খোলা হয় এবং এটিই এখন পর্যন্ত বিলেতে সবচেয়ে পুরনো ভারতীয় রেস্তোরাঁ হিসেবে পরিচিত। এর মালিক এডওয়ার্ড পামার, একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। তার সাথে যোগ দেন একজন ভারতীয় মোঘল বংশীয় রাজকুমারী এবং আরেকজন ইংরেজ জেনারেলের নাতি। প্রাথমিক বছরগুলিতে, বীরস্বামী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান খাবার পরিবেশন করতো, কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলিতে, যুক্তরাজ্যে খাঁটি ভারতীয় খাবারের জনপ্রিয়তার উপর ভিত্তি করে, পাঞ্জাব, লখনউ, কাশ্মীর সহ আঞ্চলিক ভারতীয় নানা স্বাদের খাবার পরিবেশন করছে এবং গুনগত খাবারের জন্য এই রেস্তোরাঁটির বিলেত জুড়ে বেশ সুনাম রয়েছে। শুরু থেকেই বীরস্বামীতে এডওয়ার্ড পামার সিলেটি শেফদেরকে নিয়োগ দেন। সিলেট ছিল মগ বা মগ রাঁধুনিদের আবাসস্থল, যারা রাজবাড় বা জমিদারদের জন্য রান্না করত। ব্রিটিশরা চাটনি বিশেষভাবে পছন্দ করত। সিলেটী শেইফরা উত্তরের খাবারের সাথে দক্ষিণ ভারতীয় নারকেল চাটনি যোগ করে নতুন স্বাদের খাবার তৈরীতে বেশ পারদর্শী ছিলেন এবং সেই মিশ্রিত খাবার বৃটিশরা বেশ পছন্দ করতো।

 

তবে ব্রিটিশ বাংলা রেস্তোরাঁর পিছনের সাফল্যের গল্পটি শুরু হয় প্রায় ৭০ বছর আগে কোহিনুরের শুভ সূচনার মাধ্যমে এবং সেই থেকে সময়ের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। এই প্রাণবন্ত রন্ধনপ্রণালী বহুদূর এসেছে বিলেতের মাটিতে যা এখন জাতীয় সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দূর্দান্ত সাফল্য এটাই– প্রমাণ করে যে ভালো খাবারের কোন সীমা নেই রেখা নেই। কোহিনুর ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁটি ১৯৪৩ সালে ৭৪ মিল রোডে খোলা হয়েছিল এবং এটি কেমব্রিজে বাংলাদেশী মালিকানাধীন প্রথম রেস্টুরেন্ট। কৃষ্ণবীর বাহাদুর এবং তার দুই ভাই এ রেস্তোরাঁটি খোলেন। কৃষ্ণবীর সিলেটের সুনামগন্জের বাসিন্দা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে কৃষ্ণবীর ১৯৪০ সালে বিলেতে পাড়ি দেন। এখানে এসেই বুঝতে পারলেন ভারতীয় শিক্ষার্থী সহ অনেকে ভারতীয়দের জন্য বড়ো সমস্যা হলো নিয়ম মাফিক দেশীয় খাবার থেকে বঞ্চিত থাকা।  শেষ পর্যন্ত তার প্রয়াসে সৃষ্ট হলো কেমব্রিজে কোহিনুর রেষ্টুরেন্ট। ভারতীয় সুস্বাদু খাবারের জনপ্রিয়তা ইংরেজদের কাছেও বাড়তে লাগলো। পরবর্তীতে কৃষ্ণবীর একই নামে আরো দুটি রেষ্টুরেন্ট লন্ডন এবং ম্যানচেষ্টারে খোলেন।

 

সে থেকে ধীরে ধীরে শুরু হলো বিলেতে বাংলাদেশীদের রেস্তোরাঁর ব্যাবসায়িক সাফল্য। ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত এই নতুন রেস্তোরাঁ সম্পর্কে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটেন জুড়ে খাঁটি ভারতীয় খাবারের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে একের পর এক রেস্তোরাঁগুলি আবির্ভাব হতে শুরু করে। আজ অনেক বাংলাদেশী সম্প্রদায় এখন ব্রিটেনের কারি শিল্পের সাথে যুক্ত। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন রেস্তোঁরাগুলির সংখ্যা প্রায় ৯৫০০ এরও বেশী। নানা সূত্রমতে জানা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় ছোট বড়ো মিলিয়ে ২০টির মতো রেস্তোরাঁ বংলাদেশী মালিকানাধীন ছিলো, যা ৬০এর দশে এসে দাঁড়ায় প্রায় তিন শতাধিক। দুই দশকের ব্যাবধানে এসে ১৯৮০ সালে বাংলাদেশী মলিকানাীন রেস্তোরার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০০০ এরও বেশী। পরবর্তী দশকগুলিতে, আরও বাংলাদেশী মালিকানাধীন রেস্তোরাঁগুলি সমগ্র ব্রিটেন জুড়ে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যেখানে রোগান জোশ, কোর্মা এর মতো ক্লাসিক খাবারের ঐতিহ্যগত এবং আধুনিক সংস্করণ পরিবেশন করা হতো। ১৯৯১ সালের পর যখন অভিবাসন আইন শিথিল করা হয়, তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক লোককে বৈধভাবে কাজের সুযোগ খুঁজতে ইংল্যান্ডে প্রবেশের অনুমতি দেয়।  সেই সময়ে অন্যান্য ব্যবসায়িক উদ্যোগের তুলনায় কম আর্থিক ঝুঁকির কারণে অনেকেই তাদের পছন্দের পথ হিসাবে তাদের নিজস্ব খাবারের দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজকাল বৃটেনের প্রধান শহরগুলির বাংলা অধ্যুষিত এলাকায় বাংলাদেশী ষ্টাইল এবং নামের অসংখ্য রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছে।

 

যুক্তরাজ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ ভারতীয় রেস্তোরাঁ বাংলাদেশীদের দ্বারা পরিচালিত এবং মালিকানাধীন। ১৯৪০ দশকের পর থেকে সব বাংলাদেশী রেস্তোরা ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ হিসেবে পরিচালিত হতো। ইদানীং অনেক বাংলাদেশী মালিকানাধীন রেস্তোরাঁই বাংলাদেশী নামেই চলছে। গ্রাম বাংলার মন কাড়ানো নানা নামের রেস্তোরাঁগুলি যেন বাংলার আসল রন্ধনশৈলীকে বৈচিত্রতার পরশ মাখিয়ে মানুষের রসনা বিলাসকে পরম তৃপ্তির স্বাদ দিয়ে যাচ্ছে। যেমন গ্রাম বাংলা, আমার গাঁ, কলাপাতা, ঢাকা বিরিয়ানি হাউস, সুন্দরবন, নমস্তে, বাবুর্চি, কৃষ্ণা বা পঞ্চখানা সবই যেন গ্রামবাংলার অনিন্দ সুন্দর এক নান্দনিক উচ্ছ্বাসের মৃদু মন্দ শীতলতা এনে দেয়। বাংলাকেই যেন ধারন করা হয় হৃদয়ে। বাংলার অতি পরিচিত খাবারের পসরা দিয়ে সাজানো হয় এই রেস্তোরাগুলিতে। নানা স্বাদের ভর্তা থেকে শুরু করে মাছের ঝোল, চিকেন টিক্কা মসলা, কোরমা এবং ভিন্দালু বা টিন্দালুর মতো খাবার পরিবেশন করা হয়। তবে বাংলাদেশে ভিন্দালু বা টিন্দালু পাওয়া না গেলেও বিলেতে এ ঝাল জাতীয় খাবারটি অতি জনপ্রিয়। সময়ের বিবর্তনে এই রেসিপিগুলি ব্রিটিশ সংস্কৃতির একটি বড় অংশ হয়ে উঠেছে। এই বাংলাদেশী এবং ভারতীয় রেস্তোরাঁগুলো আধুনিক স্বাদের সাথে প্রাচীন ঐতিহ্যকে একত্রিত করে এক নতুন মাত্রিক রন্ধনশৈলীর সৃষ্টি করেছে যা বিলেতের মাটিতে এক নতুন সাফল্যের দ্বার উন্মোচন করেছে। পুরানো কৌশলগুলি ব্যবহার করে তৈরি করা স্বাদ এবং সুগন্ধের সমৃদ্ধ বিন্যাসের সাথে খাদ্য পরিবেশনা সত্যিই অভিনব এবং, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে কেন বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশী কিংবা ভারতীয় খাবারে এতো জনপ্রিয়তা। প্রাক্তন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী রবিন কুক চিকেন টিক্কা মসল্লাকে ব্রিটেনের সত্যিকারের জাতীয় খাবার হিসেবে ঘোষণা করতে নেতৃত্ব দেন। প্রধানমন্ত্রী, টনি ব্লেয়ারও তার মেয়ের জন্মদিনে একটি বাংলাদেশী কারি রেস্টুরেন্টে খাওয়ার আয়োজন করে এটিকে প্রিয় খাবার হিসেবে স্বীকৃতি দেন। বংলাদেশীদের মালিকানাধীন রেস্তোরাঁতে কাজ করছে লক্ষাধীক লোক যার অধিকাংশই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত, এবং আনুমানিক বার্ষিক টার্নওভার ৩.৫ বিলিয়ন পাউন্ড। এই বিশাল কারি ইন্ডাষ্টীর সাফল্যে বৃটিশ কারি এওয়ার্ড নামে ব্রিটিশ কারি শিল্পের জন্য নিবেদিত একটি বার্ষিক পুরষ্কার ডিনার প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৫ সালে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত রয়েছে।

 

১৮১০ সালে শেখ দীন মোহাম্মের প্রচেষ্টায় যে ভারতীয় রন্ধনশৈলীর পদযাত্রা শরু হয়েছিলো সেন্ট্রাল লন্ডনের পোর্টম্যান স্কোয়ার থেকে তা সময়ের বিবর্তন আর নানা ঘাত-প্রতিঘাতকে অতিক্রম করে পরিনত হয় মহীরুহে, এক বিশাল বাংলাদেশীয় রেস্তোরাঁর সাম্রাজ্যে। শহরের নানা ব্যাস্ততা, কোলাহল আর উত্থান-পতনের পাশ দিয়ে ধীরে বয়ে চলেছে টেমস সময়ের বুকে খচিত বাংলাদেশীদের এক নতুন সাফল্যগাঁথার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এই যেন এক নতুন সময়ের সন্ধিক্ষন। উচ্ছাসে প্রাঞ্জল এক অনবদ্য বাংলাদেশী সংস্কৃতিক পরিচয়ের ইতিহাস যা বিলেতের রন্ধনশৈলীতে এনেছে বৈচিত্রতার মাত্রা। এই সাফল্যের মহিমায় টেমস তীরের নগরকাব্যে এসেছে ঋজুতা এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এক অমলিন অহংকার, বিলেতে বালাদেশীদের আত্মপরিচয়ের এক পরম তৃপ্তিময় অনুভূতি

Leave your review