শিক্ষায় বিনয়ের গুরুত্ব

জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনয়ের মূল্য সম্পর্কে লোকেদের আলোচনা শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছি। বাবা বলতেন একদিন যেন বড়ো হতে পারো বিনয়ের সাথে। স্কুলের মৌলবী স্যার বলতেন যদি পারো আগে বিনয়ী হইও, সাফল্য এমনিই আসবে। সবাই শুধু বিনয়ের কথা বলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার বিনয় যেন মানুষের নাগালের বাইরে। কাউকে সত্যিকারের বিনয়ী বলে মনে হয় না আজকাল। তার মধ্যে আমিও একজন। অকপটে স্বীকার করছি। আমিওতো মানুষেরই দলে। তবে ভালো আর মন্দের ব্যাপার স্যাপার। সবকিছু একটু আপেক্ষিক। কেউ একটু বেশী বিনয়ী, কেউবা কম। আবার অনেকেই আছেন বিনয়ের ভাব তাদের ভাবনায় চেতনায়, আচার-আচরনে কখনো ধরা দেয় না। তারা একটু অন্যরকম। অবিনয়ী একটি সামাজিক রোগ। সমাজের জন্য ভয়ানক। তাই তাদেরকে কেউ খুব একটা বেশী পছন্দ করে না। আর এই বিশ্বায়ন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার যুগেতো মানুষ এমনিই নিজকে নিয়ে খুব ব্যাস্ত, প্রচার আর প্রসারেই। বিনয়ী হওয়ার সম্ভাবনা গুড়ে বালি। মানুষ নাকি যতো শিক্ষিত হয় ততো বেশী বিনয়ী হয়। কিন্তু আসলে কি তাই? এখন সবকিছু উল্টোরথে চলে। শিক্ষিত লোকজনেরা বরং সবচেয়ে বেশী অহংকারী, উদ্ধত, দাম্ভিক, দর্পীত, রুক্ষ স্বভাবের, দূর্নীতিবাজ, অভদ্র, দূর্বিনীত এবং অন্যকে ছোট করে দেখার মানষিকতায় দুষ্ট। কারন এই গুনগুলো না থাকলে যে তাহাদের জীবনে অর্থনৈতিক সাফল্য আসবেনা, সামাজিক মর্যাদার ভারসাম্য থাকবেনা। তাই যতো পারা যায় বিনয় থেকে দূর থাকবে। হাসবে তবে যতোটুকু দরকার, প্রয়োজনে বাকা হাসি, খিলখিল হাসি বা অট্ট হাসি, বড় বড় দাঁত বের করে। তা হলেই সবাই সন্মান করবে। অশিক্ষিত গ্রাম-গন্জের বুদ্বিহীন মানুষেরা বিনয় নিয়ে থাকুক। কারো কোন অসুবিধা নেই। সমাজে ওদের বেশী প্রয়োজন নেই।

 

তবে অনেক বিজ্ঞ জনের মতে বিনয় মানুষের একটি মহ্যগুন। সত্যিকার অর্থে বড়ো মানুষ হওয়ার গুন। প্রাজ্ঞতার লক্ষন। ঈশ্বরের সাথে বিনয়ীদের সবচেয়ে বেশী বন্ধুত্ব। কারন বিনয়ীদের কোন অহংকার নেই, কোন দাম্ভিকতা নেই। বিনয়ীরা অন্যকে সন্মান করে এবং অন্যকে নিজের থেকেও বেশী ভালোবাসে। বিনয় একটি সমাজকে অনেক উপরে নিয়ে যেতে পারে এবং গড়তে পারে সুখী ও সমৃদ্ধির সমাজ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিনয়ী লোকদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। তবে এই আলোচনায় শিক্ষায় বিনয়ের গুরুত্ব নিয়েই কথা বলবো। কারন শিক্ষা একটি জাতীর মেরুদন্ড। উচ্চ শিক্ষায় নম্রতার আর বিনয়ের গুরুত্ব প্রায়শই উপেক্ষিত হয়ে আসছে, যদিও এই গুনটি শিক্ষার্থী এবং প্রতিষ্ঠান উভয়ের সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিনয় এমন একটি গুণ যা মানুষকে তাদের সীমাবদ্ধতাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে এবং অন্যদের কাছ থেকে শেখার আগ্রহ বাড়ায়। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা শিক্ষকরা কেউ কিছু শিখতে চাই না, শুধু শিখাতে চাই। আর এই কারনে আমাদের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে পড়ছে দূর্বল এবং অপ্রায়োগীক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকলের মধ্যে সহযোগিতাকে উত্সাহিত করার জন্য বিনয় একটি শক্তিশালী গুন। উচ্চ শিক্ষা মানব উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য, এবং উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সময় বিনয়ী মনোভাব পোষণ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এটি শিক্ষার্থীদের শেখার জন্য, গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করতে এবং বৌদ্ধিক ও ব্যক্তিগতভাবে অগ্রগতির জন্য একসাথে কাজ করতে উত্সাহিত করে। একে অপরের ধারণা, চিন্তাভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মাধ্যমে, নম্রতা, বিনয়ীভাব সমস্ত শিক্ষার্থীর জন্য একটি সুস্থ শিক্ষার পরিবেশ তৈরী করে। বিনয়ী লোকেরা বিশ্বাস করে যে তাদের কৃতিত্ব কেবল তাদের কঠোর পরিশ্রমের ফল নয়; আশে পাশের অনেকের সহযোগীতার ফল। আর যারা অহংকারী, অথর্ব তারা শুধু সব কিছুর জন্যই নিজকে জাহির করার চেষ্টা করে। সব সাফল্যের পিছনে শুধু তাদের অস্তিত্বকে খুঁজে বেড় করার চেষ্টা করে।

 

বিনয়ী হওয়া মানে অহংকারমুক্ত, ভদ্র এবং সহজ থাকা। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং সম্মান প্রদর্শন করা। যখন একাডেমিক প্রেক্ষাপটে এই গুনটি প্রয়োগ করা হয়, তখন একজন শিক্ষাবিদ হয়ে উঠেন খোলা মনের, একজন শিক্ষার্থী হয়ে উঠে নৈতিক স্বাধীনচেতা, সহকর্মীরা হয়ে উঠেন প্রানখোলা মুক্ত মনের এবং পূর্বকল্পিত ধারণা বা পক্ষপাত ছাড়াই অন্যদের কাছ থেকে শুনতে এবং শিখতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বা মতামত গঠন করার সময় ব্যক্তিগত পক্ষপাত বা বিশ্বাসের পরিবর্তে তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। নম্র এবং বিনয়ী ব্যক্তিরা তাদের নিজেদের এবং তাদের আশেপাশের অন্যদের সীমাবদ্ধতাগুলিকে চিনতে পারে, সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য কার্যকরভাবে একসাথে কাজ করার প্রবনতা বাড়ে। আন্তঃব্যক্তিক স্তরে, বিনয় একই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যক্তিদের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে, যা একইভাবে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্পাদনশীলতার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। বিনয়ী শিক্ষাবিদরা রক্ষণাত্মক না হয়ে বরং গঠনমূলক সমালোচনা পছন্দ করে। এই জাতীয় মনোভাবের কারনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়।

 

সবচেয়ে সফল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষকদের মধ্যে বিনয়ী মনোভাবকে মূল্য দেয়, সন্মান দেখায় এবং নানা ভাবে পুরস্কৃত করে। যখন অধ্যাপকরা শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি মুক্তমনে শুনেন এবং তাদের মনোযোগ সহকারে বিবেচনা করেন, তখন তারা শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসের একটি পরিবেশ তৈরি করেন যা ছাত্র এবং শিক্ষকদের মধ্যে খোলামেলা কথোপকথনকে উত্সাহিত করে। এটি শিক্ষার্থীদের অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার প্রবনতাকে বৃদ্ধি করে যা জ্ঞানার্জনের পরিপূরক। অধিকন্তু, যখন শিক্ষকরা শিক্ষাদান বা গবেষণা পরিচালনা করার সময় ভুল বা ভুলের জন্য দায়বদ্ধতা গ্রহণ করে, তখন তারা জবাবদিহিতার একটি উদাহরন সৃষ্টি করে যা শিক্ষাগত পরিবেশের মধ্যে সততার গুরুত্বকে শক্তিশালী করে। শিক্ষার্থীদের কাজের মূল্যায়ন করার সময় বা সহকর্মীদের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কে জড়িত থাকার সময় নম্রতা শিক্ষাবিদদের বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্ব থেকে বেড় হয়ে শিক্ষাবিদরা বিভিন্ন কাজগুলোকে আরো ভালোভাবে সম্পর্ন করতে মনোনিবেশ করতে পারেন। শিক্ষকদের মধ্যে নম্রত এবং বিনয়ী স্বভাব শিক্ষার্থীদের জন্য একটি উদাহরণ স্থাপন করে যে কীভাবে শ্রেণীকক্ষের অভ্যন্তরে এবং বাইরে পেশাগতভাবে নিজেদের পরিচালনা করতে হয়। শিক্ষকরা যখন বিষয় বা মূল্যবোধের উপর ভিন্ন মতামত থাকা সত্ত্বেও একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, তখন এটি শিক্ষার্থীদের একইভাবে তাদের সমবয়সীদের সাথে সম্মানের সাথে জড়িত হতে উৎসাহিত করে।

 

বিনয় একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ।  আমরা এমন একটি সমাজে বর্তমানে বাস করছি যা প্রায়ই দাম্ভিকতা, অহংকারী আর অভদ্র লোকদেরকেই পুরস্কৃত করে এবং নম্রতাকে নিরুৎসাহিত করে। তাই আমাদের অহংকারে জড়িয়ে পড়া এবং নম্রতার গুরুত্ব ভুলে যাওয়া খুবই সহজ। কিন্তু বিনয়ের এত প্রয়োজন কেন? বিনয় আমাদেরকে উন্মুক্ত করে, বাইরের পৃথিবীকে দেখতে প্রেরনা দেয়, অন্য লোকেদের মতামত এবং দৃষ্টিভঙ্গির মূল্য চিনতে সাহায্য করে। যখন আমরা বিনয়ী হই, তখন আমাদের প্রতিনিয়ত আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষা করার কোন প্রয়োজন হয় না; পরিবর্তে, আমরা ভয় বা কুসংস্কার ছাড়াই অন্যদের ধারণা বিবেচনা করার জন্য উন্মুক্ত হতে পারি এবং নিজেদেরকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করতে পারি। বিনয়ী মনোভাবের কারনে আমরা অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা বা শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার জটিলতায় জড়ানোর প্রয়োজন বোধ করি না বরং একে অপরকে জানার মাধ্যেমে বন্ধুত্পূর্ন সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হই। বিনয় শুধুমাত্র অন্যদের সাথে আরও মজবুত সম্পর্ক গড়ে তোলে না বরং নিজেদের সাথে আমাদের সম্পর্ক উন্নত করতেও সাহায্য করে। যখন আমরা বিনয়ী হই, তখন আমরা আমাদের  ত্রুটিগুলি ধরতে পারি, অতীতের ভুল বা ব্যর্থতার জন্য নিজেকে দোষারুপ না করে বরং মানষিক উৎকর্ষতাকে নিয়ে ভাবতে পারি যেন ভবিষ্যতেচলার পথটা আরো সুগম এবং ত্রুটিহীন হয়। এই ধরনের আত্ম-সচেতনতা ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যেমে সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়।  শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিকোণ থেকে, উচ্চ শিক্ষায় নম্রতা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরো প্রসার এবং উন্মুক্ত করে। শিক্ষার্থীরা যখন বিনয়ের সাথে যেকোন বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশ করে, তখন  তারা নতুন নতুন ধারণার প্রতি আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠে যা জ্ঞানের সার্বিক বিকাশের পরিপূরক। এটি তাদের সত্যিকারের ব্যক্তি হতে সাহায্য করে। বিনয়ী ব্যাক্তিরা বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ চিন্তা করতে বেশী সক্ষম এবং পূর্ব-কল্পিত ধারণা বা পক্ষপাতের পরিবর্তে সত্যের উপর ভিত্তি করে জ্ঞাত সিদ্ধান্ত নিতে পারে অতি সহজে। বিনয় শিক্ষার্থীরা সমালোচনা বা সহকর্মী বা পরামর্শদাতাদের কাছ থেকে যে কোন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কখনো ভেঙ্গে পড়ে না বরং স্ব-উন্নতির সুযোগের সদ্বব্যবহার করতে বেশী সচতন থাকে।

 

নম্রতা এবং বিনয় শিক্ষায় সাফল্যের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে, কারণ এটি আত্ম-প্রতিফলন এবং বুদ্ধি ভিত্তিক মানসিক বিকাশকে উৎসাহিত করে। বিনয়ী শিক্ষার্থীরা তাদের সহকর্মী এবং প্রশিক্ষকদের প্রতি সবসময় খোলামেলা থাকে এবং শিখার আগ্রহ থাকে বেশী মাত্রায়, যা উন্নত একাডেমিক কর্মক্ষমতা এবং আরও ভাল ফলাফলের দিকে নিয়ে যেতে পারে। বিনয় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্প্রদায়ের মধ্যে ইতিবাচক অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে যা শেষ পর্যন্ত অন্তর্ভুক্তি ভিত্তিক সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই আজকের সদা পরিবর্তনশীল বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে নিজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং জ্ঞানার্জনের নিমিত্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিনয়ের পরিবেশ তৈরী করা উচিত। এই ধরনের পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে, শিক্ষার্থীরা একে অপরের সাথে জ্ঞানের বিনিময় করতে পারবে এবং স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে আরও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে, যার ফলে সৃজনশীলতা এবং সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্ব আরও এগিয়ে যাবে। একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে বিনয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য প্রশাসক এবং শিক্ষক উভয়ের প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বিনয় একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য যার জন্য প্রত্যেকেরই চেষ্টা করা উচিত কারণ এটি মানুষের মধ্যে সম্মান বৃদ্ধি করে এবং ব্যক্তিগত বিকাশকে উত্সাহিত করে। আমাদের শিক্ষায় বিনয়ের দর্শন সংযোজিত হোক এবং তৈরী হোক একটি বিনয়ের সমাজ

Leave your review